রবিবার, ২৯ মে, ২০১১

সিদ্ধাসন

দৃশ্য- এক/ সময়- দিন
বটতলা


(গ্রামের ভেতর একটা প্রবীণ বটগাছ। বিশাল আকৃতি, চারদিকে ঝুরি নেমে এসে মাটিতে ঢুকে গেছে। গোঁড়ার কাছটা দিনের আলোতেও প্রায় অন্ধকার। একটা গাড়ি এসে গাছের নিচে দাঁড়াবে, গাড়ি থেকে নেমে আসবে একদল যুবক। তাদের চোখে-মুখে মুগ্ধতা। তাদের অচরণে কিছুটা অস্বাভাবিকতা থাকবে)

চাষী : এই সেই বটবৃক্ষ!
মাসুদ : শুধু বৃক্ষ কইলে এই গাছেরে অপমান করা হয়। বল বৃক্ষদেব!
শাহেদ : এর বয়স কত হইতে পারে কইতে পারবি ?
চাষী : একশ’ বছরের কম না
সোহেল: একশ’ কিরে! আমাদের বাড়ির আমগাছটা দেখিস নাই? ঐটার বয়সই তো আশি-নব্বই বছর!
মাসুদ : তাই নাকি! তাইলে যে তুই কয়দিন আগে আম নিয়া আইসা আমাদের কইলি তোর বাপের লাগানো গাছের আম! তোর বাপেরে তো দেইখা মনে হয় আমার চাইতেও বয়সে ছোট! গাছের বয়স তাইলে আশি-নব্বই হয় ক্যামনে?

(সবাই হেসে উঠবে)

সোহেল : দূর ব্যাটা, ঐটা তো ছিলো বাজারের কিনা আম। বাজার থিকা কিনা বাপের লাগানো গাছের বইলা চালানো হইলো ফ্যাশন
শাহেদ : আদ্দিকালের ফ্যাশন। আজকাল যুগ পাল্টায় গেছে। এইসব উদ্ভট গুলবাজির বেল নাই।
চাষী : গাছের বয়স কিন্তু কেউ কইতে পারলা না।
সোহেল : কেউ না পারলেও মধুদা ঠিকই পারবে। ঐ ব্যাটা তো আবার মহাজ্ঞানী।
শাহেদ : এই একটা খাঁটি কথা কইছোস... মহা জ্ঞানী! তয় ব্যাটা জ্ঞানী হউক বা না হউক, বাউলা যে তাতে কোন সন্দেহ নাই।
চাষী : কিন্তু আমাগো মহাজ্ঞানী ওরফে বাউলা ভাই গেল কই?

(দেখা যাবে দলের থেকে বিচ্ছিন্ন একটি যুবক চিন্তিত মুখে বটগাছটিকে ঘিরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাকে দেখেই মনে হবে গাছটিকে ঘিরে সে কিছু একটা আবিস্কার করবার চেষ্টায় আছে, কিংবা কোনো বিশেষ পরিকল্পনা আছে তার। সোহেল তাকে গলা চড়িয়ে ডাকবে)

সোহেল : কিগো বাউলা ভাই, গাছ দেখা শ্যাষ হয় নাই ? আর কত দ্যাখবেন? দেখতে দেখতে তো মনে কয় গাছের প্রেমে পইড়া গেলেন!
মধু : রাইট ইউ আর! খোদার কসম, আমি এই গাছের প্রেমে পড়ে গেছি। আগামী সাতদিন সাতরাত আমি এই গাছে থাকবো।
চাষী : থাকবা মানে?
মধু : থাকবো মানে বসবাস করবো। গাছের ওপর মাঁচা বেঁধে, মাঁচায় বাস করবো।
মাসুদ : ওহ্ হোয়াট এন আইডিয়া! জমির দাম, বাড়ি ভাড়া, বিল্ডিং কস্ট... সবই যেভাবে বাড়ছে, তাতে আগামী প্রজন্ম দেখিস, ঘুরে ফিরে আবার গাছে গাছেই পুনর্বাসিত হবে।
শাহেদ : এবং অচিরেই জমির মতো গাছ’ও ক্রমশঃ দুষপ্রাপ্য হয়ে যাবে, তারপর যে কয়টা গাছ তখনও অবশিষ্ট থাকবে, সেগুলো চলে যাবে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীদের খপ্পরে।
সোহেল : তারপর টিভি খুললেই বিজ্ঞাপন- চলো না গাছে ঝুলি ভাই...

(সবাই হেসে উঠবে)

মাসুদ : আর তাদের রোল মডেল হবে আমাদের মধু অরফে গাইছা পাগলা!

(সবাই আবার হেসে উঠবে)

মধু : ঠাট্টা নয় বৎস, ইহা সত্য কথা। অতএব, তত্তকথা রাখিয়া আয়োজন করো ধরিতে মৎস।
চাষী : ধরিতে মৎস মানে? মাছ দিয়া কী হইবো?
মধু : ছাগল কোথাকার! তোদের সেন্স ওব হিউমার একদম নাই।
সোহেল : তার মানে বস্, এতক্ষণ মজা করতেছিলেন? থ্যাঙ্ক গড!
মধু : গড মাস্ট বি থ্যাঙ্কড্, আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ করে দেবার জন্যে। এন্ড ইউ গাইজ অলসো বি থ্যাঙ্কড্ টু বি মাই কম্পেনিয়ন ইন দ্য মিশন অব বৃক্ষবাস!
চাষী : আমারে তো পাগলা কুত্তায় কামড়াইছে যে তোমার কম্পেনিয়ন হইতে যামু। লাখ টাকা দিলেও আমি তোমার সাথে নাই । আমারে মাফ করো গুরু।
শাহেদ : আরি শালা, পুরাটা না শুইনাই মাফ চায়া বইলি?
মাসুদ : আমি লক্ষ্য করেছি, চাষীর মধ্যে আজকাল বেশ একটা গৃহী গৃহী ব্যাপার চলে এসেছে। নতুন করে প্রেমে-টেমে পড়ছে কিনা দ্যাখ্!
শাহেদ : ওই ছাগলে পড়বে প্রেমে!
চাষী : কী যে কও না বস্! প্রেম-টেম লয়া টানতাছো কেন?
মধু : তাইলে আজাইড়াই আপত্তি করিস ক্যান? ...তোরা শালা কুনো ব্যাঙ হয়ে থাকলি
মাসুদ : অ্যাবসলিউটলি! আমার কিন্তু গাছটা দেখেই মনে হয়েছিলো, এর ওপরে দূর্দান্ত একটা ট্রি হাউজ বানানো যেতে পারে
মধু : তাইলে দেখো বস, আমি কইলাম দেইখা চেইতা গেল! আরে শালা এই বয়সে মজা করবি নাতো করবি কবে? নাতি নাতনি লইয়া?
সোহেল : বস্, সবই তো বুঝলাম। কিন্তু তুমি এইহানে গাছের উপরে বাড়ি বানাইয়া থাকবা, আর পাবলিক তোমারে আদর করবো?
শাহেদ : বুঝলি মধু, এই জন্যেই মহা-মানবেরা সবাই একলা চলাফেরা করতেন। পৃথিবীর অধিকাংশ মহৎ আইডিয়া শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয় নাই শুধুমাত্র সঙ্গের লোকদের বাগড়া দেওনের জন্যে...
মাসুদ : মহা মানব তো এমনি এমনি হতে পারবি না রে। আগে গরু-ছাগল চরানো শুরু কর, তার পরে না মহা-মানব হওয়া। লক্ষ্য করে দ্যাখ্- আমাদের সকল ধর্মের মহা-পুরুষেরাই কিন্তু তরুণ বয়সে রাখাল ছিলেন...।
মধু : আমি তো এইজন্যেই এদের সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়াই! (ইঙ্গিতে চাষী, সোহেল, শাহেদদের দেখাবে, সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠবে)
চাষী : শাহেদ ভাই-মাসুদ ভাই, আজাইড়া ফাঁপড় লইয়েন না কইলাম! একে তো নাচুনি বুড়ি, তার উপরে ঢোলের বাড়ি।
মাসুদ : ব্যাপারটা এভাবে দেখছিস কেন? মধু তো আর একলা একলা মজা করতে চায় নাই, তোরা কি আর সেই মজা থেকে বঞ্চিত হবি নাকি...?
শাহেদ : মার্ক টোয়েনের একটা কবিতা আছে না... যখন সবাই ছিলো ঘরের কোণে/ ডাকলো আমায় সুনীল আকাশ/ বটের ছায়ায় সবুজ বনে...
সোহেল : আজাইড়া একটা রেফারেন্স ঝাইড়া দিলা। মার্ক টোয়েনের খায়া কাম নাই তোমার মতোন বাংলায় কবিতা লেখতে যাইবো
শাহেদ : আহা, বেচারা টোয়েন বাংলাটা শিখবার সময় পায় নাই, শিখতে পারলে নিশ্চয়ই লিখতো!
সোহেল : ওই মিয়া, মার্ক টোয়েন কি কবি ছিল নাকি...?
চাষী : এইগুলা আলগা পাঁচাল বাদ দাও। গাড়িতে উঠো, দেরি হইতাছে। আইজকার মইধ্যে ফিরতে লাগবে। দোকান বন্ধ কইরা আসছি।
মধু : শালা তোর দোকানে যদি ডাকাতি না করছি! কামের কথা শুন...
মাসুদ : যে দেশের মানুষ কাজকে বলে কাম, সে দেশে শুধু বৃদ্ধিই হতে থাকে, প্রবৃদ্ধি হয়না কোনোদিন!
মধু : মাসুদ ভাই, ঠ্যাকনা দিয়ো নাতো! শুনো। ট্রি হাউজ বানানোর কোন অভিজ্ঞতা তোমার আছে?
(মাসুদ মাথা নেড়ে না বলবে)
: তাইলে কারা বানায়, সেইটা জানো?
মাসুদ : জানি। কানাডিয়ানরা বানায়, সুইডিশ, নরওয়েজিয়ানরা বানায়, ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরাও বানায়, তবে সবচে’ ভালো বানায় অস্ট্রেলিয়ানরা।
(মাসুদের রসিকতায় সবাই হেসে উঠবে, মধু খুবই বিরক্ত হবে)
মধু : তোমরা কেউ সিরিয়াসলি নিচ্ছোই না ব্যাপারটা। আমি কিন্তু একাই এসে থাকতে পারবো। তোমাদের কাউরে লাগবে না। মিশন গাইছা পাগলার জন্যে আমি একাই যথেষ্ট।
সোহেল : আরে বস্ এইটা কি শুধু মিশন নাকি? এইটা হইলো মিশন ডেঞ্জার! তুমি গাছে উইঠা সাতদিন ধইরা বাস করবা আর এলাকার মানুষে তোমারে আদর করবো? এদ্দিন শুনছি পাগল নাকি গাছে ধরে। অহন তো দেহি পাগলেই গাছ ধরছে!
চাষী : পাবলিকের কথা বাদ দাও, সাপে বিছায় যে কামড়াইবো না তার গ্যারান্টি কে দিবো?
মাসুদ : এইগুলা সব সমস্যার সমাধান আছে। আগেকার দিনে অনেক সাধু সন্যাসী গাছে গাছে বাস করতো, জানিস তো? সেই রকম একটা প্ল্যান যদি করা যায়; তবে ধরা পড়লে কিন্তু সর্বনাশ!
মধু : ধরা পড়বো মানে? আমার অভিনয় প্রতিভা নিয়ে তোমাদের সন্দেহ আছে?
শাহেদ : তাইলে বস্, কথা ফাইনাল। মধু সাজবে সাধু বাবা গাইছা পাগলা।
সোহেল : সাতদিন ধইরা থাকবো, খরচাপাতি লাগবো না? ট্যাকা পাইবা কই
চাষী : ট্যাকা পাইবো কই মানে? যার বাপের তিন তিনটা গার্মেন্টস, ট্যাকার চিন্তা হ্যারে করতে দে!
মধু : এইসব তোদের ভাবতে কইছে কে? আগের কাজ আগে কর। শাহেদ ভাই, আপনি একটা পাকাপোক্ত প্ল্যান তৈরি করেন। মাসুদ ভাই...
মাসুদ : আমার দিকে তাকাইয়ো না। আমি হিসাবের বাইরে...
চাষী : কেন? আপনে বাইরে কেন? আমরা যদি থাকি, আপনেরেও থাকতে হইবো।
মাসুদ : সেই কপাল কি আর আছে রে ভাই? তোমরা তো আর বিয়া-শাদী ঘর সংসার কর নাই, বুঝবা কী? তোদের সাথে আসলে পরে তোর ভাবী আমারে...
শাহেদ : এই প্রসঙ্গে শেক্সপিয়রের অবজার্ভেশনটা কী জানিস? বিয়ে হলো একটা ইনসটিটিউশন, যেখানে পুরুষরা হারায় ব্যাচেলর ডিগ্রী আর নারীরা পায় মাস্টার্স ডিগ্রী।
সোহেল : ফের শুরু করলা গুলবাজি!
শাহেদ : আহা শেক্সপিয়র বলেন নাই তো কি? বলতেই পারতেন তিনি। হয়তো ভুলে গেছিলেন, সময় পান নাই...।

(সবাই আবার গাড়িতে উঠতে থাকবে, চাষীর মুখটা ভার ভার হয়ে থাকবে। সবাই চাষীর গাম্ভীর্য নিয়ে স্ল্লেজিং করতে থাকবে, এর মধ্যেই শুরু হবে টাইটেল)

দৃশ্য-দুই / সময়- রাত অথবা দিন
মাসুদের বাসা/ অফিস


(মাসুদ, সোহেল, শাহেদ, মধু ও আরো কয়েকজন মিলে বসে মিশন গাইছা পাগলা’র পরিকল্পনা করছে। মাসুদ কম্পিউটারে, মধুর ছবিতে কখনও দাড়ি লাগাচ্ছে, কখনও চুল বড় করছে, কখনো জটা লাগাচ্ছে... এভাবে বিভিন্নরকম ডিজাইন তৈরি করছে, অন্যরা তাকে সাজেশান দিচ্ছে। এক সময় একটা বটগাছ এবং সেই গাছে একটা ট্রি-হাউজ’এর ডিজাইন তৈরি হবে, অন্যরা সাজেশান দিতে থাকবে। এরই মধ্যে নানান রকম পরিকল্পনা চলতে থাকবে, যেন বিরাট কোন কর্মযজ্ঞের প্রস'তি চলছে।- এই পুরো দৃশ্যটি টাইটেল হিসেবে দেখানো যেতে পারে)


দৃশ্য-তিন / সময়- রাত
মধুর বাসা


(মধু নিজের ঘরে ব্যস্ত হয়ে গোছ-গাছ করছে, মা অবাক হয়ে দেখছেন। অবাক হবার মূল কারণ, মধু উদ্ভট সব জিনিসপত্র গোছানোয় ব্যস্ত। মধুর কাজকর্মে তাড়াহুড়োর ভাব না থাকলেও একধরনের উত্তেজনা আছে। তার চোখে মুখে অ্যাডভেঞ্চারে যাবার আনন্দ থাকবে)

মা : ব্যাপারটা কী? যাচ্ছিস কোথায়?
মধু : অরণ্যে! আবার অরণ্যে যাবো, ধরিত্রী মা’র কাছে। গর্ভধারিণী তব খোলো বাহুডোর!
মা : বাহুডোর বাঁধতে দিলি কবে যে খোলার কথা বলিস? ধরিত্রী মা’র কাছেই তো সারা জীবন থাকলি। ...তা এবারের জঙ্গলটা কোথায়?
মধু : (ভূবন ভোলানো হাসি দিয়ে প্রশ্নটা এড়িয়ে যাবে, একটা লম্বা আলখাল্লা জাতীয় পোষাক দেখিয়ে) দেখো তো মা কেমন দেখায়? একদম সাধুবাবাদের মতো না?
মা : আবার সাধুবাবা সাজবার খেয়াল চাপলো কবে থেকে?
মধু : আমার নামটা তুমি মধু রেখে একরকম ভালোই করেছো মা। মাধুকরী থেকে মধু। মাধুকরী মানে জানো তো? ভিক্ষুক!
মা : বালাই সাট! আমার ছেলে ফকির হতে যাবে কেন?
মধু : ফকির হতে যাবো কেন, ফকির হয়েই তো জন্মেছি। এই পৃথিবীর সবাই আসলে ফকির। কেহ ফকির অর্থের লাইগা কেহ ফকির রূপে/ এই দুনিয়ায় সবাই ফকির কান্দে চুপে চুপে...
মা : হেয়ালী রাখ! (উত্তেজিত ভঙ্গিতে) ঐসব তত্বকথা শুনে শুনে হাড়-মাস কালা হয়ে গেল। দিন দিন বয়স বাড়ছে আর বুদ্ধি-আক্কেল কমছে! ঘর সংসারের দিকে কোনো খেয়াল আছে? বুড়ো বাপটা খাটতে খাটতে শেষ হয়ে গেল, আর এত্তবড় ছেলের এখনো খেলার নেশা কাটেনা। এসব ছেলেখেলা কবে ছাড়বি বলতো!

(মধু হেসে উঠে কিছু একটা বলতে যাবে, মা তাকে থামিয়ে দেবেন)

: আমি কোন কথা শুনতে চাই না। তোর বাবা কার কাছে কী শুনে এসেছে, তুই নাকি কোথায় পীরবাবা সেজে গাছে চড়ে থাকবি সাতদিন। এই নিয়ে কাল রাতে অনেক রাগারাগি করেছে আমার সাথে। এসব পাগলামী এবার ছাড়, মধু। পড়াশোনাটা শেষ করে কিছু একটা কর। বয়স হয়েছে, এবার একটু শান্তি দে।
মধু : মা শোন, বাবা কোত্থেকে... (মা কথা না শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবেন, মধু পেছন থেকে ডাকতে থাকবে) মা শোন, মা...


দৃশ্য-চার/ সময়- দিন
বটতলা


(মাসুদ, চাষী, শাহেদ, সোহেল, জাহিদসহ ছয়-সাত জনের একটা দলকে দেখা যাবে বাঁশ, কাঠ, দড়ি-দড়া ইত্যাদি মাঁচা বাঁধার সরঞ্জাম নিয়ে পূর্বে দেখানো বটগাছের নিচে হাজির। তাদেরকে ব্যস- হাতে গাছের উপর মাঁচা বাঁধতে দেখা যাবে। আশপাশের মানুষ কৌতুহলের সাথে ভীঁড় করবে, তাদের কাছে ‘বিষয় কী?’-জাতীয় প্রশ্ন করবে, দলের কেউ এ ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখাবে না। তাদের পোষাক-আষাকে শহুরে ভাবটা যদ্দূর সম্ভব অনুপস্থিত থাকবে)

দৃশ্য-পাঁচ/ সময়- দিন
মধুর বাসা


(মধু শেষ মুহূর্তের গোছ-গাছ করতে ব্যস্ত। গুন গুন করে আপন মনে গানের সুর ভাঁজছে, পরনে বিরাট আলখাল্লা, মাথায় পরচুলা, মুখে লম্বা দাড়ি, গলায় বিচিত্র ধরণের বেশ কয়েকটা মালা। তাকে দেখাচ্ছে বিরাট কোন সাধুবাবার মতো। বিছানার ওপর বড়-সড় একটা বোঁচকা, একপাশে অদ্ভুৎ আকৃতির একটা লাঠি, পিতলের ঘটি, ধুপদানী ইত্যাদি ছড়ানো। মা এক পাশে দাঁড়িয়ে বিষন্ন মুখে এসব দেখছেন। )

ওরে কাঠুরিয়ায় মানিক চেনে না আহা...
আবার জহরী সে জহর চেনে অন্যে চেনে না
আবার স্বর্ণকারে সোনা চেনে লয় তারে পরখ করে...

মা : এখনও সময় আছে বাবা, এসব পাগলামী ছাড়। ধর্ম নিয়ে এসব মশকরা ভালো নয়। খোদা নারাজ হন।
মধু : বাজে কথা বলো না তো মা। বললেই হলো খোদা নারাজ হন! যারা দিনের পর দিন নিজেদের স্বার্থ-সিদ্ধির জন্যে ধর্মকে ব্যবহার করছে, তাদের ওপর খোদা নারাজ হন না কেন? এইসব বদমায়েশগুলো ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করে, তখন কিছু হয়না...
মা : তাদের সাথে তোর আর পার্থক্য থাকলো কী?
মধু : পার্থক্য অনেক। তারা করে ব্যবসা। আর আমি শুধু একটু অভিজ্ঞতা অর্জন করতে যাচ্ছি। জীবনে সব রকম অভিজ্ঞতাই থাকা দরকার। এটাও শিক্ষারই একটা পার্ট। অভিনেতারা যেমন অভিনয় করে।
...কিংবা ধরে নাও একটু বিনোদন।
মা : বিনোদনের কি ছিরি! লোক ঠকানোর বিনোদনের তোর দরকারটা কী?
মধু : মা! লোক ঠকানোর তুমি দেখলেটা কী? আমি কি কাউকে তাবিজ-কবজ দিচ্ছি, নাকি কোন পানি-পড়া দিচ্ছি? আমি এমনকি পারতপক্ষে কারো সাথে তেমন কথাই বলবো না। আমি শুধু ক’টা দিন গ্রামে গিয়ে থাকবো, আর গ্রামের মানুষগুলোকে কাছে থেকে দেখবো। আমাদের এই যান্ত্রিক নগরে বিনোদনের আর কী এমন ব্যবস্থা আছে বলো? বিনোদনও হবে, বাস্তব অভিজ্ঞতাও হবে। আবার গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলোর কাছাকাছি থেকে কিছু শেখাও হবে।

(মা কিছু একটা বলতে যাবেন, মধু ব্যস্ত হয়ে তাড়া দেবে)

: তুমি এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে, এককাপ চা করে আনো তো মা। চা খেয়েই বেরুবো। ওরা মনে হয় এতক্ষণে সব রেডি করে ফেলেছে।
(মা করুণ চোখে তাকিয়ে থেকে চলে যাবেন, মধু গান ধরবে)
ওরে কাঠুরিয়ায় মানিক চেনে না আহা...
আবার জহরী সে জহর চেনে অন্যে চেনে না
আবার স্বর্ণকারে সোনা চেনে লয় তারে পরখ করে
দয়াল চান্দের মাজারে মুরশীদ চান্দের মাজারে
এক মন যার যাইতে সে পারে...


দৃশ্য-ছয়/ সময়-দিন
বটতলা


(দৃশ্য চার-এর কন্টিনিউয়েশন। মাঁচা তৈরি প্রায় শেষ, একপাশের চালা ঘরটি তৈরি হচ্ছে। জনৈক দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক উপস্থিত হবেন।)

লোক : এইখানে এইসব কী হইতেছে?
চাষী : দেখতেই তো পাইতেছেন কী হইতেছে। আবার জিগান কেন?
লোক : দেখতে পাই সন্দেহ নাই। কিন্তুক দেইখা তো বুঝি না কিছু। এই জন্যে জিগাই। ভাইজানের কি কইতে আপত্তি আছে?
চাষী : জ্বি! আপত্তি আছে। আপনে কি এই গ্রামের মাতুব্বর না জমিদার যে আপনারে সব কইতে হইবো?
শাহেদ : এই চাষী চুপ!
(একপাশে টেনে নিয়ে গিয়ে চাপা ধমক দেবে)
: মধু বার বার মানা করে দিয়েছে, কোন প্রকার ঝামেলা করবি না, এলাকার মানুষ যেন কিছু সন্দেহ না করে। খালি খালি সোজা ব্যাপারটা প্যাঁচাইতেছিস কেন?
চাষী : আরে শালা, সকাল থাইকা এক কথা কয়বার বলবো? নোটিশ টাঙ্গায়ে দাও না কেন!
শাহেদ : আহ্ কইতেছি চুপ থাক!
(আবার লোকটার কাছে ফিরে আসবে, বিনীত ভঙ্গিতে বলবে)
: আপনি কিছু মনে নিয়েন না। অর বুদ্ধি-আক্কেল একটু কম। অল্পেতে মাথা গরম করে। (কানের কাছে বলবে) মাথায় সমস্যা!
লোক : (প্রথম বাক্যটি শাহেদের কানের কাছে ফিসফিস কারে বলবে) আরে বলবেন তো, মাথার গোলমাল? আমার ভগ্নিপতিরও এইরম ছিলো। পীরসাবের পানিপড়া আর তাবিজ দিয়া সারছে। খুব কামেল পীর। আমারে খুব পেয়ার করতেন। তার খাস খাদেমদের সাথে আমারেও থাকতে দিয়েছিলেন। কিন্তু, কপালে নাই, থাকতে পারলাম না। মায়ের অসুখ বইলা বাড়ি থেকে ডাক পড়লো, চইলা আসতে হল। আইসা দেখি অসুখ বিসুখ কিছু না। বাড়িতে উল্টা ধুমধাড়াক্কা চলতেছে। সবেতে মিল্লা আমারে ধইরা বিয়া করায় দিলো।..
সোহেল : ইন্টারেস্টিং ব্যাপার তো!
লোক : এর থেইকা ইন্টারেস্টিং হইলো কি জানেন? বিয়ার পর বউ ফালাইয়া বাবার কাছে চইলা গেছিলাম। বাবা আমারে সাথে নিলেন না। কইলেন, যার যেইটা ধর্ম, তার সেইটা পালন করা উত্তম। তার ধর্ম ফকিরী, আর আমার ধর্ম সংসারী। কী আর করবো, চইলা আসতে হইলো। বাবারে ত্যাক্ত কইরা তো আর থাকতে পারি না। কিন্তু মন মানে না। উদাস উদাস লাগে। এইজন্যে এর পরও কয়েকবার গেছিলাম। পানি পড়া দিছেন।
চাষী : কাজ হয়?
লোক : হয়না মানে? সর্ব রোগের মহৌষধ, মহা শেফা। ক্যান্সার পর্যন্ত সারায়ে দিয়েছে, আপনের পাগলামী তো কিছুই না। বাবার কাছ থিকা তেলপড়া নিয়া আইসা আপনের মাথার মাঝখানের চুল ফালায়ে দিয়ে মাথায় একটা ডলা দিলেই মাথা গরম, বায়ুচড়া সব ঠিক হয়ে যাবে। আবার যাবার নিয়ত আছে। বাবা এখনও জীবিত।
চাষী : (উত্তেজিত) ঐ মিয়া! তখন থিকা মাথা গরম, মাথা গরম করতেছেন; মাথা গরমের দ্যাখলেনডা কী? আলতু ফালতু কথা কওনের জাগা...
(শাহেদ ইশারা করতেই জাহিদ সোহেল দুজন মিলে চাষীকে ধরে একপাশে টেনে নিয়ে যেতে থাকবে)
লোক : মামলা তো মনে হইতেছে জটিল।
শাহেদ : জটিল বলে জটিল? বেকায়দা জটিল। এলাপাতি হোমিওপাতি কোন ডাক্তারে রোগ ধরতে পারে না। তা, মুরুব্বী জানি কোন পীরের কথা কইতেছিলেন?
লোক : আরে খুব কামেল পীর। নামটা অবশ্য ইয়াদ নাই। কী যেন... আরে পীর আউলিয়াদের আবার আলাদা নাম থাকে নাকি? তেনারা হইলেন ভক্তির পাত্র। তেনাদের নাম মুখে নিলে তেনাদের অপমান হয়।
শাহেদ : ঠিক কইছেন মুরুব্বী। আমাদের এইখানেও একজন পীর বাবা আসবেন। ইনিও খুব কামেল লোক। এইজন্যেই আসা।
লোক : তাই নাকি? আরে বলেন কি! এই কথাটা আগে বলবেন না? পীর বাবা আসবেন আর আমি কোন খেদমতে লাগবো না এইটা তো হয় না। রোজ কেয়ামতে আল্লাহ্‌পাকের কাছে কী জবাব দেব, বলেন? আল্লাহ্‌পাক যখন বলবেন, ‘হে আমার বান্দা, কেন তুমি আমার পেয়ারা আশেকের প্রতি ভক্তি করো নাই...?’ তখন আমি কী জবাব দেব, বলেন?
শাহেদ : আল্লাহ্‌পাকেরে এই প্রশ্ন করার সুযোগ দিয়েন না চাচা, আমাদের সাথে খেদমতে লাইগা পড়েন। বাবার আসতে তো বেশি দেরি নাই, কাজ কর্ম শুরু করে দেন।
লোক : আরে তা তো করবোই, তা তো করবোই! আপনে না বললেও করতাম। আমার একটা দায়িত্ব আছে না? কিন্তু, ... আপনেরা জানি কী নিয়তে এইখানে, যদি বলতেন...?
(সোহেল, জাহিদদেরকে দেখা যাবে চাষীকে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে, চাষী প্রথমে আপত্তি করলেও পরে সেটা মেনে নিবে, তারপর সবাই আবার ফিরে আসবে। চাষীকে একটু বিচলিত দেখাবে)
শাহেদ : আমার ছোট ভাইয়ের জন্যে আসছি। পীরবাবা এর আগে চারঘাটে আখড়া করছিলো, সেইখানে গেছিলাম। তার আগে ছিলো আব্দুলপুরে, সেইখানেও গেছিলাম। বাবার মনটা আজকাল একটু উদাস, তাই নিজের মইধ্যে থাকেন। আমরা অপেক্ষায় আছি, তার মন শান্ত হইলে চাষীর জন্যে খাস দিলে দোয়া করবেন, যাতে ওর পাগলামী বন্ধ হয়। তিনি কথা দিয়েছেন।
(সোহেল, জাহিদের দিকে চোখ মটকে, ইঙ্গিতপূর্ণ ভঙ্গিতে বলবে)
না রে সোহেল...?
সোহেল : হ হ, গাইছা বাবার অসীম দয়া...!
লোক : গাইছা বাবা!
জাহিদ : বাবা কখনও গাছে ছাড়া থাকেন না। তেনার মাটিতে নামতে কষ্ট হয় তো, তাই সব সময় গাছে গাছে থাকেন। থাকা খাওয়া, হাগা-মুতা সব গাছে!
লোক : কী আজিব খেয়াল! তা তো হইবই, তা তো হইবই। আল্লাহ্‌পাকের খাস রহমতের বান্দা, তেনারা কী আর আমাগো মতোন পাপী তাপী গুণাগার? তেনারা তো সবার থিকা আলাদা হইবই! মাশাল্লাহ্‌ মাশাল্লাহ্‌।
জাহিদ : মুরুব্বী, খালি মাশাল্লাহ্‌ কইলে তো হইব না। আমরা হইলাম ভিনদেশি। বাবার খাদেম। আপনে এলাকার লোক। খাওয়া-খাদ্যের এন্তেজাম করেন। বাবায় তো আইসা পয়লাই খাইতে চাইব!
লোক : (লজ্জা পেয়ে দাঁতে জীব কাটবে) অতিশয় ভুল হয়ে গেছে। মাফ করে দেবেন। কথা বলতে গিয়ে দিন দুনিয়া খেয়াল ছিলো না। আমি এক্ষনি সব এন্তেজাম করতেছি।
জাহিদ : যান চাচা, তাড়াতাড়ি যান।
(লোকটি ব্যস্ত ভঙ্গিতে চলে যাবে, সবাই কিছুক্ষণ তার গমন-পথের দিকে তাকিয়ে থাকবে)
সোহেল : যেখানেই যাও, মক্কেল একটা না একটা জুটেই যায়!
শাহেদ : (গান ধরবে)
পাপ পূণ্যের কথা আমি কারে বা শুধাই
এক দেশে যা পাপ গণ্য
অন্য দেশে পূণ্য তাই
পাপ পূণ্যের কথা আমি কারে বা শুধাই...

দৃশ্য-সাত/ সময়- দিন
গ্রামের পথ


(গাড়ি থেকে নেমে এসেছে মধু, তার পরনে বিরাট আলখেল্লা, গাইছা বাবা’র সাজে সে সম্পূর্ণ প্রস'ত। তাকে নিয়ে যেতে এসেছে সোহেল ও চাষী)

মধু : কী ব্যাপার, তোরা একলা যে? কথা কী ছিলো? পালকি কই?
চাষী : পালকি পাই নাই।
মধু : পাই নাই মানে? আমি এখন যাবো কিসে? গাইছা বাবা হাঁইটা যদি মাচায় গিয়া উঠে... নাহ্ তোরা দেখি আমারে ডুবায় ছাড়বি...
সোহেল : এত অস্থির হইতেছো কেন? গাইছা বাবার মন হইতে হইবো শান্ত, গাছের মতো শান্ত!
মধু : আহ্লাদ করিস না! কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা, খালি ফটর ফটর কথা।
চাষী : বস্, আমার কথাটা শুনো, এই হাঁটাই হইলো তোমার শেষ হাঁটা। আর জানি জিন্দেগীতে হাঁটতে না হয় সেই ব্যবস্থা করা হইছে...
মধু : (চাষীর দিকে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে) কী কইবার চাস? তোরা আমার টেংরি ভাঙ্গনের প্ল্ল্যান লইছিস নাকি...?
সোহের : কী যে কও না বস, প্ল্যান যা করনের করছে শাহেদ ভাই। ওই দ্যাখো...!
(মধু সামনে তাকিয়ে প্রথমে কিছুই দেখতে পাবে না। ক্যামেরা নিচে থেকে ওপরে টিল আপ হতে ধীরে ধীরে পা থেকে মাথা পর্যন্ত একটা অতিকায় হাতি দেখা যাবে। হাতি দেখে মধু হতভম্ব হয়ে যাবে, তার মুখে কোন কথা যোগাবে না)

দৃশ্য- আট/ সময়- বিকাল
বটতলা


(লং শর্টে দেখা যাবে, মধু হাতির পিঠে চড়ে বটগাছের দিকে আসছে, পেছনে পায়ে হেঁটে আসছে চাষী, সোহেল ও আরো ক’জন। তার দলবলকে বিচিত্র ধরণের জিকির জাতীয় ধ্বনি উচ্চারণ করতে শোনা যাবে। তাদের পেছনে এলাকাবাসীর একটা বিরাট দল জুড়ে থাকবে। হাতি এসে দাঁড়াবে একদম মাঁচার নিচে, শাহেদ, জাহিদ, সোহেল, চাষী এরা হাতির পিঠে বসা মধুকে বিচিত্র কায়দায় কদমবুসি করবে। এলাকার লোকজনও দেখাদেখি কদমবুসি করতে আসছে দেখে মধু দ্রুত মাঁচায় উঠে যাবে, পূর্বে দেখানো দাড়িওলা ভদ্রলোক বিব্রত হয়ে অন্যদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে। শাহেদরাও কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়বে)

দৃশ্য- নয়/ সময়- বিকাল
বটতলা


(আগের দৃশ্যের কন্টিনিউয়েশন)

লোক : বাবায় আমারে খেদমতের কোন সুযোগই দিলেন না! বাবার মনে হয় আমারে পছন্দ হয় নাই। মনে বড় খায়েশ ছিলো বাবারে নিজের হাতে আহার করাবো, বাবা তো আমারে কাছে যাওনেরই সুযোগ দিলেন না!
শাহেদ : আপনারে তখন কইলাম না, বাবার মনটা কয়দিন ধরে একটু উদাস! আপনে কিছু মনে নিয়েন না।
লোক : এইটা কী কন বাবাজ্বি, বাবা কী আর আমরা’র মন ধইরা চলবো? আমি কিছু মনে নেওনের কেডা! বাবার দেখা যে পাইছি, এইটাই তো আল্লাহ্‌পাকের রহমত! আলহামদুলিল্লাহে রাব্বিল আলামীন!
চাষী : মুরুব্বী, আপনে খাওয়া-খাদ্য যা আনছেন, রাইখা যান। বাবা যখন তখন খাইতে বসেন না। যখন মর্জি হইবো, আমরা তারে খাবার বাইড়া দিমু।
লোক : চইলা যাবো! এইটা কী কন? গাইছা বাবা এইখানে এই জঙ্গলে পইড়া থাকবো, আর আমি নাদান মূর্খ, বাড়িতে গিয়া কাঁচা মরিচ ডলা দিয়া ভাত খাইতে বসবো? এইটা আপনি কেমন কইরা ভাবলেন?
শাহেদ : এ তো দেখি উল্টা ফাঁপড়! ম্যালেরিয়া সারাইলো কুইনাইন, এহন কুইনাইন সারাইবো কে?
সোহেল : চাচা, আপনের থাকার দরকার নাই। আমরা তো থাকলামই। তাছাড়া বাবা আবার বেশি লোকের ভিঁড়-ভাট্টা পছন্দ করে না।
লোক : আপনেরা এতগুলান লোক যদি ভিঁড়-ভাট্টা না করেন, তো আমি একলা কেমনে ভিঁড় বাড়াইলাম, কন? তাছাড়া পীর-আউলিয়াদের সাথে আমার থাকোনের অভ্যাস আছে। তারার খেদমত করা আপনেদের মতন চ্যাংড়া পোলাপানের কাম না। আপনেরা সকাল থিকা অনেক খাটাখাটনি করছেন, অহন গিয়া আরাম করেন। আমি আছি, বাবার কোন তকলিফ হবে না।
চাষী : (স্বগত ও বিরক্ত) আরে জ্বালা! আমার বিলাই আমারে কয় ম্যাঁও!! এই কোন ফ্যাসাদে পড়লাম রে বাবা?
শাহেদ : চাষী তুই চুপ। আমারে দেখতে দে ব্যাপারটা।
লোক : দেখনের তো কিছু নাই। আমি তো বাবার খেদমতে আছিই। ঝামেলা যদি কিছু হয়, আমি সামাল দেব। আরে এইটা তো ব্যাপারই না। সত্য পীরের মাজারে জৈষ্ঠ্য মাসের পূর্ণিমাতে হইল ওরস! দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আইসা হাজির। লোকে লোকারণ্য! সবকিছু তালগোল পাকায়ে ছ্যাড়াব্যাড়া। এত লোকের ভিঁড় সামাল দেয়া কি যেমন তেমন কথা? এই মহব্বতউল্লাহ্‌ ছিলো বলেই সবকিছু ঠিক-ঠাক। পীর বাবা তো সেই থেকেই আমারে মহব্বত করা শুরু করলেন। আমারে দেখলে নূরানী হাসি দিয়া বলতেন, “মহব্বতউল্লাহ্‌, তুমি বড়ই মহব্বতের লোক!”
চাষী : বুঝতে পারছি, আগামী সাত দিন আপনের মহব্বতের জোয়ারে আমরা ভাইসা যাবো! কোন নিস্তার নাই। সবাই সিট বেল্ট বাইন্ধা বসেন!
লোক : আব্বাজ্বি, আপনেরা অনেক তকলিফ করছেন, এখন যান, আরাম করেন। আমি আছি। কোন চিন্তা কইরেন না। বাবারে কদমবুসিটা করতে পারি নাই, এইটা অবশ্য একটা চিন্তার বিষয়। অবশ্য কদমবুসি করতে গেলে বাবারে ত্যাক্ত করা হইত, এইটাও ঠিক। কাউরে ত্যাক্ত কইরা ভক্তি দেখানোয় কোন ফায়দা নাই!
শাহেদ : এইটাই তো আপনারে বলতে নিছিলাম। বাবা তার আপনার লোক ছাড়া আর কাউরে কাছে দেখলে ত্যাক্ত হন। আপনেরে দেখলেও হইতে পারেন।
লোক : এইটা কী কইলেন বাবা, আমি কি তার পর কেউ? সারাটা দিন তারে দেখার নিয়তে বইসা আছি, এইটা কি তারে ত্যাক্ত করা?
চাষী : জ্বি না মুরুব্বী, এইটা তারে ত্যাক্ত করা না, তারে ধন্য করা। বাবার সাত পুরুষের কপাল যে আপনি তারে দেখতে আইছেন...
লোক : আস্তাগ্‌ফিরুল্লাহ্‌! আস্তাগ্‌ফিরুল্লাহ্‌! আল্লাহ্‌পাক গোস্তাকি মাফ করুক। আব্বাজ্বির মেজাজটা মনে হয় এখনও চড়া!(শাহেদকে একপাশে ডেকে নিয়ে কানের কছে বলবে) আপনে তারে এইখান থাইকা সরায়ে নিয়া যান। চটাং চটাং কথা বলতেছে, গাইছা বাবা শুনতে পারলে গোসা হইতে পারেন।
চাষী : আরি! এ হালায় কয় কী? এ তো দেখি শেষ পর্যন্ত আমাগোরেই হাপিস কইরা ফালাইবো! শাহেদ ভাই, কিছু কইতেছেন না ক্যান?
(উপর থেকে আওয়াজ আসবে, মধু একটা ঘন্টা বাজাবে। সোহেল ব্যস্ত ভঙ্গিতে গাছ বেয়ে মাঁচায় উঠে যাবে। অন্যেরা তার গমন-পথের দিকে তাকিয়ে থাকবে। কিছুক্ষণ পর সোহেল খুব চিন্তিত ভঙ্গিতে নেমে এসে মহব্বতউল্লাহ্‌কে উদ্দেশ্য করে বলবে)
সোহেল : মহব্বত চাচা, আপনে আসছেন শুইনা বাবা খুবই খুশি হইছেন, কিন্তুক তাঁর শরীরটা আইজ ভালো নাই। তেমন কিছু না, এই একটু ক্লান্ত। আপনারে আইজ চইলা যাইতে কইছে। কাল সকালে আইসা বাবার সাথে সাক্ষাত করবেন। সাক্ষাত-পরিচয় ছাড়া আখড়ায় কারো থাকার নিয়ম নাই, এইটা মনে করায় দিতে আমারে ডাক দিছিলো। যান চাচা, কাইল আইসেন।
লোক : (বিষন্ন মুখে) বাবার কথার উপ্‌রে তো আর কিছু বলার নাই। তাইলে বাবাজ্বি আপনেরা থাইকেন, বাবার খেদমত ঠিকঠাক মতো কইরেন। আর কোন সমস্যা হইলে আমারে খবর দিয়েন, তুরন্ত আইসা হাজির হবো। রাইতে খাওয়ার এন্তেজাম কী?
শাহেদ : এইটা আপনেরে ভাবতে লাগবে না। আমরা ব্যবস্থা করবো।
লোক : ঠিক আছে বাবাজ্বি। আপনেরে বলা লাগতো না, আমি নিজেই ব্যবস্থা করতাম। কিন্তু আমার ছোট শালার আবার একটু অসুখ। আমাশয় হয়েছে। রাইতে দেখতে যাওয়া লাগবে। সামাজিকতা। অর্থহীন কাজকর্ম। না কইরাও পারি না। বিবি গোসা হয়।
চাষী : না না চাচা, বিবিরে গোসা করা ভালো কাজ না। একদম ভালো কথা না। আমাদের নিয়া ভাবনের কাম নাই। আপনে আপনার শালার আমাশয় দেইখা আসেন। বিবি খুশি হইবো, আমরাও খুশি হমু।
শাহেদ : বাবায় খুশি হইবো, আল্লাহ্‌পাকও খুশি হইবো।
(পীর বাবাসহ সকলের উদ্দেশ্যে লম্বা-চওড়া সালাম দিয়ে মহব্বতউল্লাহ্‌ চলে যাবে, সবাই বড় করে শ্বাস ছাড়বে।)

দৃশ্য-দশ/ সময়- বিকাল
মধুর বাসা


(ট্রাভেল ব্যাগ সাথে নিয়ে খুব স্মার্ট একজন তরুণী এসে বাড়ির সামনে সিএনজি/ ট্যাক্সি থেকে নামবে। নেমেই খুব হাঁক-ডাক শুরু করে দিবে। তার আচরণে বোঝা যাবে, সে এই বাড়ির কোনো সদস্য। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবেন মা। মেয়েটি মধুকে খুঁজছে, মা তাকে খুব আদর যত্ন করে ভেতরে নিয়ে যাবেন, মধু কোথায়- এই প্রশ্নটি এড়িয়ে যাবেন)


দৃশ্য-এগারো/ সময়- রাত
বটতলা


(গাছের উপর মাঁচায় বসে মধু, শাহেদ, সোহেল তিনজনে কথা বলছে। শাহেদ সোহেল কিছুটা উদ্বিগ্ন, কিন্তু মধুকে বেশ আনন্দিত মনে হবে)

শাহেদ : এই মহব্বতউল্লাহ্ তো দেখি জান কাহিল কইরা ফালাইলো! এর হাত থিকা বাঁচার একটা পথ বাইর করতে হইব, কইয়া রাখলাম।
মধু : আরে মুরুব্বী মানুষ, হাউস কইরা আইছে, তোমাগো এত টেনশন কেন?
সোহেল : টেনশন মানে? ব্যাটা তো রীতিমতো পেইন!
মধু : পেইন ভাবলেই পেইন। তোরা সবকিছু এত ভাসা ভাসা চিন্তা করিস কেন? তোদের কি ধারনা, আমি এইসব ব্যাপার মাথায় রাখি নাই? এলাকার লোকজন আসবে, তারা যেমন ভালো বলবে, তেমনি মন্দও বলবে। বিশ্বাস যেমন করবে, আবিশ্বাসও করবে। এইসব মাথায় রাখতে হবে। এত অল্পতেই নার্ভাস হইয়া পড়লে চলবো কেমনে?
শাহেদ : পুরা প্ল্যান আমার করা, আর আমি হমু নার্ভাস? হইছি তো আসলে বিরক্ত! শালার বুইড়া, এত সাহস, আমাগো কয় গিয়া আরাম করেন। হেয় করবো বাবার সেবা!
মধু : (হাসতে হাসতে) এইজন্যেই কয়, মাইনষের ভালো করতে নাই। সে বেচারা তোমাগো আরামের চিন্তা করলো, তোমাগো ভালো চাইলো, আর তোমরা তারে শালার বুইড়া কইয়া গাইল পাড়লা!
সোহেল : না, গাইল পাড়বো না, ঘোড়ার আন্ডা পাড়বো। বেডায় কথা কইতে ধরলে তো থামনের নাম করে না। তয় বস, জবর শিক্ষা হইছে চাষীর। শাহেদ ভাই তো হ্যারে কইছে চাষীর মাথার গোলমাল, তারপর থিক্কা মহব্বতউল্লায় বার বার ওরেই টার্গেট করে। কয় বলে কী তেলপড়া না কি পড়া জানি নিয়া মাথায় ডইল্লা দিবো। আবার মাথার মাঝখানে বলে টাক করা লাগবো! চাষী তো চেইত্যা মেইত্যা ফায়ার।
(তিনজনেই খুব জোরে হেসে উঠবে)
মধু : চেতনের এক্ষনই দেখছোস কী? ওরে যে আমি কী করুম না! খালি চাইয়া দেখিস। আমার সাথে ঘাড় ত্যাড়ামী কইরা পার পাইবা?
শাহেদ : বেশি কিছু করিস না কইলাম। মাঝে মইধ্যে উল্টা-পাল্টা করলেও হের মনটা কিন্তু ভালো।
মধু : সেইটা কি তোমারে কইতে হইবো? আমি সেইটা বুঝি না?... এখন শুনো, আইজকা তো কোন রকমে পার করলা। কাইলকার জন্যে তৈরি থাকা লাগবো।
সোহেল : কাইলকা আবার কী?
শাহেদ : কী মানে? সক্কাল বেলাই তো মহব্বতউল্লাহ্ আইসা হাজির হইবো।
মধু : সেইটা তো আছেই। তার উপরে পাবলিক যে আরো জুটবো না, এইটা কেমনে কই? আইজকাই যেমনে জুটছিলো, মনে তো কয় কাইলকা দুই চাইরটা ভক্তও জুইটা যাইতে পারে। মুরীদ হইতে চাইলেই বেকায়দা। তাবিজ-কবজ, পানিপড়া চাইয়া বসলে মুশকিল!
সোহেল : মুশকিলের কী! চাইবো, তুমি দিয়া দিবা। দোয়া কালাম যা জানা আছে, বেবাক পইড়া ফুঁ দিয়া দিবা।
মধু : বাজে কথা একদম ক’বি না। এইসব ধান্দাবাজি করতে এইখানে আইছি নাকি?
সোহেল : এইটা তোমার আগেই খেয়াল করা উচিৎ ছিলো। আমরা কিন্তু কইছিলামও।
শাহেদ : আরে তখন কি আর ভাবছি যে সবাই এমন বিশ্বাস কইরা ফালাইবো? যা হোউক, আমারেই কিছু একটা ভাইবা বাইর করা লাগবো।
মধু : ভাবাভাবি যা করার বিছানায় গিয়া ভাবো। এখন যাও, ঘুমানোর ব্যবস্থা কর। আন্ধার থাকতে উঠা লাগবো।
শাহেদ : (আতঙ্কিত) ক্যান বস্? আন্ধার থাকতে উঠা লাগবো ক্যান!
মধু : আহা, বুঝো না ক্যান? মাচা বাঁধছো, চালা তুলছো; ল্যাট্রিন-বাথরূম কিছু বানাইছো? হাগা-মুতা করা লাগবো না? পাবলিকের সামনে করবা?
সোহেল : কী কথা শুনাইলা বস্! আমার তো এক্ষনই বেগ পাইতে শুরু করছে! অহন করি কী?
মধু : কী আর করবা! গাঙ্গের ধারে বইসা গান ধরোগা যাও! ...আরে তোমরা তো তাও এইখানে ওইখানে সারতে পারবা, বেকায়দায় তো ফেলছো আসলে আমারে! পীর সাবে যদি এই জোব্বা জাব্বা নিয়া খালপাড়ে বসে...
(শাহেদ সোহেল দুজনেই প্রবল শব্দে হেসে উঠবে, নিচে থেকে অন্যেরা আওয়াজ দিবে, কী হইছে বস্?- বলে। হাসতে হাসতেই শাহেদ বলবে-)
শাহেদ : গাইছা বাবারে প্রকৃতি ডাক দিছে...


দৃশ্য-বারো/ সময়- রাত
মধুর বাসা


(মধুর মা কথা বলছেন শাজনীনের সাথে। শাজনীন মধুর কাজিন। তাকে বেশ উত্তেজিত মনে হবে।)

শাজনীন : আমি কোন কথা শুনতে চাই না। তোমরা কেউ তাকে আঁটকালে না কেন? একটা মানুষ দিনের পর দিন এরকম পাগলামী করে যাবে, আর তোমরা কেউ তাকে কিছুই বলবে না?
মা : আমাদের কথা কি শোনে? তুই পারিস না বলতে?
শাজনীন : আশ্চর্য্য ব্যাপার! এটা আমার বলবার কথা নাকি? তোমাদের ছেলে তোমাদের কথা শুনবে না- এটা কেমন কথা?
মা : ছেলে বড় হয়ে গেলে সে আর মায়ের আঁচলে বাঁধা থাকে না, বেঁধে রাখাটা শোভা পায় না। যার আঁচলে বাঁধা থাকার কথা সে’ই থাকবে সাতশো মাইল দূরে... এমন তো তাহলে হবেই!
শাজনীন : কী অদ্ভুৎ কথা তুমি শোনাচ্ছো মামনি! আঁচলে বাঁধাবাঁধি’র মতোন এসব ইমোশনাল টার্ম ব্যবহার করবে না। কোরবানীর গরু নাকি যে বেঁধে রাখতে হবে?
মা : না রাখলে ওরকমই হবে, খোদার খাশির মতো চরে বেড়াবে! আমার হয়েছে যত জ্বালা। সবাই চলে নিজের মতো, এদিকে খবরদারীতে কেউ কারো চেয়ে কম যায় না! না ছেলে কথা শোনে, না শোনে মেয়ে...
শাজনীন : বললাম না ইমোশনাল কথাবার্তা বলবে না! নিজের মতো চলা দেখলে কোথায় তুমি? তোমার কোন কথাটা শুনিনি, বলতে পারো?
মা : বিয়েটা করিস নি! পড়ে পড়ে দ্বিজ্ঞজ পন্ডিত হবেন। কেন, এত যে বলি, বিয়ে করে ছেলেটাকেও সংসারী কর, নিজেও সংসারী হ’; তা শুনবি কেন!
শাজনীন : মেডিক্যালের পড়ার চাপ কেমন তুমি জানো না? না পড়লে পাশ করবো কেমন করে? আর পাশ না করলে খাবো কী? তোমার ছেলে তো মাশাল্লাহ্‌! খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, পড়াশোনা সব রেখে এখন তোমার তার ছিঁড়া ছেলেকে আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি!
মা : আহা হা, তার ছিঁড়া, না? তা ঐ তার ছিঁড়া ছেলের জন্য এত উতলা কেন? আমরা কি মরে গেছি যে ঘরে ঢুকেই সবার আগে ঐ তার ছিঁড়ার খোঁজ নিতে হবে?
শাজনীন : ওহ্ মামনি, তুমি বড় ঝামেলা করছো। আসল কথা এড়িয়ে গিয়ে উল্টাপাল্টা দিকে ঘোরাচ্ছো। মধু কোথায়, কোন গ্রামে গেছে তার কোন ঠিকানা আছে তোমার কাছে?
মা : (নিরুত্তর)
শাজনীন : নেই, তাইতো? কেন নেই? এইটুকুও কি বুদ্ধি-আক্কেল করতে হয় না? ঠিকানাটা লিখে রাখলে কী এমন হতো?
মা : ঠিকানা দিয়ে আমি করবোটা কী? ঠিকানা ধরে কে তাকে খুঁজে বের করতে যাবে?
শাজনীন : কেন, আমি যাবো! ...তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না, এই তো? আচ্ছা মামণি, তোমার কি ধারণা, তার কি তোমার ছেলের একার ছিঁড়া?
মা : তার মানে, তোর পরিকল্পনাটা কী?
শাজনীন : উহু, ওটা তো বলবো না! তোমার ছেলে যখন তার পরিকল্পনা জানায়নি, তখন আমার পরিকল্পনাও জানতে পারবেনা। জাস্ট ওয়েট এন্ড সি...
মা : তোরা যে আমার কথা শুনিস না, তাই শুধু না; তোরা কেউ আমাকে কিছু বলিসও না।
(মা উঠে চলে যাবেন, শাজনীন বিব্রত হয়ে তার চলে যাওয়া তাকিয়ে দেখবে)


দৃশ্য-তেরো/ সময়-সকাল
নদীর পার


(সকাল বেলা। মধু মাচায় বসে আছে, তার হাতে একটা বাইনোকুলার। সেটা ব্যবহার করে সে গ্রামের চারপাশ দেখার চেষ্টা করছে। স্ক্রিনে বাইনোকুলারের ভিউটিই দেখা যাবে। মধুর দৃষ্টি বিভিন্ন দিকে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ একটা মেয়ের ওপর এসে স্থির হবে। এই মেয়েটার নাম মোহর। তার গেট-আপ ভীষণ মলিন, কিন্তু চেহারা খুবই মায়াকাড়া। মধু মেয়েটিকে দেখে খুবই নাড়া খাবে। বাইনাকুলারের লেন্স ঘুরিয়ে কখনও কাছে থেকে, কখনও দূরে থেকে দেখবে। যত দেখবে ততোই সে শিহরিত হবে। মেয়েটি নিজের মনে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাবে, মধুর বাইনোকুলার তাকে ফলো করবে, একেবারে তার বাড়িতে ঢোকা পর্যন্ত। এই সময় নেপথ্যে একটি গানের সুর/মিউজিক আবহ থাকবে)

গান

বন্ধুরে তোর এত মায়া কোথায় রাখি বল
কালো আমার মনের ভিতর নিত্য ঘোলা জল
জলের উপর চর জাগে না অথৈ জলের রাশি
মনের জলে নৌকা ভাসা, বাজা রে তোর বাঁশি
সেই সুরেতে নতুন কইরা মানুষ হবার ছল
কালো আমার মনের ভিতর নিত্য ঘোলা জল ॥

মনারে তোর জন্ম হইল চাঁদের বুড়ির ঘরে
মাটির উপর নামলি রে তুই অনেক দিনের পরে
চোখের উপর শান্তি রে তোর, শান্তি শরীর মাখা
বুক ভরা তোর মায়া বন্ধু, আকাশ দিয়া ঢাকা
সেই আকাশে উড়াল দিতে আমায় নিয়া চল
কালো আমার মনের ভিতর নিত্য ঘোলা জল ॥



দৃশ্য-চৌদ্দ/ সময়-দিন
বটতলা


(বেলা প্রায় ন’টা দশটা হবে, তখনও আখড়ার কেউ ঘুম থেকে উঠেনি। সবাই স্থান-কাল পাত্র ভুলে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে, এমন সময় মোহাব্বতউল্লাহ্‌ এসে হাজির হবে। তার হাঁক-ডাকে মোটামুটি স্বরগরম হয়ে উঠবে গোটা আখড়া। শাহেদ আর সোহেল মাঁচার উপরেই শুয়েছিলো, তারা আরো বেশি উদ্বিগ্ন হবে এই ভেবে যে, মহব্বতউল্লাহ্‌ তাদের মাঁচার ওপর দেখে কিছু সন্দেহ না করে বসে!)

মহব্বত : বিষয়টা কী? এত্তখানি বেলা হইল এখন পর্যন্ত বাবার আখড়ায় ঝাড়-ঝাঁটা পড়ে নাই, আগরবাতি জ্বলে নাই, ধূপ-ধুনা গোলাপজল কোনোকিছুরই তো কোনো এন্তেজাম নাই। সবেতে চিৎপাত দিয়া ঘুমাইতেছেন- এইটা কেমন ব্যাপার হইলো? আমি আগেতেই কইছিলাম, বাবার খেদমত করা এইসব চ্যাংড়া পোলাপানের কাম না। আরে এই সব কী? এত্তখানি বেলা হইলো, এরার কোন সাড়া শব্দ নাই! ওই মিয়ারা, আপনেরা কী শুরু করলেন, কন দেহি!
শাহেদ : (মাচার ওপর থেকে নামতে নামতে) কী হইছে চাচা, এরকম চিৎকার করতেছেন কেন? এমন হুড়-হাঙ্গামার হইলটা কী?
মহব্বত : হইলটা কী মানে? হয়নাই টা কী? এখন পর্যন্ত আখড়ায় ঝাড়-ঝাঁটা পড়ে নাই, আগরবাতি জ্বলে নাই, সবেতে পইড়া পইড়া ঘুমাইতেছেন, আবার আমারে কন হইলোটা কী?
সোহেল : চিৎকার করতেছেন কেন?
মহব্বত : আমি চিৎকার করতেছি? আমি কি এমনেই চিৎকার করি? আমি আগেই কইছিলাম, পীর আউলিয়াদের খেদমত করা আপনেদের মতো চ্যাংড়া পোলাপানের কাম না। আপনেরা আমারে থাকবার দিলেন না, নিজেরাই সেবা করবেন বইলা। (অদূরে দাঁড়িয়ে চাষী চোখ ডলছে, তার দিকে উদ্দেশ্য করে) সেবার নমুনা তো দেখতাছি, এখনও বাবাজ্বিদের চোখ থাইকা ঘুমের ভাব যায়নাই!
চাষী : ওই মিয়া, আবার শুরু করছেন? তখন থিকা ঘুম ঘুম করতেছেন, মিয়া-! ...বাবার শরীল যে ভালো নাই এইটা মনে আছে? সারারাত ধইরা হের পা টিপা দিছে কেডা? আপনে তো গেছিলেন আপনের শালার আমাশয় দেখতে!
মহব্বত : (জিব কাটবে) আস-াগফিরুল্লাহ্‌! আমার একদম ইয়াদ ছিলো না। (তার কথার উদ্দেশ্য বাবার অসুখ এবং চাষীর মাথার গোলমাল দুটোর যে কোনটা হতে পারে; তিনি একটু সামলে নিয়ে বেশ নরম গলায় বলবেন-) আসলে হইছে কি বাবাজ্বি, কাইলকা মধ্য রাইতে আমার শালার অসুখ বাড়াবাড়ি হইলো। তারে নিয়া সবেতে হাসপাতালে গেছে, বহুদূরের পথ। গাড়িঘোড়া কিছু নাই, যাতায়াত ব্যবস্থা অতি দূর্গম। আমার যাওয়াটা কর্তব্য ছিলো, যাইতে পারি নাই বাবার কথা ভাইবা। বাবা এইখানে গাছতলায় পইড়া থাকবো আর আমি নাদান অর্থহীন দুনিয়া-দারীতে মাতবো- এইটা কেমনে হয়।
শাহেদ : যাউকগা, বাদ দেন চাচা। আপনে তো বাবার সাথে স্বাক্ষাত করবেন? বাবা অপেক্ষা করতেছেন।
মহব্বত : ইন্নালিল্লাহ্‌! এইটা আপনে এত্তক্ষণে বলতেছেন? বাবা আমার জন্যে অপেক্ষা করতেছেন আর আমি নাদান, অর্থহীন তর্কে সময় কাটাইতেছি! তৌবাস্তাগফিরুল্লাহ্‌! চলেন চলেন...
সোহেল : আপনের ওযু আছে তো?
মহব্বত : কী আশ্চার্য্যি কথা, ওযু ছাড়া বাবার কাছে আসবো -এইটা আপনে ভাবলেন কেমনে?

দৃশ্য-পনেরো/ সময়- দিন
গ্রামের পথ


(গ্রামের ভেতর একটা চায়ের দোকান, সেখানে বিভিন্ন বয়সের কয়েকজন লোক বসে আড্ডা দিচ্ছে। কোন একজনের রসিকতায় সবাই একটু পর পর হেসে উঠছে। এই সময়ে কেউ একজন একটা রিক্সায় করে মাইকে কারো মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করতে করতে যাচ্ছে, সবাই উৎসুক হয়ে শুনবে)

ঘোষক : একটি শোক সংবাদ। জীবনপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য, জনাব আকবর আলী অদ্য সকাল সাত ঘটিকায় ইন্তেকাল করিয়াছেন। ইন্নালিল্লাহে...রাজিউন। মরহুমের নামাজে জানাজা বাদ আছর উত্তরপাড়া জুমা ঘরে অনুষ্ঠিত হইবে। ....

জনৈক : কামডা দেখলি? মানুষ মরলে তার আর কোন দাম থাকে না। লোকটা ছিলো এই ইউনিয়নের মেম্বার, তারে খালি সদস্য কইলো! এইটা এদের বিচার...?
(এই সময় শাজনীনের গাড়ি এসে সেখানে দাঁড়াবে। শাজনীন গাড়ি থেকে নেমে আসতেই সেই লোকটি উৎসুক হয়ে এগিয়ে যাবে কথা বলতে)
শাজনীন : (লোকটির উদ্দেশ্যে) এই যে ভাই শুনছেন? বলতে পারেন এই অঞ্চলে একজন পীর বাবা এসেছেন, কোন গ্রামে গেলে তার সন্ধান পাওয়া যাবে?
লোক : যেই গেরামে তিনি এসেছেন, হেই গেরামে গেলেই তারে পাইবেন।
শাজনীন : (বিরক্তির সাথে) কোন গ্রামে তিনি এসেছেন সেটাই তো জিজ্ঞেস করছি!
লোক : সেইডা তো আগে বলেন নাই! যাউক গা, আপনে এক কাম করেন, এই রাস্তা ধইরা সোজা উত্তরে আঠারো মাইল মতন যাইবেন। তারপর সেইখানে গিয়া লোকজনরে জিগাইবেন। মনে কয়, হ্যারা আপনেরে কইতে পারবো।
শাজনীন : ‘মনে কয়’ মানে কী, আপনি কি শিওর না?
লোক : শিওর তো আছিলামই। তয় অনেক দিন আগের কথা তো, পীর বাবা এখন না’ও থাকবার পারে। হে’রা আবার যাওনের সুময় আমারে কইয়া যায় না, হে হে হে...
শাজনীন : (লোকটির রসিকতায় মহা বিরক্ত) আশ্চর্য!
লোক : যে আপা, বড়ই আচ্চার্য! হে হে হে...
শাজনীন : দুই এক দিনের মধ্যে কোনো পীর এসেছে বলে কোন খবর জানেন?
লোক : জ্বে না আপা, হেরা যেমন যাওনের সুময় আমারে কইয়া যায় না, তেমুন আসনের সুময়ও কইয়া আসে না, হে হে হে...
শাজনীন : ননসেন্স, এদের সাথে কথা বলাই মুশুকিল! জংলী ভুতটা কেমন করে যে এদের সাথে থাকছে!

(শাজনীন বিরক্তিসূচক কথা বলতে বলতে আবার গাড়ীতে উঠে যাবে। ধুলো উড়িয়ে গাড়ী চলে যাবে সামনের দিকে)


দৃশ্য-ষোল/ সময়-দিন
মোহরের বাড়ী


(মধু ভোর বেলায় যে মেয়েটিকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলো, তার নাম মোহর। তার স্বামী নিরুদ্দেশ, তাই সে মায়ের সাথে থাকে। তিন জনের সংসারে তৃতীয় ব্যক্তিটির নাম বাক্কার, সে কোন কাজ কর্ম করে না। সুতরাং উপার্জন করতে হয় মোহর এবং তার মা জরিনাকে। এই মহিলার স্বামীও নিরুদ্দেশ, সেটা অন্তত দশ বছর আগের ঘটনা। অথচ তিনি সমভাগ্য বরণকারী মেয়ের প্রতি সদয় না হয়ে বরং মাত্রাতিরিক্ত বৈরী!
মোহর সেই সকাল বেলা ঘাট থেকে কাপড় ধুয়ে আনার পর আর বাড়ির বাইরে যায়নি, রোজ তাকে প্রধান মেম্বারের বাড়ি কাজে যেতে হয়, যার বিনিময়ে এক বেলার খাবারসহ মাসের শেষে যৎসামান্য নগদ টাকা পাওয়া যায়। আজ তার কাজে যাওয়ার মন নেই!)


জরিনা : তাইলে তুই আইজকাও কামে গেলি না? এর আগে দুই দিন অসুখের কথা কইয়া বাড়ি বইয়া থাকলি। মেম্বারের বউ আর তোরে কামে রাখবো? ...কথার জবাব দেস না কেন? কাম করবি না তো খাবি কি? ভাতার তো ছুটছে, এখন ভাতটাও ছুটবার রাস্তা বানাইতেছিস?
(মোহর কোন কথা বলবে না, কলতলাতে ঘাড় গুঁজে থালা বাসন মাজতে থাকবে। থালা বাসনগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি শব্দ করবে)
: চিনস না মেম্বারের বউরে? দুইদিন কামে না গেলে অন্য লোক রাইখা দিবো। এদের কি ট্যাকার ঠ্যাকা, না গেরামে ভুখা লোকের ঠ্যাকা? ...সবই বুঝিস তারপরও এইরম করিস ক্যান। স্বামীর ভাত তো কপালে নাই, এহন নিজের ভাতটাও কইরা খাবি না? .... কথা কস না কেন, মুখে কি ছাই পড়ছেরে মুখপুড়ি...
(মোহর ভিষণ তেজে শব্দ করে উঠান কাঁপিয়ে ঘরে চলে যাবে, যাবার সময় তার হাতের জিনিসপত্র থেকে একটা কাঁসার গেলাস পড়ে গিয়ে বিকট শব্দ করবে)
: প্যাটে ভাত নাই তাও মাগির ত্যাজ কমে না! কারে তুই ত্যাজ দেহাস? কারে দেহাস? তোর ত্যাজের আমি খ্যাতা পুড়ি। কথার জবাব দেস না কেন? মুখে ফোস্কা পড়ছে? ... এই মাইয়া প্যাটে ধরছিলাম! হাড় মাস সব জ্বালায় খাইলো রে... ওরে আমার মরণ হয়না কেন...
(মোহর বুঝতে পারছে, তার মা’র কোন পরিকল্পনা আছে। সে এবার আরো বেশি ধুপধাপ করে ঘরের ভেতর থেকে বাইরে এসে মায়ের সামনে দাঁড়ায়, তার রণরঙ্গিনী মূর্তি দেখে জরিনা ভয় পেয়ে যায়। কোন রকমে সামলে নিয়ে আসল কথাটি বলে ফ্যালে)
: জালাল মিয়া কাইল আবার আইবো, তারে কী জবাব দিমু?


দৃশ্য-সতেরো/ সময়- দিন
বটমূল


(মহব্বত বসে আছেন মাচার ওপর, মধুর সামনে। তিনি সরাসরি মধুর দিকে তাকাচ্ছেন না। তাকে খানিকটা অপ্রস্তুত মনে হচ্ছে। মনে হতে পারে তিনি কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। ক্যামেরা তার মুখে ক্লোজ হবে, ঠিক যে মুহূর্তে মনে হবে তিনি মুখ খুলছেন, তখনই মধু কথা বলে উঠবে)

মধু : শুনলাম আপনি আমারে দেখবার জন্যে বেচয়ন হয়ে আছেন?
মহব্বত : জ্বে মানে... না আরকি... ইয়ে আপনে হইলেন পীর আউলিয়া মানুষ, আপনেদের মতো মানুষেরে দেখতে পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার। আমার কপালে আছিলো তাই আপনেরে এই গেরামে আমরার মইধ্যে পাইলাম! শুকুর আলহামদুলিল্লাহ্‌!
মধু : কিন্তু আমি তো দেখছি কাল থেকে কেবল আপনিই আসছেন বার বার, আর কেউ তো আসে না। তাহলে কি তাদের কপাল খারাপ, নাকি আমারই কপাল খারাপ?
মহব্বত :(বিব্রত) এইটা কী বললেন বাবা, আমরা হইলাম মূর্খ নাদান মানুষ, আমরার ভাগ্য দিয়া কি আপনের ভাগ্য বিচার করা যায়? আপনে আর আমি কি সমান হইলাম?
মধু : আল্লাহ্‌পাক স্বয়ং বলছেন সব মানুষ সমান, সেখানে আপনি আমি কেমন করে পার্থক্য করি বলেন?
মহব্বত : বাবা যদি বেয়াদবী না ভাবেন তো একটা কথা বলি, মানুষ যতি সবেতে সমানই হইলো, তাইলে সবার কপাল এক রকম হইলো না কেন? কেউ ধরেন বড়লোক, কেউ গরীব মিসকিন...
মধু : তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়ালো এই, আল্লাহ্‌ তার সব বান্দাকে সমান দেখেন না, এই তো? ...পার্থক্য আসমানে নয়, পার্থক্য জমীনে হয় । মানুষ মানুষকে বড় করে, মানুষেই তাকে ছোট করে। খোদার কাছে সবাই সমান, ছোট-বড় হয় মানুষের দরবারে।
মহব্বত : এইটাই সত্যি বইলা জানি, কিন্তু সারা জীবন যা দেইখা আসতেছি, মানতে কষ্ট হয়। সবেতে যদি সমান হয় তাইলে কি আর দুনিয়াদারী চলে? রাজা আর মুচি কি এক হইতে পারে? ...দেওয়ালের গাঁথনি দেওনের সময় সব কি আর এক সমান ইঁট দিয়া গাঁথা যায়? কয়ডা ইঁটেরে ভাইঙ্গা ছোট করা লাগে...
মধু : আবার ওই দেয়ালের উপর যখন ছাদ বসাইবেন, তখন কিন্তু সব ইঁটেরে ভাইঙ্গা এক সমান করা লাগে। আর তারপরে যে ঢালাইটা হয়, সেটা আপনার দেয়ালের গাঁথনির থেকে অনেক বেশি মজবুত!
মহব্বত : (বিষ্ময়ের সাথে তাকিয়ে থাকবে। কিছুক্ষণ তার মুখে কথা যোগাবে না। তারপর আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলবে) বাবা আমারে আপনি আপনের মুরীদ কইরা নেন। আমি সারা জীবন আপনের সাথে থাকতে চাই। আপনের সেবা করণের সুযোগ দেন...আপনের পাশে পাশে থাইকা জ্ঞানলাভের সুযোগ দেন...
মধু : মুরীদ শব্দের মানে কী, মুরুব্বী?.... বলতে পারলেন না তো? আমিও জানি না, মুরীদ কারে বলে, কেমনে কারে মুরীদ করা যায়... শুধু জানি, মানুষ কেউ কারো অধীন না, এক আল্লাহ্‌র অধীন। যারে সৃষ্টিকর্তা সৃজন করে স্বাধীন পরিচয়ে, আমি তারে অধীন করি কোন সে ভনিতায়? ...আর জ্ঞানের কথা বলতেছেন? শিখানোর জন্য দুনিয়াটা বড় ছোট, কিন্তু শিখবার আছে গোটা একটা বিশ্ব। এই পৃথিবীর সকল জ্ঞান মানুষ নিজে নিজে আবিস্কার করেছে, কেউ তারে কোন কিছু শিখায় নাই। আল্লাহ্‌পাক শুধু বলেছেন, পড়ো! বলেছেন- জানতে চেষ্টা করো; নিজেকে, নিজের অবস্থাকে আর অবস্থানকে। ...আমি মূর্খ মধু পাগলা কতটা শিখেছি যে, আপনেরে শিখাবো?
মহব্বত : এইটা আপনে কী কইলেন? আপনের মইধ্যে যে জ্ঞানের জ্যোতি দেখতেছি...
মধু : জ্ঞান নয় মুরুব্বী, এর নাম ধোঁকা। চোখা চোখা কয়টা কথা বলে আপনারে ভ্যাবাচেকা খাওয়ায়ে দিয়েছি, আপনি ভাবতেছেন আমি বুঝি বিরাট জ্ঞানী... এইসব আলখেল্লা পরে জটা-দাড়ি নিয়ে ভেক ধরেছি বলে আপনের চোখে ধোঁকা লাগায়ে দিয়েছি, আপনি ভাবতেছেন আমি বিরাট কোন সাধু-আউলিয়া, তাইতো? হা হা হা... চোখ কান খোলা রাখলে এইসব সবাই দেখতে পারে, সবাই বলতে পারে।
মহব্বত : (দ্বিধান্বিত) বয়স তো বাবা কম হইলো না, এই বয়সে কম তো আর দেখলাম না শুনলাম না। তাও তো কিছু বুঝলাম না বাবা...
মধু : বুঝতে যে পারেন নাই, তার কারণ, বোধ করি আপনার দেখার মধ্যে ঘাটতি আছে। আচ্ছা বলেনতো দেখি ইঁট তৈয়ার হয় কেমন করে?
মহব্বত : ভাটার মইধ্যে মাটি পুড়ায়ে...
মধু : কতদিন লাগে মাটি পুড়ে ইঁট হতে?
মহব্বত : তা ধরেন উর্ধ্বে হইলে দশ দিন...
মধু : তাইলে বলেন, বছরের পর বছর আগুন জ্বলে যে চুলায়, সেই চুলার মাটি পুড়ে কেন ইঁট হয়না?... (মহব্বত পুরোপুরি কনফিউজ্ড) নিজের অবস্থান বদলাতে না পারলে নিজেকে বদলানো যায় না। নিজেরে খুঁজতে হয় নিজের থেকে বাইরে এসে। তাইলে দেখবেন সব পরিস্কার!... একটা কথা কি জানেন মুরুব্বী, বিশ্বাসে আকৃতি গড়ে, বিশ্বাসই ভাঙ্গে তারে...
(মহব্বত মোটামুটি হতবুদ্ধি হয়ে বসে আছেন, ভাষাহীন চোখে তাকিয়ে আছেন মধুর দিকে)
মধু : আমি কি বুঝাইতে পারলাম বাবাজ্বি?
মহব্বত : (মাথা নিচু করে বসে আছেন, তার চোখে পানি। কিছুক্ষণ পর চোখ তুলে তাকিয়ে) আমার জন্যে একটু দোয়া করবেন বাবা। পাপী-গুণাগার মানুষ, আমার দোয়া আল্লাহ্‌পাক শুনতে পান না। আপনের সুপারিশের অছিলায় যদি একটু শান্তি পাই...
মধু : আপনি আবারও উল্টো কথা বললেন মুরুব্বী। যার চাওয়া, তাকেই চাইতে হয়। আল্লাহ্‌পাক যার দাবী তার নিজের মুখ থেকে শুনতে ভালোবাসেন। আর আমার সুপারিশের কথা বলতেছেন? আল্লাহ্‌ তো নিজেই কোরান শরীফে বলেছেন, কে আছে এমন, যে আমার অনুমতি ছাড়া আমার কাছে সুপারিশ করে? ...এখন বলেন, আপনের জন্যে সুপারিশ করবো- সেই অনুমতি কি আল্লাহ্‌ আমাকে দিয়েছেন?


দৃশ্য-আঠারো/ সময়- দুপুর
গ্রামের কোনো বাড়ির উঠান


(আলী এবং বাক্কার নামক স্থানীয় দুই যুবক কথা বলছে গ্রামের কোন অবস্থাপন্ন লোকের সাথে। তার নাম ইদ্রিস আলী, একসময় সে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ছিলো, তাই লোকে ডাকে ইদ্রিস মেম্বার বলে। তাকে দেখে যতটা প্রভাবশালী বলে মনে হয়, ততোটা সে নয়। তার ভাবভঙ্গির মধ্যে কিছুটা হামবড়া ভাব আছে)

আলী : এইরম বইসা থাইকা তো কোন ফায়দা নাই চাচা। কিছু একটা করা লাগবে।
ইদ্রিস : তাতো করা লাগবোই! কী আশ্চার্য্যি কথা! তিনদিন ধইরা বটতলাতে রঙ্গো-ঢঙ্গো হইতাছে, মাচা তৈয়ার করতেছে, চালা বানাইতেছে...
আলী : মাচা তৈয়ার, চালা বানানিডা তো কোন বিষয় না। সেইখানে যে পীর-ফকিরীর নাম লইয়া ফটকাবাজি চলতেছে, আপনে এইডার কিছু করেন।
ইদ্রিস : করবো না মানে, অবশ্যি করবো। এত্ত এত্ত হুড়-হাঙ্গামা হইতেছে আর আমি কিছু জানি না? আমারে কেউ কিছু জানানির দরকার মনে করলা না!
বাক্কার : আপনেরে জানাইতেই তো আইলাম, আপনে কিছু একটা করেন। এর একটা বিহিত ব্যবস্থা করেন।
ইদ্রিস : বিহিত তো করবোই! তোমরা না কইলেও করতাম। এইটা কি পোলাপানের রঙ-তামাশা নাকি? গেরামের ভিতর বেশরিয়তী কাজ কারবার করে পার পাবে নাকি?
আলী : (অসহিষ্ণুভাবে) করবেন করবেন তো সেই সকাল থিকা কইতেছেন, করতেছেন কই?
ইদ্রিস : তোমাগো পোলাপানগো লইয়া এই হইলো বিপদ! সবকিছুতে তোমরা অস্থির হইয়া যাও। এত অস্থির হইলে চলবো কেমনে? যাউকগা, তোমরা আমার কাছে আইসা ভালো করছো, তয় আর কারো কাছে যাওনাই তো?
বাক্কার : গেছিলাম... মানে যাই নাই, এই আরকি... রাস্তার মইধ্যে দেখা হইলো তো, তাই ...
ইদ্রিস : বুঝতে পারছি। পরধান মেম্বারের কথা কইতেছো...?
(আলী মাথা নিচু করে বিরক্ত মুখে বসে আছে, বাক্কার একটু দ্বিধান্বিতভাবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাবে)
ব্যাস! ঘটনা যা বোঝার বুইঝা ফালাইছি... তা আমার কাছে আর আইলা কেন? পরধানের ঘরেই থাকতা! ...আরে জ্বালা, বুদ্ধি-আক্কেল কিছু কি আছে নাকি তার? তার বুদ্ধি শুইনা কারো কোন উপকার কোনদিন হইছে? হের বুদ্ধি যে শুনছে, উপকার তো দূরের কথা, উল্টা তার আরো ক্ষতি হইছে। তোমরা শুইনা আইছো, তোমাদেরও হইবো, হইতে বাধ্য! হের মাথায় তো ঘিলু কিছু নাই, আছে শুধু গোবর, তাও যদি গরুর গোবর হইত!... তা যাউকগা, কও দেহি কী বুদ্ধি সে তোমাগো দিলো?
বাক্কার : থাক চাচা, বাদ দেন। বোকা লোকের কথা শুইনা কাম কী?
ইদ্রিস : শুইনা কাম নাই, তাতো জানা কথা। তাও শুনি। আমার বুদ্ধিটা তার পরে বলবো। তারপর তোমরাই বিচার কইরা দেখবা, এই গেরামে কার বেরেন সবের থেকে পরিস্কার... বলো, বলো, তার বুদ্ধিটা বলো আমারে।
বাক্কার : (আলীর দিকে একবার তাকাবে, তারপর মাথা নিচু করে) পরধান চাচা বুদ্ধি দিলো... বিষয়টা আপনের সাথে একবার পরামর্শ কইরা দেখতে...
(ইদ্রিস কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যাবে, আলী হাসি লুকাতে চেষ্টা করলেও কিছুটা প্রকাশ পেয়ে যাবে। ইদ্রিসকে অসহায় দেখাবে)
ইদ্রিস : তা.. ইয়ে... পরধানের বুদ্ধি কম এইটা ঠিক, তয় সে মানুষ কিন্তু খারাপ না। ইদানিং মেম্বার হয়ে অনেক কাঁচা টাকা কামায়েছে, এইজন্যে লোকের সাথে বনে না। অবশ্য আমারে খুব মান্য করে। করবো না কেন? ওরে তো ইলেকশানের পয়সা আমিই দিছিলাম।
(আলী ও বাক্কার এই কথা শুনে দুজনে দুজনার মুখ চাওয়াচাওয়ি করবে, তাই দেখে সামলে নিয়ে ইদ্রিস বলবে) পরে শোধ দিয়েছে, কিন্তু তবু তার বিপদের সময়ে এই ইদ্রিস মেম্বার যদি পাশে না দাঁড়াইতো, তাইলে কী হইতো? শোন তাইলে একখান গল্প কই... আমার লাইফ-হিস্টোরী!
আলী : আপনের লাইফ-হিস্টোরী পরে হুনুম, অহন কামের কথা কন।
ইদ্রিস : আরে থামো তুমি। কামের কথাই তো কইতেছি, এত উতলা হও কেন? ... যাউকগা, কী বলতেছিলাম যেন? হ্যাঁ মনে পড়েছে... হইছে কি, আমার তখন যুবক বয়েস, তোমার চাচীজানরে কেবল শাদী করেছি। তোমার চাচীজান মাশাল্লাহ্‌ ভালো সুন্দরী, আশপাশের দশ গেরামে এইরম সুন্দরী এক জনেও নাই...
বাক্কার : এইজন্যে আপনের মাইয়া কাকলীও তো মাশাল্লাহ্ সুন্দরী...
ইদ্রিস : আরে কী বলো, মাইয়া মানুষের রূপ হইলো চুলে, মায়ের লাহান চুলডাই হে পাইলো না...
বাক্কার : আপনে খেয়াল করেন নাই চাচা, হের চুলও কিন্তু খারাপ না, লম্বা, কালা কুচকুচ...
ইদ্রিস : আরে মিয়া, গরুর ল্যাজে যেই চুল থাকে সেইডাও তো লম্বা, কালা কুচকুচ... (হঠাৎ বুঝতে পারবে তার মেয়ে সম্পর্কে এই বাদাইম্যা ছেলেদুটোর মনোযোগ বেশ প্রবল, তার কপালে ভাঁজ পড়তে দেখা যাবে) ব্যাপার কী বাক্কার মিয়া, আমার মাইয়ার বিষয়ে তোমার এত আগ্রহ কেন? বিষয়ডা কিন্তু আমার ভালো ঠেকতেছে না...
(বাক্কার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাবে, আলী চোখ পাকিয়ে তাকাবে তার দিকে)
আলী : যে চাচা, আমারও ভালো ঠেকতেছে না। এই শালার গাইছা পীর না গাইছা বান্দর, হেইডারে আইজই খেদান লাগবো।
ইদ্রিস : সেইডাতো খেদাবোই, তার আগে দেহি আরো অনেকরেই খেদান লাগবো...
(বাক্কার ভয় পেয়ে যাবে, তাড়াতাড়ি সে প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করবে)
বাক্কার : চাচা জানি কী গল্পের কথা কইতেছিলেন, চাচীআম্মার সাথে নতুন শাদী হয়েছে, চাচীআম্মা মাশাল্লাহ্‌ দেখতে সুন্দরী...
ইদ্রিস : আমার বউয়ের সৌন্দর্যতা লইয়া তোমার এত পুলক জাগে কেন? ...ওই মিয়া সারা দিন করোটা কী, খালি আমার বউ-মাইয়ার পিছে পিছেই থাহো নাকি? সাহস তোমার কম না... হই হালার পু, কার লগে কথা কইতাছোস জানোস তুই? ... আমি ইদ্রিস মেম্বার এখনও জীবত, মইরা তো যাই নাই... এহনও ডাক দিলে দশ গেরামের লোক আইসা আমার পিছে খাড়া হইবো...
(আলী চেষ্টা করছে ইদ্রিসকে শান্ত করতে। এতক্ষণ সুবিধা করতে না পেরে শেষে সে বাক্কারকে ইশারায় চলে যেতে বলবে, বাক্কার কোন রকমে সটকে পড়বে)
আলী : বাদ দেন চাচা, হেরও মাথায় পরধান মেম্বারের মতো মইষের গোবর ভরা...
ইদ্রিস : আমার সামনে পরধান মেম্বারের নামে আকথা-কুকথা বলো, ওই মিয়া তোমারও তো দেহি সাহস কম না! ওই বেডা জানোস, পরধান আমার মামা শ্বশুরের আপন ভাতিজার সমুন্ধি...
আলী : এ তো মহা প্যাঁচে পড়লাম, আপনের সাথে তাল দিতে গিয়া বাক্কারও দোষী হইলো, আমিও দোষী হইলাম। সকাল থিকা কইতাছি গাইছা বাবার একটা বিহিত করেন, না সেই বিষয়ে আলাপ নাই, উল্টা পাল্টা কেচছা-কাহিনী। হুদাই ব্যাপারটারে কেন এমুন প্যাঁচাইতেছেন...
ইদ্রিস : আইচ্ছা, তাইলে গাইছা এইবার তোমারও বাবা হইলো? ভালো ভালো! ...আমি হুদা ব্যাপারটারে প্যাঁচাইতেছি, আর তোমার গাইছা বাবা সব সিধা কইরা রাখছে, না? তো প্যাঁচ খাইতে আমার কাছে আইছো ক্যান? যাওনা কেন, তোমার বাবার কাছে যাও, প্যাঁচ না খাওয়াইয়া তোমারে জিলাপীও তো খাওয়াইতে পারে...
আলী : আপনে তো আজিব চিড়িয়া, মাইনষের মাথার হিসাব খুঁইজা বেড়ান, ওই মিয়া আপনের নিজের মাথার তো সবগুলা তার ছিঁড়া! আপনের কাছে আইসাই ভুল করছি...
ইদ্রিস : ভুল করছো তো এহনও খাড়ায় আছো কেন? যাওগা, তোমার বাবার সাথে মাচায় উইঠা বইসা থাকো! ...খাড়াও, তোমারেও দেইখা লমু, তোমার বাবারেও দেইখা লমু, আমার নাম ইদ্রিস মেম্বার...
আলী : আমারে আর কী দেখবেন, বাবারে যে কত কী দেখতে পারবেন, এইডা হইলো কথা...।


দৃশ্য-ঊনিশ/ সময়-বিকেল
গ্রামের পথ


(শাজনীনের গাড়ী কাদায় আঁটকে গেছে। কোনমতেই তোলা যাচ্ছে না। সে মহা বিরক্ত। একদল অর্ধ-উলঙ্গ বাচ্চা-কাচ্চা তার গাড়ির পেছনে ধাক্কা দিচ্ছে। তাদের ধাক্কায় একসময় গাড়ি সচল হলে শাজনীন ঝড়ের বেগে গাড়ি ছুটিয়ে ফিরে যাবে।)



দৃশ্য-বিশ/ সময়- দিন
বটমূল


(গাছের নিচে রীতিমতো ভীঁড়। গ্রামবাসী আবালবৃদ্ধবনিতা একত্রিত হয়েছে গাইছা বাবা’কে এক নজর দেখার জন্য। অনেকে এসেছে বিভিন্ন অজুহাতে পানি পড়া, তাবিজ-কবজ এইসব নিতে। শাহেদ, চাষী, সোহেল জাহিদদের ভীঁড় সামলাতে হিমসিম অবস্থা। মাচার ওপর থেকে মধু এবং মহব্বত এইসব দেখতে থাকবে। মধুকে ভীষণ চিন্তিত ও বিচলিত মনে হবে। মহব্বতউল্লাহ্‌কে বেশ ব্যস্ত -উত্তেজিত মনে হবে)

মহব্বত : দেখছেন বাবা, কান্ডটা দেখছেন? আপনে পানি পড়া না দিলে কী হইবো, মাইনষে কি আপনেরে ছাড়বো? এরা হইলো জনম দুঃখী। আপনের দোয়ার অছিলায় এরা দুঃখ ভুলতে চায়।
মধু : আমি দোয়া করলেই এদের দুঃখ দূর হবে? এদের নিজেদের চেষ্টা করবার দরকার নাই?
মহব্বত : এরা কি আর চেষ্টার কমতি রাখে? দ্যাশের বেবাকটি মাইষেই তো রাতদিন চেষ্টা করতেছে, ক্যামনে একটু ভালা থাকা যায়। ...চেষ্টা দিয়া কী হয়? কিস্যু হয়না। আল্লাহ্‌পাকের মর্জি ছাড়া কারো কিছুই করার নাই।
মধু : আপনাদের ধারনাটা কী? আল্লাহ্‌পাক চান না আপনাদের ভালো হোক?
মহব্বত : আল্লাহ্‌পাকে কী চান, তা তো বাবা আমাদের জানার বাইরে। তয় আমরা মানুষগুলা সারাটা জীবন শুধু কষ্টই পাইয়া গেলাম। কোনোদিন সুখের মুখ দেখলাম না। পরকালের বেহেস্তের মুলাডা ঝুলাইয়া না রাখলে, আমাগো বাইচা থাকারই কোন আশা থাকতো না।
মধু : আপনারা সবাই একসাথে চেষ্টা করলেই নিজেদের ভাগ্য ফিরাইতে পারেন।
মহব্বত : সবাই তো একসাথে হইবো না বাবা! কে কারে কার সাথে বসাইবো? সবেতে আছে ক্যামনে কারে ল্যাং মাইরা আগে যাওন যায়, হেই তালে। আপনে হইলেন পীর আউলিয়া মানুষ, আপনের দিল পাক-পবিত্র। আমাগো অন্তর যে কত রকমের বদ্-খেয়ালে ভরা, ...আপনেরে এইসব কইয়াই তো পেরেশানীতে ফেললাম!
মধু : কিন্তু মুরুব্বী, আল্লাহ্‌পাক ততোক্ষণ কাউকে সাহায্য করেন না, যতক্ষণ বান্দা নিজেই নিজেকে সাহায্য না করে - এই কথাটা তো খেয়াল রাখা দরকার।
মহব্বত : আমাগো সাহায্য করনের লাইগাই তো আল্লাহ্‌পাক আপনেরে আমাগো মইধ্যে পাঠায়েছেন। আল্লাহ্‌পাকের অসীম দয়া যে আপনেরে আমরা কাছে পাইছি!
মধু : আমি কেউ না মুরুব্বী, আপনাদের ভাগ্যের মালিক আপনারা নিজেরাই।
মহব্বত : এইটা তো বাবাজি ঠিকই। আমাদের কপাল জন্মের থেকে ফাটা, কারে কী কমু! ...বাবায় যদি অনুমতি দেন তো নিচে নামি। আপনের তবিয়ত শুনলাম ভালো নাই, আপনে আরাম করেন। আমি আছি আপনের খেদমতে। যখন যে দরকার মনে করবেন, অধমরে স্মরণ করবেন। আর বাবা, আমার একটা আবদার যদি রাখতেন...
মধু : বলেন মুরুব্বী, কী কথা।
মহব্বত : অধমের গরীবখানায় যদি একবার আপনের পায়ের ধুলা দিতেন! আমার বিবি-বাচ্চারা আপনেরে দেখনের লাইগা বেচয়ন হইয়া আছে। আসবেন বাবাজি?
মধু : আমি তো কখনও মাটিতে নামি না মুরুব্বী!
মহব্বত : জানতাম বাবা, আপনে রাজী হইবেন না। যাউকগা বাবাজি, আপনারে ত্যাক্ত করনের জন্যে শরমিন্দা! বড়ই শরমিন্দা। এইবার যদি অনুমতি করেন...
(মধু সত্যি সত্যিই বিচলিত হবে। মহব্বত সেটা খেয়াল না করে নেমে যাবে। মধুকে যথেষ্ট চিন্তিত মনে হবে। শাহেদ, চাষী এরা গাছের নিচে জমায়েত হওয়া মানুষদের চলে যেতে বলবে, সবাই একে একে চলে গেলে গাছতলা নির্জন হয়ে যাবে। মহব্বতউল্লাহ্ গাছতলা থেকে বেরিয়ে আসতেই তার সাথে মোহরের দেখা হয়ে যাবে। মোহরের সাথে মহব্বতউল্লাহ্ কথা বলছেন-এই ব্যাপারটা মধু মাচায় বসে বাইনোকুলারে দেখতে পাবে)


দৃশ্য-একুশ/ সময়- দিন
মধুর বাসা


(দুজন মানুষ মধুর পাড়ায় ঘোরাঘুরি করছে। তাদের দেখেই বোঝা যাবে, তারা কাউকে খুঁজছে। তারা এলাকার কিছু মানুষের সাথে কথা বলে কারো সন্ধান চাইবে। কোন একজন তাকে মধুদের বাড়ি দেখিয়ে দেবে। লোকদুটো মধুদের বাড়ির কলিংবেল বাজাবে।)

দৃশ্য-বাইশ/ সময়-দিন
গ্রামের পথ


(মহব্বত আর মোহর কথা বলছে, তাদের কথার মাঝখান থেকে শোনা যাবে)

মহব্বত : বাবা কারো জন্যে দোয়া করেন না। আমার জন্যেও করেন নাই।
মোহর : কেন করেন না? দোয়া-খায়ের না করলে তিনি আবার কেমন পীর?
মহব্বত : এই পীর সেই পীর নারে মা, এর মধ্যে অন্য কিছু আছে। দেইখা মনে হয় না তেমন কিছু বয়স হইছে, কিন্তু বাবার যে জ্ঞান! তোরে কি কমু। আমার এত্তখানি বয়স হয়ে গেল, আমি পর্যন্ত চমকায়ে গেছি!
মোহর : আমারে বাবার কাছে নিয়া যাবেন? তারে একবার দেখতাম!
মহব্বত : (বিষ্মিত) তুই যাবি বাবার কাছে!... আচ্ছা যা, নিয়া যাবো। তোর জন্যে তেনারে খাস দিলে দোয়া করতে বলবো...
মোহর : এই না কইলেন তিনি কারো জন্যে দোয়া করেন না?
মহব্বত : তোর জন্যে করবে মা, তুই হইলি সবের থেকে আলাদা। তোর জন্যে সবার মনে মায়া জন্মায় রে মা...

(মোহর একটুক্ষণ মাথা নিচু করে চুপ করে থাকে, তারপর সলজ্জ ভঙ্গিতে ছুটে চলে যায়। পুরো ব্যাপারটা মাচায় বসে দেখছিলো মধু।



দৃশ্য-তেইশ/ সময়-দিন
মধুর বাসা


(দরজা খুলে মধুর মা বেরিয়ে এসেছেন, তিনি লোকদুটির সাথে কথা বলবেন। লোকদুটোর ভাবভঙ্গি অস্বাভাবিক, যথেষ্ট সন্দেহজনক। তারা যে মধুর ব্যাপারে খোঁজ-খবর করতে এসেছে, সেটা বোঝা যাবে। খোঁজ নিতে এসে তারাই উল্টো জেরার মুখে পড়বে। মা তাদেরকে ভেতরে আসতে বললে তারা প্রত্যাখ্যান করবে এবং দ্রুত চলে যাবে। পুরো দৃশ্যটিতে কোনো সংলাপ শোনা যাবেনা

দৃশ্য-চব্বিশ/ সময়- রাত
বটমূল


(গাছের নিচে গানের আসর বসেছে। চাষী সোহেলদের মধ্যে কেউ একজন গান করছে, তাকে ঘিরে সবাই বসে কিংবা দাঁড়িয়ে গান শুনছে, গানের তালে নাচছে। এর মধ্যে দেখা যাবে ইদ্রিস মেম্বার মাচার ওপর থেকে নেমে আসছে। তাকে দেখে মনে হবে গাইছা বাবা’র সাক্ষাত লাভ করে সে ধন্য হয়ে গেছে! তিনিও গানের দলে যোগ দিবেন, সুযোগ মতো শাহেদ সোহেলদের সাথে কোলাকুলি করবেন। দূরে দাঁড়িয়ে পুরো ব্যাপারটা আলী আর বাক্কার লক্ষ্য করবে। ক্যামেরা গানের আসরের সবার ওপর দিয়ে ঘুরে একসময় টপ শটে চলে যাবে, তখন দেখা যাবে মধু গাছের ওপর একা বসে উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে নিচে তাকিয়ে আছে। মধু অস্থির ভঙ্গিতে ঘন্টা বাজিয়ে সংকেত দিতেই গান থেমে যাবে। গাইছা বাবা’র উপস্থিতি যেন কারো স্মরণ ছিলো না, সবাই তাই হতবিহ্বল হয়ে যাবে। শাহেদ ব্যস্ত হয়ে গাছে উঠতে যাবে, চাষী সবাইকে আবারো গান শুরু করতে বলবে।)


দৃশ্য-পঁচিশ/ সময়-রাত
মোহরের বাসা


(বেড়ার ঘরে মাচার ওপর বিছানা, মা-মেয়ে সেখানে পাশাপাশি শুয়ে। মায়ের ভারি নিঃশ্বাস শোনা যাচ্ছে। মেয়ের চোখে ঘুম নেই। দূর থেকে ভেসে আসছে বাউল গানের সুর, মেয়ে বড় অস্থির। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে একসময় সে নেমে আসে। টিনের ট্রাঙ্ক খুলে বের করে আনে একটা পুরনো হয়ে যাওয়া প্রায় ধূষর ছবি। সস্তার স্টুডিওতে তোলা সেই ছবিতে মোহরের পাশে একজন বোকাসোকা সাধারণ লোকের চেহারা, কূপিবাতির আলোতে সেই চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকে মোহর, জলভরা চোখে। আর তার কানে বাউলগানের সুরকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে দিয়ে বারবার বাজতে থাকে ‘জালাল মিয়া কাল আবার আইবো, তারে কী জবাব দিমু?’-এই অনিবার্য প্রশ্ন! দিশেহারা বোধ করে মোহর। আর ঠিক তখনই শোনা যায় বেড়ার ওপাশ থেকে শিষ দিচ্ছে কেউ! এই শব্দে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে মোহর, দ্রুত কপিটা নিবিয়ে দিতে গিয়ে খেয়াল হয়, এতে করে বাইরের মানুষটার কাছে তার জেগে থাকাটা প্রমাণ হয়ে যাবে। কী করবে বুঝতে পারে না মোহর, স্থানুর মতো বসে থাকে মাটিতে, যেন নড়বার শক্তিটুকুও নেই তার। শিষ তীক্ষ্ণ থেকে তীব্রতর হয়, তার সাথে যোগ হয় চাপা গলায় ‘জাইগা আছিস? বাইরে আয়; তরও ভালা, আমারও ভালা; একলা একলা আর কত থাকবি?’-এই জাতীয় ইঙ্গিতপূর্ণ বাক্য। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায় জরিনার, মোহরের আতঙ্কিত মুখের দিকে তাকিয়ে সব বুঝে ফ্যালে সে। রাতের নিস্তব্ধতাকে তছনছ করে হুঙ্কার দিয়ে ওঠে জরিনা- ‘হারামীর বাচ্চা, ইবলিশের পুত, বেজন্মার দল... আবার আইছোস? খাড়া, আইজ তোরে জন্মের মতো পীরিত শিখায়ে ছাড়ুম। বান্দীর বেটা বেশ্যার পুত...’ উদ্দত বটি হাতে নিয়ে অন্ধকারে ছুট দেয় জরিনা, বাইরের লোকটা তার আগেই ধুপধাপ শব্দ তুলে পালিয়েছে। মা বেরিয়ে যেতেই মোহরের সম্বিত ফিরে আসে, * প্রবল আবেগে কেঁপে কেঁপে ওঠে শরীর, গোঙানীর মতো আওয়াজ আসতে থাকে গলার ভেতর থেকে। অথচ সেই অবস্থাতেই তার কানে আবারও আসতে থাকে- “জালাল মিয়া কাল আবার আইবো, তারে কী জবাব দিমু?”। ঝাপসা চোখে মোহর যেন দেখতে পায় গাইছা বাবার আখড়া, জলভরা চোখে যেন নতুন করে কোন আশার আলো দেখতে পায় সে!)

*(পূর্বে শোনা গানটি মাঝখান থেকে শোনা যাবে, নারী কন্ঠে)


গান:

মাটি আমায় চিনলো নাতো,
চিনলো নারে বায়ূ
মনের আগুন পুড়ায়ে গেল,
ফুরায় গেল আয়ূ


দৃশ্য-ছাব্বিশ/ সময়-রাত
মাচার ওপর


মধু : এইসব তোমরা কী শুরু করলা! আমি যত বলি তোমরা হুড়-হাঙ্গামা কম করবা, ততো আরো খালি ঝামেলা বাড়াইতাছো।
শাহেদ : ঝামেলার তুমি দ্যাখলাটা কী?
মধু : ঝামেলা না তো কী? বাউল ধইরা আইনা আসর করতে কে কইছে?
শাহেদ : ধইরা তো আনি নাই কাউরে! হে ব্যাডায় নিজে থিক্কা খবর পাইয়া আইছে। এরে বিদায় করি ক্যামনে। এইটা তো তোমার শহর না যে, ইচ্ছা হইলো খবর দিয়া শিল্পী আনলাম, ইচ্ছা নাই তো বিদায় কইরা দিলাম। ...তাছাড়া গান গাইলে, আসর হইলে তোমার সমস্যা কী?
মধু : সমস্যা তোমরা বুঝবা না। আমি যত চেষ্টা করি মাইনষের মন থিকা পীর-ফকিরী, ভাগ্যের কেরামতি দূর করতে, তোমরা ততই উঠা পইড়া লাগছো আমারে কামেল পীর বানাইতে।
শাহেদ : নাচতে নাইমা ঘোমটা দেওনের কাম কী? পীর সাজবা, পীরগিরি করবা না- এইটা কেমন কথা? নিজেই কইলা, পাকাপোক্ত প্ল্যান বানাও, যাতে পাবলিক সত্যিকারের পীর ভাবে, অহন আবার উল্টা ফাঁপড় দিতাছো কেন?
মধু : তাই বইলা সহজ সরল মানুষগুলার বিশ্বাস নিয়া খেলবা?
শাহেদ : কারো বিশ্বাস নিয়া খেলনের মতো কিছু তো করি নাই। তুই তো বইসা থাকিস সারাদিন গাছের উপরে। নিচে আমরা যে কেমনে সব সামাল দিতাছি, সেই খেয়াল রাখোস?... সারাদিন লোকে মানতের সিন্নি নিয়া আসে। একজনে আনছে দশ কেজির মতোন চাউল, তার জমির বছরের পয়লা ফসল। আবার ধর, গাছের কলা পেঁপে আমড়া... এইসব ফলমুল, তরি-তরকারি, মাছ-মুরগী, গাভীর দুধ... এমনকি ছাগল পর্যন্ত মানত আনছে। কই, আমরা তো লোভে পইড়া কোনকিছু রাখি নাই? মাইনষে সন্দেহ করে... কয়দিন তুমি ফিরায়ে দিবা?
(মধু নিদারুণ বিচলিত হবে। তাকে অসহায় মনে হবে।)
মধু : এইসব তো আমি ভাবি নাই। আমি ভাবছিলাম গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলারে কাছে থিকা দেখবো। তাদের কাছে তো যাওয়া হইলো না, উল্টা গরীব লোকগুলারে ভাওতা দেওনের যোগাড়!
শাহেদ : এইসব ভাবনের সময় এখন শ্যাষ। সারা জীবন সবাই এদের ঠকাইছে, ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় আমরাও সেই ঠগের দলেই পড়তে লইছি। সুতরাং, আমিও ভন্ড অনেকের মতো, গান দিয়ে ঢাঁকি জীবনের ক্ষত...
(মধুর হত-বিহ্বল দৃষ্টির সামনে দিয়ে শাহেদ গান গাইতে গাইতে নেমে যাবে)



দৃশ্য-সাতাশ/সময়-সকাল
মধুর বাসা


(শাজনীন শেষ পর্যন- মধুর আখড়া খুঁজে পায়নি। এই নিয়ে সে মহা উত্তেজিত। মধু’র মা’র সাথে তার উত্তেজিত বাক্যবিনিময় চলছে, এমন সময় কলিং বেল বাজবে। মা উঠে গিয়ে দরোজা খুলবেন, সেই লোকদুটির একজন। কিন্তু মধুর মাকে দেখে সে দ্রুত চলে যাবে। যেন সে আর কাউকে আশা করেছিল। পেছন থেকে শাজনীন কী হয়েছে মামণি, কে এসেছে?- বলতেই তিনি ঘরে ঢুকে দরোজা লাগিয়ে দেবেন। তারপর শাজনীনকে গতকাল দুপুরের ঘটনাটা বলবেন। শাজনীন যথেষ্ট চিন্তিত হয়ে পড়বে)


দৃশ্য-আঠাশ/ সময়- দিন
মোহরের বাড়ি


(গ্রাম্য কোন ফকিরনী বুড়ি বসে আছে মোহরের বাড়িতে, কথা বলছে মোহরের সাথে। গাইছা বাবার সাথে বুড়ির স্বাক্ষাত হয়েছে এবং তা নিয়ে বুড়ি খুবই উল্লসিত। মোহরকে গাইছা বাবার ব্যাপারে খুব আগ্রহী মনে হবে, যেটা তার মা পছন্দ করবে না)

বুড়ি : বুঝলি বইন, আমারে যে কী খাতিরটা করলো! কইলো আল্লাহ্‌ আপনের ভালো করুক।
মোহর : বাবায় নাকি কারো জন্যে দোয়া-খায়ের করে না?
বুড়ি : মুখ দিয়া দোয়া করে না তো কী হইছে? হের মনের মইধ্যে মাইনষের জন্যে যে মায়া জইমা আছে... হের কাছে আর কিছু লাগে না।
জরিনা : তোমারে খাতির করলো কেমনে? পালঙ্কে বইতে দিছে, নাকি মন্ডা-মিঠাই খাওয়াইছে?
বুড়ি : আমারে মাঁচার উপরে, তার নিজের আসনে তুইলা নিছে, পালঙ্কের থিকা কম কি?... আর মন্ডা-মিঠাইয়ের কথা কস? ভাতের থিকা মিঠা কিছু আছে রে? ...বাবায় নিজের হাতে ভাত বাইড়া খাওয়াইছে।... আইজ কদ্দিন পর দুপুর বেলা খাইলাম রে বইন... (বাস্পরূদ্ধ কণ্ঠে) নিজের পোলারা লাত্থি দিয়া খেদায় দিছে, পরের কাছে চাইয়া খাওন পাই না, ... বাবায় নিজে সাইধা খাওয়াইলো গো বইন... (কাঁদতে কাঁদতে) কদ্দিন পর পেট পুইরা খাইলাম...
জরিনা : (মোহরের উদ্দেশে) বইয়া বইয়া পিরীতের আল্লাহ্‌ শুনলে চলবো? কামে যাওয়া লাগতো না? তোরেও কি গাইছা বাবায় ভাত বাইড়া খাওয়াইবো?
মোহর : যাইতাছি। অমন ঝ্যাং ঝ্যাং কইরা কথা কও কেন?
জরিনা : ওই! চোপা করবি না। মাগির ভাত নাই ভাতার নাই, তাও ত্যাজ কমে না!
(মোহর ধুপধাপ পা ফেলে উঠে চলে যাবে, তাই দেখে বুড়ি একটু সঙ্কুচিত হয়ে পড়বে। তারপর পরিবেশ হালকা করবার ভঙ্গিতে বলবে-)
বুড়ি : পান আছে নি মা? পান দেও গো একখান...
জরিনা : আহ্লাদের সীমা নাই! কেন, তোমারে পালঙ্কে বসাইয়া খাওয়াইছে দাওয়াইছে, মুখে পান ভইরা দেয় নাই! (বুড়ি কিছু একটা বলতে যাবে, জরিনা খেঁকিয়ে উঠবে) দূর হ’! কামের সময় আলগা প্যাঁচাল!
(বুড়ি অতি দ্রুত তার ঝোলা-থালা সব নিয়ে বেরিয়ে যাবে)


দৃশ্য-ঊনত্রিশ/ সময়-দিন
গ্রামের রাস্তা


(আলী এবং বাক্কার নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। তাদেরকে যথেষ্ট উত্তেজিত মনে হবে।)
আলী : কারো ভরসায় থাকলে চলবো না। গ্যারামের মধ্যে যে সে আইসা যা খুশি তাই করবো আর আমরা চাইয়া চাইয়া দেখুম? আমাগো কি কিছুই করনের নাই?
বাক্কার : কী করবি তুই? আমরা কী করবার পারি ক’? বেবাক লোকেই তো গাইছা বাবারে লইয়া মাইতা আছে। আমাগো কথা কে শুনে?
আলী : আজাইরা প্যাচাল বাদ দে। বেবাক লোকে গাইছা বাবার মুরীদ হইতে ছুটতাছে, তো তুই বইসা থাকলি ক্যান? তুই’ও যা, গিয়া হ্যার মুরীদ সাইজা থাক!
বাক্কার : আমি কি তাই কইলাম নাকি? আর তাছাড়া আমি গেইলেই কি আমারে মুরীদ করবো নাকি? হেয় তো কাউরে মুরীদ করে না, এমনকি কোনো দোয়া-খায়েরও করে না। তয় বেটার যে মাথায় বুদ্ধি আছে, এইডা কিন্তু মানতে হইবো। যেই বেডায় হের কাছে যায়, তারেই হেয় কেমনে জানি এক্করে যাদু কইরা ফালায়। ইদ্রিস মেম্বার কত বড় বড় বুলি দিলো, গেরামের মইধ্যে বেশরিয়তী কারবার চলবো না, আমি তারে হেই করুম, হই করুম.... এহন কী দেখলি? হেই ব্যাডায়ও গাইছা পীরের মুরীদ হইবার লাগছে। এহন দেহিস উল্টা হেয় নিজেই কইয়া বেড়াইবো, গাইছা বাবার অন্যরকম ক্ষমতা আছে, হে অনেক বুজরুকী জানে, হে আমাগো জইন্যে রহমত আনছে...!
আলী : রহমত আনছে না কচু আনছে হেইডা সবাই টের পাইবো কয়দিন পর। আমারে তো চিনোস না। এমুন প্যাঁচ দিমু, প্যাঁচ খুলতে খুলতে রহমত ভচকায়ে যাইবো!
বাক্কার : দোস্ত, কোন কিছু করনের আগে চল তারে একবার ভালা কইরা দেইখা আসি। গিয়া তার লগে কথা কই। গেরামের বেবাকে কইতেছে, হের মইধ্যে অন্যরকম কিছু আছে...
আলী : তুই’ও এইগুলা বিশ্বাস করতে লাগছোস?
বাক্কার : বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা তো না। গিয়া দেখতে তো ক্ষতি কিছু নাই।
আলী : চুপ থাক, আমারে জ্ঞান দিসনা।
বাক্কার : আমার উপরে গরম দেখায়া কাম কী? তার থাইকা ভালো, গাইছা বাবার সামনে গিয়া তারে গরম দেখায়া আয়।
আলী : ফোট!
বাক্কার : তুই যাবি তো চল, না গেলে থাক। আমি গেলাম। আমি কাউরে ডরাই না। আমি গেলাম তার আখড়ায়।
(বাক্কার হন হন করে হাঁটতে থাকবে, আলী পেছন থেকে তাকে ডাকতে ডাকতে অনুসরণ করবে)


দৃশ্য-ত্রিশ/ সময়-দিন
বটমূল


(অলস দুপুর, গাছতলায় শাহেদ একা বসে। চাষী ও অন্যরা পাশের চালাঘরে বা অন্য কোথাও আছে। হঠাৎ গাছের নিচে মোহর এসে হাজির হবে। তার চেহারায় উদ্ভ্রান্ত একটা ভঙ্গি থাকবে)

শাহেদ : আপনি কিছু কইবেন?
মোহর : বাবার কাছে আসছিলাম
শাহেদ : বাবা তো এখন আরাম করতেছেন। এই বেলা তার সাথে দেখা হবে না। তাছাড়া তিনি মেয়ে মানুষদের সাথে সাক্ষাত করেন না।
মোহর : আমার ভীষণ বিপদ! বাবার সাথে দেখা করতে চাই
শাহেদ : কী বিপদ?
মোহর : এইটা শুধু বাবারে বলবো। আর কাউরে আমি কইতে পারবো না!
শাহেদ : একবার তো বলেছি বাবা কখনও মেয়েছেলেদের দেখা দেন না।
মোহর : কেন? কেন দেখা দেন না। মেয়েরা কি মানুষ না? তাদের কি বাবার কাছে কিছু চাইবার নাই? তাদের জন্যে বাবার মনে কোনো দয়া নাই!
শাহেদ : আছে। বাবা তাদের কথাও শোনেন, কিন্তু সরাসরি শোনেন না। আমার মাধ্যমে শোনেন। আপনার কী সমস্যা আমারে কন, আমি বাবারে বুঝায়ে বলবো। আপনের কোন চিন্তা নাই, গাইছা বাবা আর আমি ছাড়া কেউ জানবো না।
মোহর : কিন্তু আমি বাবারে ছাড়া আর কাউরে কইতে পারবো না।
(কাট শটে দেখা যাবে মধু ওপর থেকে নিচের পুরো ব্যাপারটা দেখছে। মধু এক পর্যায়ে নেমে আসবে)
শাহেদ : আরে কী মুশকিল! আপনের জন্যে বাবা এখন তার রীতি-রেওয়াজ সব উল্টায়ে ফেলবে নাকি!
মধু : (পেছন থেকে বলবে) সবার আগে মানুষ, মানুষের ভালো-মন্দ, দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-আপদ, তারপরে হইলো তার রীতি-রেওয়াজ, সামাজিকতা। মানুষ যদি না থাকে তো রীতি-রেওয়াজ দিয়ে কী হবে?
(শাহেদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়াবে, মেয়েটি মধুকে কদমবুসি করতে এগিয়ে আসবে। মধু অতি দ্রুত সরে গিয়ে তাকে নিরস্ত করবে)
মধু : (শাহেদকে উদ্দেশ্য করে) সেদিন যেন ডাব এনেছিলে কোথা থেকে? খুঁজলে হয়তো আজকেও পাওয়া যাবে।
(শাহেদ ইশারাটা ধরতে পেরে বিনীতভাবে সরে যাবে, ক্যামেরা শাহেদের সাথে সাথে ট্র্যাক ব্যাক করবে)
মধু : আপনি আমার কাছে কী চান?
মোহর : কিছু চাই না! জ্বে ... না মানে...
মধু : (মৃদু হেসে) আপনি কি আমাকে চেনেন?
মোহর : জ্বে চিনি, আপনি গাইছা বাবা...
মধু : (কিছুক্ষণ নিরবে তাকিয়ে থাকার পর) আপনার নাম কী?
মোহর : (ইতস্তত) মোহর... আমার নাম মোহর
মধু : আপনার নামটা সুন্দর, মোহর। (হঠাৎ প্রশ্ন করবে) আপনার বিপদটা কী?
মোহর : (আচমকা প্রশ্নে মোহর একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাবে) কোন্ বিপদ?
মধু : আপনি বললেন না, আপনার ভীষণ বিপদ! আপনার কী হয়েছে?
মোহর : (কিছুক্ষণ বলবে কি বলবেনা এই দোটানায় থাকবে, মধুর দিকে তাকালে মধু তাকে অভয় দেয়ার মতো করে হাসবে) আমার কোন বিপদ নাই। এই কথা না বললে তারা আমারে আপনের সাথে দেখা করতে দিতো না, কথা বলতে দিতো না। ... আমি চাতুরী করেছি, মিথ্যা বলেছি, মাফ কইরা দেন।
(মধু একই সাথে এই মেয়েটির সরলতা এবং বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ হবে)
মধু : আমার সাথে দেখা করবার জন্যে আপনি চাতুরী করলেন... কিন্তু কেন? আমার সাথে কী এমন কথা...!
মোহর : (কিছুটা ইতস্তত করে) আপনের সাথে কথা বললে মনে শান্তি হয়। এইজন্যে আসছি।
মধু : (অনাবিল হাসবে) খুব অদ্ভুত কথা বললেন তো আপনি! (নিজের মনেই বলবে) আমার সাথে কথা বললে মনে শান্তি হয়... আমি কি বিশেষ কিছু বলি? অন্যরকম কিছু!
মোহর : আমি জানি না। মহব্বত চাচা বলেছেন। তিনি কোনদিন কাউরে মিথ্যা বলেন নাই। তিনি মিথ্যা বলতে জানেন না।... আরো মাইনষে বলছে...
মধু : আপনার মনে কি শান্তি হয়েছে?
মোহর : জানি না...।
মধু : আপনার মনে এত কী অশান্তি? (মোহর চমকে তাকাবে, তার চোখে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়। মধু একদৃষ্টে চেয়ে থাকবে তার চোখের দিকে, হঠাৎ করে সে যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলবে) বড় অস্থির আপনার মন! আপনার চোখে সন্দেহ, তার পাশেই ভয়! অথচ, তার ঠিক পেছনেই দেখতে পাচ্ছি... মায়া... সুগভীর মায়া... কার জন্যে? ...কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে... (মোহর পুরোপুরি অপ্রস্তুত হয়ে পড়বে, মধুর কথাবার্তার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারবে না। সে কিছু বলার আগেই মধু বলে উঠবে)
: আপনি আমার কাছে কী চান?
মোহর : (চমকে যাবে, কিছুটা সঙ্কুচিত হয়ে পড়বে) জানি না! আমি কিছু জানি না... কিচ্ছু চাই না...
মধু : (নিরতিশয় চিন্তিত) তাহলে কেন এসছেন?
মোহর : জ্বে আর আসবো না।
মধু : (প্রশ্রয়ের হাসি হেসে) কেনো আসবেন না, আপনার ইচ্ছা হলে আপনি নিশ্চয়ই আসবেন। কিন্তু কেনো আসছেন, সেটা বুঝে-শুনে আসলে ভালো হয় না? ... বেশির ভাগ সময়েই আমরা যা করি তা না বুঝে করি। এইজন্যেই আমাদের এত সমস্যা হয়, ঝামেলা বাড়ে, কষ্ট বাড়ে...
মোহর : আমি যাই। আপনেরে কষ্ট দিয়েছি, মাফ কইরা দিবেন!
মধু : আপনি আমার কাছে দুইবার মাফ চেয়েছেন। আমি যেমন কারো জন্যে দোয়া করি না, তেমনি কারো ওপর রাগও করি না, দুঃখ পাই না। কিন্তু এখন আমার মনে হইতেছে, আমি নিজেই আপনার মনে দুঃখ দিয়েছি। ... আপনি কি আবার আসবেন? (মোহর নিরুত্তর) আপনি যদি আবার না আসেন, তাহলে ভাববো, আপনিই আমারে মাফ করেন নাই!
(মোহর হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবে। সে ঠিক মেলাতে পারছে না এই মানুষটাকে। তার অভিব্যক্তিতে মনে হবে, শান্তির আশায় এ মানুষটার কাছে এসে সে ভুল করেছে। কেননা, এ মানুষটা তার মনে নতুন ধরনের অশান্তির বীজ বপন করে দিলো! সে যেমন হঠাৎ এসেছিলো, তেমনি হঠাৎ চলে যাবে। মধু তাকিয়ে থাকবে তার গমনপথের দিকে, ব্যাকগ্রাউন্ডে আবার গানটি শোনা যাবে)

সোনারে মোর জন্ম বৃথা
ফান্দে পইড়া আছি
ঘুম-জাগনে ঘোর লাইগা যায়
কেমন কইরা বাঁচি...


(হঠাৎ পেছন থেকে শাহেদ এসে মধুর পিঠে থাবা দিবে)
শাহেদ : ঘটনাটা কী বস? আমারে ডাব লইতে পাঠায়া চামে চামে... হেভি জোস্...?
মধু : আরে ধুর, কী কও এই সব...
শাহেদ : হ’ আমাগো কথা তো এহন আজাইরা প্যাচাল মনে হইবো। যাইতে দিলা কেন? ... ওই সোহেল... কী বস্, ধইরা আনুম নাকি..?
মধু : কী শুরু করলা এইসব! ... একটা মানুষ বিপদে পইড়া আইছে...
সোহেল : বিপদ না ঘোড়ার আন্ডা। আমি কিছু শুনি নাই ভাবছো? আমি তো গাছের ওই পারে... আপনের সাথে চাতুরী করেছি, মিথ্যা বলেছি, মাফ কইরা দেন... (মধু ভীষণ বিব্রত হয়ে যাবে, সোহেলের উদ্দেশ্যে তেড়ে যাবে, সোহেল শাহেদের পিছনে লুকাবে)
শাহেদ : তয় বস, মাইয়াটা কিন্তু জোশ! খবর লমু, বাড়ি কই..?
মধু : আল্লাহর দোহাই শাহেদ ভাই, তুমি এইসবের মধ্যে ঢুকতে আইসো না। তোমার খাইসলত আমার জানা আছে...
সোহেল : বাদ দেন শাহেদ ভাই, গাইছা বাবা ফার্স্ট বুক!
মধু : সোহেল, তোরে যে কি করুম না!


দৃশ্য-একত্রিশ/ সময়- দিন
বটমূল


(গাছের নিচে সবাই বিভিন্ন ভঙ্গিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। তাদের বসে থাকার মধ্যে একটা অস্থির কিংবা কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাব লক্ষ্যণীয়। মধু মাচার উপরে আছে, কোনো কারণে সে কিছুটা বিচলিত। কারো সাথে কথা বলছে না। অন্যরা কী করবে ভেবে পাচ্ছেনা। তারা গাছের নিচে আসবে, উপরে তাকাবে, উঠতে চাইবে আবার কী মনে করে নিজের জায়গায় ফেরত আসবে। এদের মধ্যে সবচে’ বিচলিত দেখাবে মহব্বতউল্লাহ্‌কে। তিনি ভেবে পাচ্ছেন না গাইছা বাবা হঠাৎ করে এমন গুম হয়ে গেলেন কেন, কেন তিনি কাউকে দর্শন দিচ্ছেন না। এই বিষয়ে তিনি শাহেদ বা সোহেলদের সাথে পরামর্শ করতে চাইবেন, কিন্তু তারা কোনো প্রকার আগ্রহ দেখাবে না, কেউ কেউ অনত্র সরে বসবে। এই পরিস্থিতিতে বাক্কার সেখানে উপস্থিত হবে, তার পেছনে আলী।)

আলী : ব্যাপারটা কী, এইখানে আবার নতুন কইরা কোন্ নাটক চলতেছে? করো মুখে কোনো কথা নাই, গাইছা বাবা কি এইবার কথা কওনের উপর ফতোয়া দিছে নাকি?
চাষী : আপনের যা কওনের ভদ্রভাবে কন। এমন ত্যাড়াব্যাকা কথা কইতেছেন কেন?
বাক্কার : কথা তো আপনেও ত্যাড়া কইরাই কইলেন। তা আপনেরে ভদ্রভাবে কতা কওনডা শিখাইবো কেডায়, কন দেহি?
(চাষী ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উত্তর দিতে যেতেই শাহেদ তাকে সরিয়ে সামনে আসবে।)
শাহেদ : ঝামেলা বাড়াইতেছেন কেন ভাই? আপনেদের যদি কিছু কওনের থাকে আমারে বলেন। আমি বাবার খাস খাদেম। ওর কথা ধইরেন না, ওর মেজাজটা একটু বিগড়ায়ে আছে।
আলী : (মারমুখী ভঙ্গিতে চাষীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শাহেদের কথার জবাব দেবে) হের মেজাজ ধুইয়া পানি খাওনের টাইম নাই। হেরে কন, এইডা আমাগো গেরাম। এইহানে গাইছা বাবা তো দূরের কথা, গাছের পক্ষি পর্যন্ত আমাগো কথায় উঠে বসে। আর আপনের গাইছা বাবারে খবর দেন। কন যে গাইছা দাদায় আইছে, পোলায় আমার এই কয়দিনে কামাই-ধান্দা কেমুন করলো তার হিসাব-কিতাব রেডি করেন। টাইম নাই।
শাহেদ : আপনি শুধু উল্টা-পাল্টা কথা বলতেছেন কেন? গাইছা বাবা এইরকম মানুষ না। তিনি কখনো কাউরে কোনো তাবিজ-কবচ, ফুঁ-ফাঁ দেন না।
আলী : আজাইড়া প্যাচাল বাদ। বেডারে নিচে নাইমা আইতে কন। বান্দরের লাহান গাছে বইয়া থাকবো কয়দিন?
(মহব্বত এদেরকে কিঞ্চিত ভয় পান, তাই এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। কিন্তু এবার আর চুপ থাকতে পারবেন না, প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে উঠবেন...)
মহব্বত : ইতর পোলাপান! বাদাইম্ম্যার দল, অশিক্ষিত, মূর্খ, বেয়াদ্দপ, জানোয়ার...! মানী লোকেরে সম্মান দিতে জানোস না, তোরা বংশের কুলাঙ্গার! কারে লইয়া তোরা কথা কস জানোস? বেহুদ্দার দল! আল্লাহ্‌র গজব পড়বো তগো উপরে... ছোটলোকের বাচ্চা... ইবলিশের নাতি...
(আচমকা এমন প্রবল আক্রমণে আলী, বাক্কার দুজনেই ভীষণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাবে। শাহেদ, সোহেল, এমনকি চাষীও চেষ্টা করবে মহব্বতকে শান্ত করতে, কিন্তু তার চিৎকার থামানো যাবে না। রাগে অন্ধ মহব্বতের কথা জড়িয়ে যেতে থাকবে, চার পাঁচজনে তাকে ধরে রাখতে পারে না এমন অবস্থা! হঠাৎ দেখা যাবে গাইছা বাবা সবার অলক্ষ্যে তাদের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাকে দেখে মহব্বত অনেকটা সামলে নেবেন। মধু কথা বলবে খুবই শান্ত স্বরে, তাকে সব সময়েই মুচকি হাসতে দেখা যাবে। তার কথা বলবার ধরণে আলী এবং বাক্কার সম্পূর্ণরূপে কনফিউজড্ হয়ে যাবে।)
মধু : মুরুব্বী, আপনি উত্তেজিত হবেন না। আমার কথা শোনেন। মানুষরে গালাগাল করলে তার সংশোধন হয়না, বরং দরকার তার ভুলটা তারে সহজ করে বুঝায়ে দেয়া, যাতে সেইটা সে দ্বিতীয়বার না করে। গালাগাল করলে উল্টা তারে ঐ ভুলটা করবার জন্যে প্রশ্রয় দেয়া হয়।
মহব্বত : বাবা আমি বড়ই শরমিন্দা। আমার মাথার ঠিক ছিলো না। কিন্তু বাবা খালি আমার দোষটাই দেখলেন? দুইদিনের পুইচকা ছ্যামড়া ... হেরা আপনারে কেমুন অপমানডা করলো...
মধু : মুরুব্বী একটা কথা বলি, বিচার করে দেখেন। আমি যখন কাউরে গালি দিবো, মানুষে কিন্তু আমার দোষটাই দেখবো, কারণ মন্দ কথাগুলো বার হইতেছে আমারই মুখ দিয়া।
(আলী ও বাক্কার পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করবে। মধু তাদের দিকে তাকিয়ে অমায়িক হাসবে। তার হাসি দেখে আলী-বাক্কার’রা আরো বেশি কনফিউজড্ হয়ে যাবে।)
মধু : আপনেরা তো আমার কাছে এসেছেন, ঠিক না? আপনেরা কি আমার ওপর কোন কারণে রাগান্বিত? কী যেন বলতেছিলেন, কামাই-ধান্দার হিসাব নিবেন... আমি তো দিবার জন্যে তৈরী, এখন আপনেরা তা নিতে পারলে হয়।
আলী : কী কইবেন সাফ সাফ কন, এমন প্যাঁচ দিয়া কথা বলা কি আপনেদের সকলের অভ্যাস?
মধু : (কিছু একটা বলতে গিয়ে সামলে নেবে) আচ্ছা থাক, চলেন উপরে গিয়া বসি।
বাক্কার : যা বলার এইখানেই বলেন। উপরে যাওনের কাম কী?
মধু : আমি তো আপনেদের কিছু বলতে ডাকি নাই। আপনেরাই এসেছেন নিজের থেকে। তাই বলে যে আমি জোর করবো, তাও অবশ্য হয় না। তবে কি, ওপর থেকে দেখলে পরে অনেক কিছু পরিস্কার দেখা যায়। অবশ্য কেউ যদি চোখ বন্ধ করে রাখতে চায়, তাহলে ভিন্ন কথা।
(মধু মাঁচায় ওঠার মইয়ের দিকে এগিয়ে যাবে, আলী-বাক্কার পুতুলের মতো তাকে অনুসরণ করবে)

দৃশ্য-বত্রিশ/ সময়-দিন
মাচার ওপর


(আগের দৃশ্যের কন্টিনিউয়েশন। মধু মাচার ওপর থেকে নিচে অনেক দূরে কিছু একটা দেখছে আলী ও বাক্কার একদৃষ্টে মধুকে লক্ষ্য করছে। হঠাৎ মধু তাদেরকে ইশারায় দূরে দেখতে বলবে)

মধু : ঐযে দূরে খালের ধারে দেখেন। ছেলেটারে দেখেছেন? ছেলেটা গতকালকেও সাঁতার জানতো না। কিন্তু এখন সে সাঁতার দিয়ে গভীর পানি থেকে শাপলা-শালুক, পানিফল এইসব তুলে আনতে পারে।
আলী : (কিছু বুঝতে না পেরে) এইসব আমাদের কইতেছেন কেন?
মধু : ছেলেটা সাঁতার শিখলো কেমন করে জানেন? ...গতকাল সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত সে তার বোনকে সাথে নিয়ে শাপলা তুলতে চেষ্টা করেছে, পারে নাই। অতদূর হাত যায় না। আজ সকালেও সেই চেষ্টা করতেছিলো, করতে করতে পড়ে গেল পানিতে। আমি ওপর থেকে তাকায়ে দেখলাম, তার বোনটা তারে বাঁচানোর জন্যে চিৎকার করলো, কেউ আসলো না। প্রথম কিছুক্ষণ ছেলেটা লাফ-ঝাপ করে পাড়ে উঠবার চেষ্টা করলো। তারপর যখন দেখলো পারতেছে না, তখন সে পাড়ে উঠবার আশা ছেড়ে উল্টা দিকে যাওয়া শুরু করলো। কেন জানেন?
বাক্কার : কেন?
মধু : তারা কালকে থেকে কিছুই খায় নাই। সাঁতার জানে না, তার পরও শালুক তুলতে এসেছিলো পেটের দায়ে, দুইটা শালুক তুলতে পারলে পেটটা ভরাতে পারে। যখন দেখলো ডুবে যাচ্ছে, আর বাঁচার আশা নাই, তখন সে মনে মনে ঠিক করলো, ডুইবা যাওনের আগে অন্তত কয়টা শালুক তুলতে হবে। এমনি এমনি মরার থেকে শালুক কয়টা তুলে দিতে পরলে বোনটার তো পেট ভরে...!
(আলী ও বাক্কারকে মনে হচ্ছে অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছে। তাদের বিহ্বল অবস্থার মধ্যেই মধু কথা বলে চলেছে।)
মধু : দুনিয়াতে মানুষের অনেক রকমের কষ্ট। কিন্তু সেইসব কষ্টের সবটা দূর করবার দায়িত্ব আল্লাহ্‌পাক নিজে নেননা। সব যদি আল্লাহ্‌পাক নিজেই করবেন, তো মানুষকে কেন আশরাফুল মখলুকাত বানানো হইলো বলেন? ...দুনিয়াতে মানুষের কাজ-কর্ম কিন্তু কম না, ভাইসাহেব। এর ওর পেছনে লাইগা খুব কি ফায়দা, বলেন? তার চাইতে সামনে থাইকা তাদের জন্যে কিছু করেন, সেইটা হইলো ধর্ম।


দৃশ্য-তেত্রিশ/ সময়-রাত
মোহরের বাড়ী


(কূপিবাতির আলোয় মোহর কেশচর্চা করছে, মা ঘরে ঢুকবে। মেয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পাশে গিয়ে বসবে। তার কথা বলবার ধরণে কিছুটা আন্তরিকতা প্রকাশ পাবে, তবে মোহর বুঝতে পারবে, মায়ের অন্য কোন পরিকল্পনা আছে। তাই তাকে যথেষ্ট সাবধানী দেখাবে)

জরিনা : বাক্কারটারে নিয়া কী যে করি! কাম-কাজের মুরাদ নাই, সারাটা দিন আলীর পিছে পিছে জোঁকের মতন লাইগা থাকে। আলী হইছে তার পীর আর হে তার মুরীদ।
মোহর : (নিরব)
জরিনা : এমনে কইরা কয়দিন চলবো, ক’? ... আইজ বাদে কাইল তোর বিয়া হইলে তুই তো চইলা যাবি, আমি একলা ওরে নিয়া কী যে করি!
মোহর : (চমকে তাকাবে, তাকিয়েই থাকবে, যেন মায়ের এত আন-রিক ব্যবহারের কারণটা সে ধরতে পারছে) আমার বিয়া ছাড়া তোমার ভাবনের আর কিছু নাই? আমি কি...
জরিনা : তুই কী কইবি আমি জানি। কিন্তু আমি কী করুম ক’? আমি মা হইয়া তোরে এমন থাকতে দেখি কেমনে? ... তোর বাপেও তো গেছিলো দশদিনের কথা কইয়া; দশ বছর হইয়া গেল, ফিরোনের নাম করে না। আর ফিরবো না। পুরুষগুলা এইরমই হয় রে মা...!
মোহর : হে ফিরা আইবো! হে না আইসা পারে না। মা, মাগো! আমি তো আশা ছাড়ি না, তোমরা কেন আমারে...
জরিনা : কেন যে করি, মা হইলে বুঝতি! দুনিয়াটা এত সহজ না রে মা। ...জালাল মিয়া লোক তো খারাপ না, অনেক ট্যাকা আছে, তোরে অনেক ভালা রাখবো...
মোহর : হ’, আগের দুইটারে তো ভালা রাখছেই!
জরিনা : (হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে পড়বে) তোর ইচ্ছাটা কী, ক’ দেহি? সারা জীবন এমনই থাকবি? তোর কারণে গেরামে মুখ থাকলো না। নানান জনে নানান কয়। কইবোই তো। জোয়ান মাইয়ারে স্বামী ফালাইয়া যায় কেন...? হের বাড়ির পাশে রাইত বিরাইতে বেহুদ্দা মরদগুলা ঘুরঘুর করে কেন?... লোকে তো কথা কইবোই! মরণ আমার!
মোহর : এক প্যাচাল আর কয়দিন পাড়বা? আমি তোমার খাই না পরি? নিজের গতর খাটাইয়া চলি। ... আমি বিয়া করুম না, করুম না! আমারে জোর কইরো না কইলাম!
জরিনা : ডর দেহাস? কিয়ের ডর দেহাস? তোর ডরের আমি খ্যাতা পুড়ি! কী করবি তুই? কিয়ের ডর দেহাস?
মোহর : ডর দেহাই না, সত্য কথা কই! ফের যদি আমার বিয়া নিয়া যন্ত্রণা করো, আমি গলায় ফাঁস দিবো!
(মোহরের বলার ভঙ্গিতে এমন কিছু ছিলো, জরিনা নিরতিশয় ভয় পেয়ে যাবে। সে আর কথা বাড়াবে না, তার বিস্ফোরিত চোখের সামনে দিয়ে মোহর ঘর থেকে বেরিয়ে চলে যাবে)


দৃশ্য-চৌঁত্রিশ/ সময়- রাত
বটতলা


(মধু, শাহেদ, চাষী, সোহেল, সবুজ জাহিদ সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছে। আড্ডায় শাহেদের ভুমিকাই সবচে উজ্জ্বল। সে একের পর এক তার বিভিন্ন বীরত্বের কাহিনী বলে চলেছে, চাষী সোহেলরা তার মধ্যে ফাঁক-ফোকর বের করছে বা বিভিন্ন সরস টিপ্পনী কাটছে। মধু কিছুটা গম্ভীর। এক পর্যায়ে তাদের আক্রমণ মধুর প্রতি হতেই সে সজাগ হবে)

শাহেদ : তোরা বিশ্বাস করতেছিস না, তাইতো? আমার ফোনে চার্জ ফুরায় গেছে, নাইলে কথা বলায় দিতাম।
জাহিদ : চার্জ তো ফুরাবোই, এক লগে কয়টার সাথে ঝুলতাছো খেয়াল আছে?
শাহেদ : বেটে তুমভি শিখ্ যাওগে...
চাষী : আচ্ছা শাহেদ ভাই, তোমার ফাঁপড় লাগে না? এই যে এক তালে চাপা ঝাইড়া যাও, আইজকা এক জনারে অড্রে হেপবার্নের কথা কইয়া পট্টি লাগাও, কাইল শোনাও শেক্সপিয়রের কবিতা... আমি হইলে কবে প্যাঁচ লাগাইয়া ছ্যাড়াবেড়া কইরা ফালাইতাম...
সোহেল : আহা! বাবু সোনা, দুদু খাইবো! এ- চাষীরে ফিডার দে...!
চাষী : দেখ্ সোহেল, আমার সাথে লাগতে আসিস না কইলাম। আমি কারো সাথে নাই পাছেও নাই।
জাহিদ : সাথে পাছে থাকবো কি, হে তো আছে ভিতরে... (সুর করে গাইবে) চাষীর অন্তরায়/ চাষীর কলিজায় ...
চাষী : জাহিদ রে! (মারতে যেয়ে মধুর গায়ে জোরে ধাক্কা দিবে, মধু ভিষণ বিরক্ত হবে)
মধু : আহ! কী শুরু করলি তোরা...!
শাহেদ : কি গো বাউলা ভাই, তোমার হইলো কী? এমন ঝিম ধইরা আছো, কার চিন্তায়...?
সোহেল : চিন্তা আর পাইবো কই? বাবার ধ্যান-ধান্দা সব তো এখন একই দিকে! ...
মধু : সোহেল! সব সময় ফাইজলামী ভাল লাগে না।
চাষী : হইছে টা কী, কইবা তো?
সোহেল : (মোহরকে নকল করে) এইটা শুধু তারে বলবো!
মধু : (খুব জোরে চিৎকার করে উঠবে) কইলাম না ফাইজলামী করিস না!
(আচমকা মধুর এমন আচরণে সবাই হতবাক হয়ে যাবে, আড্ডার স্বাভাবিক ছন্দটা হারিয়ে যাবে। মধু কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে থেকে এক সময় উঠে গিয়ে মাচায় উঠবে। সবাই যে যার মতো উঠে চলে যাবে)


দৃশ্য-পঁয়ত্রিশ/ সময়- রাত
মাঁচার উপর


(মধু মাঁচার উপরে উঠেই দারুণভাবে নাড়া খাবে। বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে দেখবে, মাঁচার উপর মোহর বসে আছে। মোহরকে দেখে মনে হবে, সে যেন নিজের মধ্যে নেই! কেমন অস্বাভাবিক, ফাঁকা, শূণ্য দৃষ্টিতে সে চেয়ে আছে। মধু তার সামনে, কিন্তু মনে হয় না সে তাকে দেখতে পাচ্ছে)

মধু : তুমি এইখানে এত রাইতে! একেবারে মাঁচার উপরে আসলা কেমনে?
মোহর : মই দিয়া উঠছি।
মধু : সেইটা তো দেখতেই পাইতেছি...
মোহর : (নিজের মনেই বলতে থাকবে) মই ছাড়াও উঠতে পারতাম। এই গাছে আমি অনেক উঠছি...
মধু : তাই বলে এত রাইতে...
মোহর : এইটা আমার গাছ, আমাদের দুইজনার...
মধু : দুইজনার মানে? আরেক জন কে...?
মোহর : সে আমার ছায়া, আমার আপনার লোক। আমার সবকিছু তার জন্যে। আমার খুশি, আমার আনন্দ, আমার চোক্ষের পানি... আমার দিন-রাইত, বাঁচা-মরা, সব তারই জন্য...
(এই অংশ হতে ফ্লাশব্যাকে দেখা যাবে নয়-দশ বছর বয়সী দুটো ছেলেমেয়ে হাত ধরা ধরি করে খেলছে, গাছে ঢিল দিয়ে বরই পাড়ছে, কাশবনের ভিতর দিয়ে ছুটাছুটি করছে, বটগাছের ডালে দোলনা বেঁধে দোল খাচ্ছে...এরকম বেশ কিছু আনন্দময় দৃশ্য)
মধু : (মোহরের বলার ভঙ্গিতে বিহ্বল হয়ে পড়বে, নানান রকম চিন্তার রেখা তার চেহারায় খেলা করবে) কী নাম তার?
মোহর : তার সাথে আমার পরিচয় কবে জানি না। তারে যখন থেকে মনে করতে পারি, তার আগে থেকে আর কাউরেই মনে করতে পারি না। আমরা এক সাথে খেলতাম, সারাদিন ছুটাছুটি হাসাহাসি... ঐ দূ-রে... অনেক দূরে নদীর ধারে কাশবন, সেইটা ছিলো তার। আমি তারে দিছিলাম। তার বদলে সে আমারে দিছিলো এই বট গাছ। আমরা এই গাছে বাসা বাইন্ধা সংসার করবো ঠিক করেছিলাম।...
মধু : তারপর?
মোহর : এইটা শুইনা বাক্কার ভাইয়ের কী হাসি! ... আমি তারে সব কথা বলতাম। সে’ই তো মায়ের কাছে বিয়ার কথা পাড়লো। মায়ে বিয়া দিবো না। কয়, আমরাই খাইতে পাইনা, ধইরা আনছে আরেক ফকিরের পোলা। কেউ চায় নাই, খালি ভাই আমার কথা শুনছিলো... তার জন্যেই বিয়াটা হইলো...
মধু : (এই মেয়েটি বিবাহিত জেনে খানিকটা নিরাশ হবে, সেই নৈরাশ্য সে লুকাতে পারবে না) সে এখন কোথায়?
মোহর : জানি না! ... তিন বছর আগে কামের ধান্দায় ঢাকা শহরে গেছিলো, এরকম যাইতো মাঝে মইধ্যে। দশ-বিশ দিন পর ফিরা আসতো।... এইবার আইলো না।
মধু : বলেন কি! একটা মানুষ তিন বছর ধরে নিরুদ্দেশ!
মোহর : জ্বে, নিরুদ্দেশ! তার কোন খোঁজ নাই। কেউ খোঁজ করে না। বাক্কার ভাই একবার গেছিলো শহরে, কোন খোঁজ পায় নাই। আলী তারে আর খুঁজতে না করছে,... আর যায় না!
মধু : আশ্চর্য্য ব্যাপার। একটা মানুষ তিন বছর নিরুদ্দেশ, অথচ তার খোঁজ কেউ করে না?
মোহর : আমার বাপেও নিরুদ্দেশ দশ বছরের উপরে! তারেও কেউ খোঁজ করে না। ...
(মধু ভিষণ উদ্বিগ্ন মুখে বসে থাকবে, হঠাৎ মোহর খুব আশান্বিত হয়ে তার দিকে তাকাবে)
: আপনে তারে খুঁইজা দেন, আপনেরে আল্লাহর দোহাই!
মধু : কী বলছেন আপনি! আমি তাকে কীভাবে খুঁজে বের করবো?
মোহর : আপনে চাইলে পারবেন। আপনি কাউরে কোন তাবিজ-কবজ দেন না, কারো জন্যে দোয়া-খায়ের করেন না, জানি। কিন্তু আমার জন্যে করেন। আমারে দয়া করেন!
মধু : কিন্তু তা কি করে সম্ভব! আমি কীভাবে তাকে খুঁজে দিবো!... মানে আমি...
মোহর : আমি জানি না, আপনে কেমনে পারবেন। কিন্তু তারে খুঁইজা না পাইলে আমার বড় বিপদ! তারে আমার পাইতেই হইবো...
মধু : আপনি তাহলে সেদিন মিথ্যা বলেন নাই...
মোহর : আমি সেইদিনও আপনেরে বলতে নিছিলাম, কিন্তু সাহস কইরা বলতে পারি নাই।
মধু : আজ তাহলে এত সাহস পেলেন কোথায় যে, এত রাতে একা একা এইখানে চলে এসেছেন?
মোহর : মায়ে আমার বিয়া ঠিক করছে। জালাল মিয়া আমারে বিয়া করণের লাইগা রোজ ঘুরতাছে... মায়ে কী করবো, এলাকার সবেতেই চেষ্টা নিতেছে কেমনে আমারে জালাল মিয়ার ঘরে ঢুকাইতে পারে।
মধু : কিন্তু এলাকার লোকের স্বার্থ কী...?
মোহর : জালাল মিয়া সুদের কারবারী। পুরা গেরাম তার খাতায় বান্ধা। আমার মায়েও বান্ধা!
মধু : আপনি তো আমাকে চিন্তায় ফেলে দিলেন!
মোহর : আপনে চাইলে হইবো। সে ফিরা আইবো... আপনের এত এত ক্ষেমতা..!
মধু : আমার কোনই ক্ষমতা নেই! ...আমি আপনাদের মিথ্যা বলেছি, জটা ধরে আলখেল্লা পরে ভেক ধরেছি। আমি কোন পীর আউলিয়া না। আমার কোন সাধ্য নেই আপনার স্বামীকে ফিরিয়ে আনার...
(মোহর ভয়ঙ্করভাবে নাড়া খেয়ে যাবে, সে যেন ভাবতেই পারছে না মধু কী বলছে। তার বিধ্বস্ত চেহারায় আশাভঙ্গের নিদারুণ কষ্ট। মধু কোনো কথা বলতে পারবে না। তবে তার মধ্যে পাপ স্বীকারের যে প্রশান্তি, তা ফুটে উঠতে দেখা যাবে। মোহর অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে এক সময় মুখ তুলবে, তার চোখে পানি)
মোহর : এই গেরামের ব্যাবাক লোকে বলে, আপনের কাছে আইলে তারার মনে শান্তি ফিরা আসে। আমি নিজে আপনের কাছে আইসা, কথা বইলা দেখছি, তারার কথা সত্য। আপনি গেরামের ব্যাবাক লোকের শান্তি ফিরায় দিছেন; আমার শান্তি ফিরায়ে দেন। আমার স্বামীরে ফিরায় দেন!
মধু : (বেশ কিছুক্ষণ নিরব থেকে) আপনার স্বামীর কোন ছবি আছে?
মোহর : (খুব আশাবাদী চোখে তাকাবে) আছে।
মধু : আপনি আজই আমাকে ছবিটা দিবেন, আর নাম ঠিকানা লিখে দিবেন। আমি কোন কথা দিতে পারছিনা, তবে আমি চেষ্টা করে দেখবো। (নিচের দিকে তাকিয়ে ডাক দিবে সোহেল- বলে, সোহেল আওয়াজ দিতেই মোহরকে বলবে-)
: সোহেল আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে, ওর হাতে ছবিটা দিয়ে দিবেন।
(সোহেল মাচায় উঠে এলেই দৃশ্য শেষ হয়ে যাবে)


দৃশ্য-ছত্রিশ/ সময়-দিন
নদীর পার


(বাক্কার চুপচাপ বসে ছিলো, আলী সেখানে বেশ ব্যস্ত ভঙ্গিতে এসে উপস্থিত হবে, তাকে কিছুটা আনন্দিত মনে হবে)

আলী : খবর হুনছোস? মহব্বতউল্লাহর মাইয়া তো ভাইগা গেছে!
বাক্কার : কস কী? কেমনে, কখন? বড়টা না ছোটটা...?
আলী : আরে ছোটটা...
বাক্কার : কস কী!... কার লগে?
আলী : (হাসতে হাসতে) কার লগে আবার, মজিবরের লগে। ... ছেমড়ি ভাগনের জন্যে আর মরদ পাইলো না!
বাক্কার : মজিবর? হায় হায়, এই পোলার লগে!
আলী : মহব্বতের মাইয়া যে ভাইগা যাইবো, এইটা আমি আগেই জানতাম। ...আরে, সারাদিন বৌ-বাচ্চা ফালাইয়া গাছতলায় বইসা থাকবো, হের মাইয়া ভাগবো না তো কী?
বাক্কার : নারে, লোকটা একটু বোকা কিসিমের, পীর-ফকিরের পিছে পিছে ঘুইরা শান্তি পায়, কিন্তু মানুষটা ভালো। এইরম লোকের এই বিপদ..
আলী : বিপদ আবার কী? বিয়া তো দেওনই লাগতো, ভাইগা গেছে, ভালো করছে। বাপের আশায় বইসা থাকলে জিন্দেগীতে আর বিয়া করা লাগতো না।
বাক্কার : বড়টার তো আর বিয়া হইবো না...
আলী : ওইটা এমনেতেই হইতো না, টাইম শ্যাষ!
(আলী অশ্লিলভাবে হাসতে থাকবে, বাক্কারের মন খারাপ হবে)
বাক্কার : এইরম কইরা হাসিস না। মাইনষের বেকায়দা নিয়া হাসাহাসি করনডা কোনো ভালা মাইনষের কাজ না।
আলী : হ’, তোমার তো খারাপ লাগবোই। তুমি নিজে আছো বেকায়দায়, তোমার আদরের বইন আছে বেকায়দায়...
বাক্কার : আমার বইনেরে আবার এর মইধ্যে টানিস কেন?
আলী : টানাটানি তো আমি করি না, টানে তারে গাইছা বাবা।
বাক্কার : কী কইবার চাস?
আলী : কইবার চাইনা কিছুই, তয় তোর বইনরে যে গাইছা বাবার আখড়ায় দেখা যায়, এইডা তোরে জানাইতে চাই।
বাক্কার : গেরামের ব্যাবাক লোকে তার কাছে যাইতাছে। মোহর গেলে তোর অসুবিধা কি?
আলী : অসুবিধা নাই। কোনো অসুবিধা নাই। তয়, রাইত বিরাইতে না গিয়া, দিনের বেলা যাইলেই ভালা হয় না? ব্যাবাক লোকে তো দিনেই যায়...
বাক্কার : রাইতের বেলা গেছে মানে... কী কস তুই?
আলী : সত্য কথা কই
বাক্কার : তুই নিজের চোক্ষে দেখছোস?
আলী : তা দেখি নাই, তয় ঘটনা যে সত্য, সেইটা...
বাক্কার : দেখ আলী, আমার সাথে লাগতে আসিস না। এর আগেও তুই মোহরের স্বামীর নামে আকথা-কুকথা রটাইছিস। তারে চোর সাজাইতে নিছিলি। এখন আবার লাগছোস? ভুইলা যাইস না, মোহর আমার বইন, আমার সবচাইতে আদরের ধন!
আলী : হের লেইগাই তো কই...
বাক্কার : ফালতু প্যাচাল একদম বন্ধ! আরেকবার যদি আমার বইনের নামে কিছু কইছোস, তোরে আমি... তোর আকাম-কুকামের হিসাব আমি জানিনা মনে করছোস?
আলী : সত্য কথা কইলে সবেতের মাথায় আগুন জ্বলে। নিজের বইনরে সামলাইতে পারিস না...
বাক্কার : আলী! আর একটা কথা কইবি তো তোরে আমি... ইবলিশের বাচ্চা, শয়তানের পুত...!
(প্রবল চিৎকার করতে করতে দুজনেই মারমুখী হবে)


দৃশ্য-সাইত্রিশ/ সময়-দিন
মাচার ওপর


(মাচার ওপর মধু বসে আছে, তার সামনে বসে মহব্বতউল্লাহ্ কাঁদো কাঁদো মুখে)

মধু : ধৈর্য হারায়েন না মুরুব্বী। আল্লাহ্‌ যা করেন মঙ্গলের জন্যেই করেন।
মহব্বত : আমি ধৈর্য হারাইনি বাবা, আমার মনে কোনো খেদও নাই। ...আমার শুধু দুঃখ একটাই, মাইয়ার বিয়াটা নিজে দিতে পারলাম না। বাপ হইয়া বাপের যোগ্য কাম করতে পারলাম না।
মধু : যা হয়েছে, তা নিয়ে আর আফসোস করে লাভ কী? যান, মেয়েরে খুঁজে বের করেন।
মহব্বত : তারে খুঁজতে তো বাকি রাখি নাই বাবা। সে যদি নিজে থেকে ফিরতে না চায়, তারে কেমনে ফিরাই বলেন? ... মমতা এক জিনিস বাবা, এইটা কাউরে বোঝান যায় না! মিনতি কইরাও না, জোর কইরাও না...
(মহব্বত প্রবল আবেগে কাঁদতে থাকবে, মধু তাকে সান্তনা দিতে গিয়ে বিব্রতবোধ করবে)


দৃশ্য-আটত্রিশ/ সময়- রাত
নদীর পার


(নদীর ওপর মাছ শুকানোর একটা বিরাট মাচা, টপ শটে দেখা যাবে মধু এবং অন্যরা তার ওপর শুয়ে আছে। সবাই মোটামুটি চুপচাপ)

চাষী : কী ভাবতেছো বাউলা ভাই? তোমার মিশন গাইছা পাগলা’র সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব করতেছো নাকি?
মধু : সাফল্য-ব্যর্থতার প্রশ্ন না রে চাষী। আমি ভাবতেছি অন্য কথা। কী অদ্ভুত জীবন মানুষের! শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্যে কী না করতেছে সবাই! এই মহব্বতউল্লাহর কথা ধর- মানুষ যে এত গরীব হয়, আমি তাকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না। তোরা জানিস, তার দুইটা মেয়ের বিয়ে দিতে পারে নাই শুধুমাত্র টাকার জন্যে। খাবার কষ্টে তার ছেলে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। দু’বছর আগে খরার মৌসুমে তার মা মারা গেছে বিনা চিকিৎসায়, বিনা আহারে! অথচ দেখ, এই সবকিছু ভুলে মানুষটা কেমন হাসিমুখে আমাদের জন্যে ছুটাছুটি করতেছে, ধারকর্জ করে আমাদের খেদমত করতেছে! এরই মধ্যে ছোট মেয়েটা আজ একটা ফালতু, বাউদা ছেলের হাত ধইরা পালাইছে, মহব্বতউল্লাহ্ গেরামে মুখ দেখাইতে পারতেছে না!...একটা মানুষ পাইলাম না গেরামে, যে নাকি অর্থে-বিত্তে, সুখে-শান্তিতে দিন কাটাচ্ছে। আমার গাড়িতে প্রতিদিন যত টাকার তেল ভরি, এরা সারা সপ্তায় সেই টাকার বাজার করতে পারে না!
শাহেদ : অনেক হইছে বস, এইবার চলো যাইগা। তোমার অভিজ্ঞতা অর্জন কি শেষ হয়নাই?
মধু : যাইতে তো হইবোই। কিন্তু ...।
সোহেল : কিন্তু কী? তুমি কি এখন এদের ভাগ্য ফিরানের মিশন লইবা নাকি? এনজিও খুইলা দাতব্য কর্মসূচি চালু করবা?
মধু : দূর ব্যাটা। তাই কইলাম নাকি? এই সমস্যা এত ছোট সমস্যা নয় যে তুই আমি চাইলেই তা দূর হবে। কিন্তু... এই মোহর মেয়েটার একটা ব্যবস্থা না কইরা যাই কেমনে?
শাহেদ : কী ব্যবস্থা করবা তুমি? যে লোক তিন বছর ধইরা নিরুদ্দেশ, তারে তুমি কেমনে খুঁইজা বাইর করবা?
সোহেল : তাছাড়া সেই দিন আলী আর বাক্কার যে ব্যাপার ঘটাইলো, সামনে যে এর থিকা খারাপ কিছু ঘটবো না, তার গ্যারান্টি কে দিবো?... এর মইধ্যে তোমার মোহর আইসা একবারে মাঁচার উপরে বসা! কপাল ভালো যে কেউ দেখে নাই! দেখলে খবর ছিলো!
চাষী : এমনেই যত ফাঁপড়, এর সাথে যদি মাইয়া মানুষের ঝামেলা যোগ হয়...
মধু : ডরাইছোস?
শাহেদ : ডরের প্রশ্ন না। পোলা দুইটারের আমার ভালো ঠেকতেছে না। মধু, তুই এদের চোখের দিকে তাকাইছোস? সেই দিন এরা চইলা গেছে, কিন্তু আমার মনে কয় হেরা অল্পে থামবো না। বড় কোনো ঝামেলা বাধানের আগে, চল চইলা যাই
মধু : চইলা তো যাবোই। তার আগে মোহরের ব্যাপারটার ফয়সালা করা লাগবো। জীবনে কেউ কোনো দিন আমার কাছে কিছু চায় নাই। ...আমি তারে মরতে দিতে পারি না!
চাষী : তোমার মামা তো আইজি। তারে বলো না কেন? শাজনীন আপু কইলে তিনি ফেলতে পারবেন না...
মধু : ভালো কথা কইছিস তো...
শাহেদ : মোবাইল তো আছেই, কথা বইলা দ্যাখ্। তাছাড়া খালাম্মার সাথেও তো তোর কথা বলা দরকার। তারা নিশ্চয়ই চিন্তা করতেছে...
সোহেল : মোবাইলে চার্জ আছে তো?
শাহেদ : থাকবো না কেন? আমার মতন নাকি? হের মোবাইল তো আসনের পর থিকা বন্ধই পইড়া আছে।
মধু : (মধু পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে অন করতে করতে উঠে পড়বে) তোরা আর কিছুক্ষণ থাকিস যদি তো থাক, আমি দেখি একটু কথা বলি। (নেমে চলে যাবে, অন্যরা তার চলে যাওয়া দেখে আবার আকাশের দিকে তাকাবে)



দৃশ্য-ঊনচল্লিশ/ সময়- রাত
যে-কোনো নির্জন স্থান



(মধু মোবাইলে কথা বলছে শাজনীনের সাথে।)

শাজনীন : তাহলে এতদিনে আমার কথা মনে পড়লো দয়া করে। তা হঠাৎ এত দয়ালু হবার কারণটা জানতে পারি?
মধু : এই... এমনিই! ‘অনেকদিনের অনেক কথা, ব্যাকূলতা/ বাঁধা বেদন-ডোরে...’
শাজনীন : ‘...মনের মাঝে উঠেছে আজ ভরে!’ ...ব্যাপারটা কী, হঠাৎ এত কাব্য?
মধু : প্রেমিকেরা সারা জীবন প্রেমিকার মান ভাঙ্গাতে কব্যেরই তো আশ্রয় নেয়!
শাজনীন : আমার দায় পড়েছে তোর প্রেমিকা হতে যাবো! এদিক সেদিক না ঘুরিয়ে আসল কথাটা বলে ফ্যাল।
মধু : আসল কথা, না? তা কথা অবশ্য একটা আছে বৈকি। ভালো কথা, তোর বিডিআর বাপটা কেমন আছে?
শাজনীন : খবরদার! ভালো হচ্ছে না কিন্তু! আমার বাবা মোটেও বিডিআর না, আইজিপি। আর তিনি শুধু আমার বাবাই নন, তোরও আপন মামা। ...এমনকি তোর বাবা হবারও একটা চান্স তার মনে হয় আছে। অতএব, সম্মান করে কথা বল।
মধু : তোকে বিয়ে করলে তবেই না তিনি আমার বাবা হচ্ছেন! তোকে বিয়ে করবো কোন দুঃখে? একেতো ডাক্তার বউকে বিশ্বাস নাই, একটু ঠোকাঠুকি হলেই এটা সেটা বলে উদ্ভট সব ওষুধ খাইয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে দেবে...
শাজনীন : অবভিয়াসলি সেটা মেন্টাল হসপিটাল!
মধু : রাইট! ...অ্যাঁ, কী বললি?
শাজনীন : (উচ্চশব্দে হেসে উঠবে)
মধু : তাছাড়া আমার সাথে চলতে পারার তোর ট্রেনিংই নাই!
শাজনীন : আহা হা, বীর বাহাদুর! ট্রেনিং আবার কীসের রে?
মধু : এই ধর, আমি তো বাস করবো বনে-বাদাড়ে, বাসা বানাবো গাছের ওপর, তুই তো গাছেই চড়তে পারিস না!
শাজনীন : মধু...! এসব ফাজলামী বাদ দিয়ে আসল কথাটা বল। বাবার খবর নিচ্ছিস কেন? আবার কোন অঘটন ঘটিয়েছিস নাকি?
মধু : দূর কী যে বলিস!... তবে দরকার একটা অবশ্য আছে।
শাজনীন : কী দরকার?
মধু : একটা লোককে খুঁজে বের করতে হবে।
শাজনীন : খুঁজে বের করতে হবে মানে কী? সে কোথায় আছে?
মধু : এই জন্যে বলি যে, এত পড়বার দরকার নাই। তোর মাথাটা একদম গেছে। ...আরে কোথায় আছে যদি জানতাম তাহলে আর খুঁজে বের করবার প্রশ্ন আসতো নাকি?... এখন শোন, লোকটার নাম আলাউদ্দিন। তিন বছর ধরে সে নিরুদ্দেশ। ঢাকায় গেছিলো আয় রোজগারের ধান্দায়, আর ফিরেনি। তার ছবি এমএমএস করে দিচ্ছি, হাতে কিন্তু সময় খুবই কম। কালকের মধ্যে লোকটার খোঁজ চাই।
শাজনীন : এটা কোন কথা হলো? একটা দিনের মধ্যে কোনো লোকের খোঁজ বের করা কি সম্ভব নাকি? এত বড় শহর, লক্ষ লক্ষ মানুষ...
মধু : আমি কিচ্ছু বুঝতে চাই না। তোর বাপ আইজি হয়েছে কি খই ভাজতে?
শাজনীন : আবার বাপ তুলে কথা বলছিস! বাবা তোর অপর এমনিতেই মহা ক্ষ্যাপা। মামণি তোর নামে নালিশ করেছে। তোর খোঁজে ফাউল কিসিমের মানুষ-জন বাড়ীতে আসছে।
মধু : ফাউল কিসিমের মানে?
শাজনীন : সেটা আমি জানি না। বাবা বললো, বাবাকে জিজ্ঞেস কর। ...তা একদিনের মধ্যে লোকটার খোঁজ বের করতে হবে কেন?
মধু : কারণ তা না হলে লোকটার বউকে এখানে সবাই জোর করে একটা আধাবুড়া বদ লোকের সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে।
শাজনীন : আচ্ছা, তাহলে এই ব্যাপার! এখানেও একটা ঘটনা আছে।
মধু : শাজনীন প্লিজ, বি সিরিয়াস। আমি কথা দিয়েছি তার স্বামীকে খুঁজে বের করে দেবো। যদি আমি কথা রাখতে না পারি, যদি তাকে ঐ বদ লোকটাকে বিয়ে করতে হয়, তাহলে সে আত্মহত্যা করবে!
শাজনীন : বাব্বা! এত প্রেম? খোঁজ নিয়ে দ্যাখ, সেই বেটা মনে হয় আর কাউকে বিয়ে করে সুখে দিন কাটাচ্ছে...
মধু : হতেই পারে না। আমি মোহরের চোখে যে ভালোবাসা দেখেছি, এর থেকে বেরিয়ে পালাবে, এমন হতভাগা কেউ হতে পারে না!
শাজনীন : এই, ব্যাপার কী? তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে তুইও যেন তার প্রেমে পড়ে গেছিস? খবরদার...
মধু : (কিছুটা অপ্রস্তুত) আশ্চর্য তোদের সন্দেহ বাতিক!
শাজনীন : দেখতে ক্যামন?
মধু : কী আশ্চর্য্য, রাখতো এসব। আমি ফোন রাখছি, তুই মামাকে এখনই বল যেন ব্যবস্থা করে। আমার ধারণা লোকটা জেলে আছে। বোকা-সোকা মানুষ, কোনো গোলমালে পড়ে ফেঁসে গেছে, ধরাধরির কেউ নাই, হয়ত বিনা বিচারেই আঁটকে আছে!
শাজনীন : আবার তোর ইনট্যুইশন?
মধু : হ্যাঁ। এবং আমার মন বলছে, বরাবরের মতো এবারও আমি নির্ভুল!
শাজনীন : ভালো থাকিস, বাই।


দৃশ্য-চল্লিশ/ সময়- রাত
মাঁচার ওপর


(মাঁচার ওপর থেকে দেখা যাবে মধু মই বেয়ে উপরে উঠছে। শেষ ধাপটা পার হয়ে মাঁচায় উঠেই সে ম্যাচ জ্বালাবে। ম্যাচের আলোয় সামনে দেখতে পাবে মোহর বসে আছে। সে ভীষণ বিরক্ত হবে, তার মধ্যে ভয়-তাড়িত ব্যস্ততা লক্ষ্য করা যাবে)


দৃশ্য-একচল্লিশ/ সময়-রাত
মোহরের বাড়ী


(মোহরের মা এবং ভাই বাক্কার কুৎসিৎ বচসায় লিপ্ত। তাদের ঝগড়ার বিষয়, এত রাতে মোহর বাড়ীর বাইরে একা একা কোথায় গেছে)

বাক্কার : আমি তোরে আগেই কইছিলাম, হের বিয়া লইয়া ফালাফালি করিস না... ষাইট বছরের ঘাটের মরা, তার বিয়ার সাধ মিটে না, আমার ফুলের মতোন বইনডারে...
জরিনা : চুপ থাক হারামীর পুত! বইনের জন্যে দরদ উথলায় পড়তেছে। এত দরদ তো বইনরে কামাই কইরা খাওয়াইতে পারোস না? বইনের গতর খাটানী ট্যাকায় জুয়া খেলস, তাড়ি খাস, লজ্জা করে না...?
বাক্কার : আমারে চ্যাতাইস না কইলাম। ভালা হইবো না...
জরিনা : চোপা করিস না কুত্তার বাচ্চা। ভাত দেওনের মুরাদ নাই, কিল মারনের গোসাই! কোন ভালাডা করছিস এত্‌দিনে? মা বইনরে পরের বাড়ী গতর খাটাইতে পাঠাইতাছিস, এহন কি গতর বেচতে পাঠাবি...?
বাক্কার : ওই চুপ গেলি?
জরিনা : কেন চুপ করুম, ক্যান চুপ করুম? পয়লা দিন চুপ থাকছি, আরো চুপ থাকতে কস? যার জোয়ান মাইয়া মাঝরাইতে বাড়ির বাইরে রঙ-তামাশা করতে যায়, হে কেমনে চুপ থাকে...

(বাক্কার ক্রোধে হতবুদ্ধি হয়ে যাবে, তেড়ে আসবে মাকে মারতে, কিন্তু তার চেহারা দেখে সাহসে কুলাবে না। নিজের মাথার চুল ধরে টানতে থাকবে। আর তার মনে ভেসে উঠবে আজ দুপুরে আলীর সাথে কথোপকথন; আলী বলছে- টানাটানি তো আমি করি না, টানে তারে গাইছা বাবা; রাইত বিরাইতে না গিয়া, দিনের বেলা যাইলেই ভালা হয় না? সত্য কথা কইলে সবেতের মাথায় আগুন জ্বলে; নিজের বইনরে সামলাইতে পারিস না... বাক্কার রাগে অন্ধ হয়ে যাবে, কী করবে বুঝতে পারছে না সে)

জরিনা : খাড়ায় থাকলি কেন? যেইহান থিকা পারিস তারে ধইরা নিয়া আয়। কাইলকার মইধ্যে জালাল মিয়ার সাথে তারে নিকা বসতে হইবো...
বাক্কার : তুই যদি তারে জালাল মিয়ার সাথে নিকা বসাস, তো আমি তোরেও খুন করবো, জালালরেও খুন করবো, এইটা আমার শেষ কথা।

(উদ্ধত ভঙ্গিতে বেরিয়ে যাবে, জরিনা সেই দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে, তারপর নিজেও তার পেছন পেছন বেরিয়ে যাবে)



দৃশ্য-বিয়াল্লিশ/ সময়- রাত
মাচার উপর


(মোহর মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে, মধু ভয়ানক অপ্রস্তুত হয়ে আছে)

মধু : তুমি এইটা কী করলা। এইখানে আবার কেন আসলা তুমি। কাল এসেছিলা সেটা নিয়েই আমি... এখন আমি কী যে করি! লোকজন জনতে পারলে... জানতে তো পারবেই...!
মোহর : আমি কোনো কিছু ভাইবা আসি নাই। আমি কেমনে আসলাম, ক্যান আসলাম নিজেও জানি না।
মধু : সে তো বুঝলাম। কিন্তু...
মোহর : আমার মাথার ঠিক নাই। কখন কী করি বুঝতে পারি না... তারে কি আর ফিরা পাবো না?
মধু : (অসহায় বোধ করবে) আমি তো তোমারে কথা দিয়েছি, তারে খুঁজে বের করবো। আমারে সময় তো দিতে হবে। একটা মানুষ যে কিনা তিন বছর ধরে নিরুদ্দেশ তারে খুঁজে বের করা তো সহজ ব্যাপার না। তিন বছর ম্যালা সময়, এর মধ্যে অনেক কিছু ঘটে যায়। একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে পুরোপুরি ভুলে যেতে পারে...
মোহর : এইগুলা আপনেদের বড়লোকের মইধ্যে ঘটে। আমরা গরীব মানুষ জন্মাই অভাবের মইধ্যে, সারা জীবন অভাবের সাথে যুদ্ধ করি। আমরা অভাব দেইখা যেমন ডরাই না, তেমন সুখ-শান্তির লোভে পইড়াও আপনরে পর করি না।
মধু : (অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবে কিছুক্ষণ) এইসব ভাবনা পরে ভাবা যাবে। আগে চলো তোমাকে তোমার বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।
মোহর : না! আমি একাই যাবো। আপনে আমার সাথে গেলে আপনের বিপদ হবে। আপনের সাথের লোকেরাও বিপদে পড়বে। আমার ভাই বাক্কার খুব খারাপ মানুষ। এর দোস্ত আলী তার থেকেও খারাপ। খুন খারাবী করতে হাত কাঁপে না!
মধু : আমার বিপদ যা ঘটার তা ঘটে গেছে। কিন্তু তোমাকে এত রাতে একা যেতে দেই ক্যামনে।
মোহর : না, আমি একাই যাবো...
(মধু কিছু একটা বলতে যেতেই বাক্কারের গলা শোনা যাবে-)
বাক্কার : মোহর-
(মধু এবং মোহর দুজনেরই মুখ ভয়ে শুকিয়ে যাবে)


দৃশ্য-তেতাল্লিশ/ সময়-রাত
বটতলা


(মোহরের পেছন পেছন মধুও নেমে এসেছে। তারা মাঁচা থেকে নেমে আসতেই বাক্কারের সামনে পড়বে, বাক্কারের পেছনে জরিনা দাঁড়িয়ে আছে। বাক্কার তাদের একসাথে দেখে হতভম্ব হয়ে যাবে। পরক্ষণেই তার চোখে-মুখে তীব্র ক্রোধ ফুটে উঠবে। তার চিৎকারে গভীর রাতেও লোক জড়ো হয়ে যাবে। আলীও এসে দাঁড়াবে ভীঁড়ের মধ্যে, সঙ্গে যে দুজন লোক শহরে গেছিলো মধুর খোঁজ করতে তারাও থাকবে। শাহেদ, চাষী, সোহেলরা ছুটে আসবে)

বাক্কার : এত রাইতে এইহানে কী করতাছিস?
মধু : উনি এসেছিলেন...
বাক্কার : আপনে চুপ থাকেন। আপনের ব্যবস্থা পরে হইবো। আগে হের ব্যবস্থা করতে দেন। তুই এত রাইতে এইহানে করোস কী?
(মোহর নিরব, কোন কথার জবাব দিচ্ছে না, মাটি থেকে চোখ সরাচ্ছে না। তবে তার চেহারায় ভীতি নেই, বরং এক ধরণের জেদ দেখা যাবে, ডেসপারেট বলতে যা বোঝায়)
: কথার জবাব দেস না কেন বান্দির বেটি। ফকিন্নির বেটির কথা কইতে শরম লাগে? আধা রাইতে পর-পুরুষের সাথে ফুর্তি করতে লজ্জা লাগে না? তখন শরম কই পালায়...?
মধু : আপনি শুধু শুধু উত্তেজিত হচ্ছেন। উনি এসেছিলেন উনার স্বামীর সন্ধান চাইতে...
বাক্কার : চুপ থাক হারামীর পুত। তোর পীরগিরি আইজ বাইর করতেছি। ধান্দাবাজি...! আমার বইনের লগে!! (মোহরের উদ্দেশ্যে) তর স্বামীর সন্ধান চাই, হেয় দেওনের কেডা? হে কোন দ্যাশের পীর আউলিয়া...?
আলী : কোন দ্যাশের পীর সেইডা আমার কাছে থিকা শোনো সবাই। আমার প্রথম থিকাই সন্দেহ সন্দেহ ঠেকছিল। এইজন্যে জলিল আর শামসুরে পাঠাইছিলাম এর খোঁজ বাইর করনের লাইগা। হেরা সব খবর লইয়া আইছে। আমাগো গাইছা বাবার আসল নাম- মধু, আরিফুদ্দৌলা মধু। হের বাপের তিন তিনটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী আছে; যেইগুলার একটার মাসিক রোজগার দিয়া আমাগো গোটা গেরামের বেবাক লোকের সারা বছর চইলা যাইবো। তার পরেও দেখেন, আমাগো গরীব মানুষগুলারে ভাওতা দিয়া খাইতে আইছে এই গেরামে...
মধু : আপনি একতরফাভাবে যা খুশি বলে যাবেন, নাকি আমাকেও কিছু বলতে দিবেন?... এটা ঠিক যে আমি আমার পরিচয় গোপন করেছি, আপনাদের কাছে সাধুবাবা সেজে ভেক ধরেছি। কিন্তু কেউ কি বলতে পারবেন, আমার দ্বারা কারো কোনো ক্ষতি হয়েছে? আমি কারো কাছ থেকে কোনো টাকা পয়সা বা আর কোনো কিছু গ্রহণ করেছি? আমি কাউরে ভাওতা দিয়া কোনো সুবিধা হাসিল করেছি?
বাক্কার : এইসব আজাইড়া প্যাচাল হুনার কাম নাই। আমার বইন আপনের কাছে কী চায়? এত রাইতে সে এইখানে কেন আসছে?
শাহেদ : সেইডা তো আপনের বইনই ভালো বলতে পারবে, তারে শুধান...
মধু : তুমি থামো শাহেদ ভাই। ...আপনার বোনের স্বামী আজ তিন বছর নিরুদ্দেশ, আপনারা তাকে খুঁজে বের করছেন না কেনো? উল্টো সবাই তাকে জোর করে বিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন। স্বামী জীবিত থাকতে একটা মেয়ের দ্বিতীয় বিয়ে হয় কেমন করে?
মহব্বত : বিধান আছে। স্বামীর সাথে যদি দুই বছর একটানা কোনো দাম্পত্য সম্পর্ক না থাকে, তা হইলে সেই বিয়ে এমনেতেই তালাক হয়ে যায়...
মধু : শরীয়তের বিধান কিছু কিছু আমিও জানি, মুরব্বী। মনে করে দেখেন, সেইখানে একটা শর্ত দেয়া আছে, যদি সম্পর্ক না রাখার ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত হয়, তাহলেই কেবল সেটা তালাক হবে।
মহব্বত : ঠিক ঠিক, এইটাও স্পষ্ট উল্লেখ আছে।
আলী : হেই বেডা যে ইচ্ছা কইরাই পলাইয়া যায় নাই, কে কইতে পারে?
মোহর : হইতে পারে না, আমি বিশ্বাস করি না। তোমরা তার সাথে আমার বিয়ার সময়েও বাধা দিছো। তারে তোমরা চোর সাজাইয়া গেরাম-ছাড়া করতে নিছিলা, কিন্তু পারো নাই। তাও তো সে আমারে ছাড়ে নাই। সে বাঁইচা থাকতে আমারে ছাড়তে পারে না। আমি মইরা যামু, তবু আর কারো লগে বিয়া বসবো না!
মধু : বুঝতেই পারছেন, আমার কাছে আসার পেছনে তার অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিলো না।
জরিনা : উদ্দেশ্য ধুইয়া পানি খাওনের টাইম নাই। আমার যা ক্ষতি হওনের তা তো হইছেই। যে মাইয়া এত রাইতে একা একা গাছতলায় যায়, তারে আর কে বিয়া করবো? ...ও আল্লাহ্‌, আমার কপালে আর কত দুঃখ রাখছো গো...!
বাক্কার : রাইত মেলা হইছে, আলগা প্যাচালের সময় নাই। একটা ফয়সালায় আসেন।
আলী : ফয়সালা আবার কী? মোহর যখন তার কাছে স্বামীর সন্ধান চাইছে, হে’ও নাকি দিবো কইছে, তখন খোঁজ বাইর কইরা দেউক। আর না যদি পারে, তাইলে হে নিজেই একটা ব্যবস্থা করুক। আমরা তো আর মোহরের কেউ না, তাই স্বামীর খোঁজ বাইর করতে রাইত বিরাইতে সব ভুইলা তার কাছে ছুইটা আইছে
মধু : আপনাদের কথা আমি বুঝতে পারছি না। আপনারা জোর করে একটা সিদ্ধান্ত আমার ওপর চাপিয়ে দিতে পারেন না...
মহব্বত : তোরা কি এইহানে শালিস বসাইছোস যে, ফয়সালা করতে লইছোস? শালিস যদি বসেও, তো তোরা বিচার করোনের কেডা? দুই দিনের পুঁইচকা ছেমড়া...
আলী : আপনে থামেন মিয়া। সেইদিন তো খুব লইছিলেন একহাত। বাবার সাথে বেদ্দবী, গজব নামবো, মানী লোকের মান-সম্মান... এহন কী বারাইলো? আপনের বাবাই হইলো গিয়া ভূয়া...
মহব্বত : এইটা ঠিক হইল না। আইজকা তার বাইরের পরিচয়টা সামনে এসেছে, তিনি কোনো পীর আউলিয়ার ঘরে জন্মান নাই, তার মইধ্যে পীরালি পরম্পরা নাই। এই জন্যেই তারে ভূয়া কইতে হইবো? আল্লাহ্‌পাক কখন কারে কার মাধ্যমে হেদায়েত করেন, তুমি আমি তার বিচার করনের কেডা? গৌতম বুদ্ধও তো একসময় রাজা ছিলো, রাজা সিদ্ধার্থ, তাই বলে তিনি কি সাধু হইতে পারেন নাই?... সাধু হইতে সাধ্য লাগে না, লাগে শুধু সাধনা। সেইটা যার আছে, সে’ই সত্য, তা তার জন্ম কুটিরে হোক আর রাজ-প্রাসাদে।
(অন্য সবার মতো এমনকি মধু নিজেও অবাক হয়ে শুনতে থাকবে মহব্বতের কথা। এতকিছুর পরও তার প্রতি মহব্বতের অটুট আস্থা দেখে সে বিষ্মিত হবে)
জরিনা : কিন্তু এখন আমার কী হইবো? আমার মোহরের বিয়াডা যে ভাইঙ্গা গেল...!
বাক্কার : বিয়া-শাদীর কাম নাই। কাইলকা রাইতের মইধ্যে এই বেটা মধু তার স্বামীরে খুঁইজা বাইর করবো। এই হইলো তার পীরগিরির পরীক্ষা। আর যদি সে তা না পারে, তাইলে মোহরকে তারই বিয়া করা লাগবো। কথা শ্যাষ!


দৃশ্য-চুয়াল্লিশ/ সময়-সকাল
মাচার ওপর


(মধু মোবাইলে কথা বলছে শাজনীনের সাথে)

মধু : তুই বুঝতে পারছিস না ব্যাপারটা। অসম্ভব বললে চলবে কেন? এই লোকটাকে খুঁজে পাওয়ার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে...
শাজনীন : কী নির্ভর করছে শুনি? তোর পীরগিরি? আধ্যাত্মিক সাধুবাবার ক্যারিশমা?
মধু : ওহ্ শাজনীন, তুই বুজছিস না। কাল তোর সাথে কথা বলাবার পর অনেক কিছু ঘটেছে। গ্রামের সব মানুষ এখন আমার আসল পরিচয় জানে। আমি এখন তাদের হাতে জিম্মি। হয় আমাকে মোহরের স্বামীকে খুঁজে দিতে হবে, নয়তো...
শাজনীন : নয়তো কী...?
মধু : তুই মামার সাথে কথা বলেছিস?
শাজনীন : নয়তো কী? মধু, আই আস্কড্ নয়তো কী? কেনো তুই সব খোলাখুলি বলছিস না? ওরা তোকে অপমান করেছে...?
মধু : আহ্ শাজনীন, এসব কিছু না। ব্যাপারটা এই পর্যায়ের না...
শাজনীন : তো কোন্ পর্যায়ের?
মধু : ...ওরা লোকটার খোঁজ না পেলে...
শাজনীন : না পেলে কী?
মধু : আমার সাথেই মোহরের বিয়ে দেবে!
শাজনীন : (বেশ খানিকক্ষণ নিরব থেকে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলবে) ভালোই তো, বিয়ে কর!
মধু : শাজনীন!
শাজনীন : আমাকে একটা সত্যি কথা বলতো মধু, তুই এতটা ইনভলভ্ড হলি কী মনে করে? কেমন করে হলি?
মধু : জানিনা!... আমি যখন প্রথম দেখি মেয়েটাকে... আই কান্ট এক্সপ্লেইন! মাঝখানে যদি তুই না থাকতি...
শাজনীন : আমি মাঝখানে আছি তা কে দেখতে যাচ্ছে? ডু হোয়াটএভার ইউ ওয়ান্ট...
মধু : শাজনীন প্লিজ আই অ্যাম সরি! তুই জানিস আমি তোর কাছে কিছুই চেপে রাখতে পারি না... দূর্বল মুহূর্তে কী বলতে কী বলে ফেলেছি! ... আমি জানি এটা মোহ...
শাজনীন : মোহ আর মোহর, না? বাহ্ মিলেছে তো বেশ...
মধু : কী বলছিস এসব...
(শাজনীন লাইন কেটে দিয়ে ফোন বন্ধ করে বসে থাকবে। এদিকে মধু বার বার চেষ্টা করতেই থাকবে। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে সে’ও ফোনটা বন্ধ করে রেখে দিবে। এদিকে শাজনীন আবার ফোন অন করে তাকে কল করবে এবং যান্ত্রিক কন্ঠে ‘সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না’ এরকম মেসেজ শুনবে। সে রাগে ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে দিবে, দেয়ালের সাথে লেগে ফোনটা টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। ফোন ভাঙ্গার বিকট আওয়াজ শুনে পাশের ঘর থেকে তার বাবা ছুটে আসবেন)
বাবা : কী হয়েছে, কী ব্যাপার? একি! ফোনটা ভেঙ্গে ফেললি কেন?
শাজনীন : (প্রবল আবেগে বাবাকে জড়িয়ে ধরে) আমি কিচ্ছু জানিনা বাবা, যেখান থেকে পারো লোকটাকে খুঁজে বের করো, আজকের মধ্যেই খুঁজে বের করো...!


দৃশ্য-পঁয়তাল্লিশ/ সময়-দিন
খণ্ডচিত্র


(গ্রামের বিভিন্ন অংশে ক্যামেরা প্যান হতে থাকবে। ক. গাছতলায় অবালবৃদ্ধবনিতা জড়ো হয়েছে, তারা সবাই নিরবে বসে আছে। সবার মুখ অভিব্যক্তিহীন। খ. মাচার ওপর মধু বসে আছে, তার পাশে উদাশ মুখে চাষী। গ. শাহেদ নিচের চালাঘরে গোছগাছ করতে ব্যস্ত, জাহিদ, সবুজ এরা তাকে সাহায্য করছে। ঘ. গাছের গোড়ায় ঠিক মইটার পাশে বসে আছে মহব্বতউল্লাহ্‌, তার চোখে পানির শুকনো ধারা। ঙ. মোহরের বাড়িতে বিয়ের আয়োজন চলছে, বাচ্চা ছেলেমেয়েরা হৈ-হল্লা করে সস্তার সরঞ্জাম দিয়ে ঘরবাড়ি সাজাচ্ছে। এক পাশে মশলা বাঁটা হচ্ছে, মোহরের মা জরিনা উঠানময় ছুটে বেড়িয়ে কাজকর্ম তদারক করছে; প্রতিবেশী কোনো মহিলা জরিনাকে উদ্দেশ্য করে বলবে- জরিনা বিবির ফাটা কপাল জোড়া লাগছে, তিন গার্মেন্টের মালিক জামাই পাইছে; পাশে থেকে অপর একজন টিপ্পনী কাটবে- সবই গাইছা বাবার ইচ্ছা! সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠবে। চ. আলী-বাক্কার এরা একটু দূরে বসে বিড়ি ফুঁকছে, পাশে সস্তা দামের ক্যাসেট প্লেয়ারে হিন্দি গান বাজছে। আলীর মন খুব খুশি খুশি, কিন্তু বাক্কার একটু মনমরা। সে হয়ত এমনটা চায়নি। ছ. শাজনীন মধুর মা’র কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে, তার চোখে পানির ধারা। মায়ের মুখ থমথম করছে। জ. শাজনীনের বাবা আইজি সাহেব তার ঘরে বসে ঘন ঘন ফোন করছেন, তাঁর চেহারা ভীষণ উদ্বিগ্ন; গোটা পুলিশ বিভাগ তার টেলিফোনে ওলট-পালট হয়ে গেছে বলে মনে হবে। ঝ. গাছতলায় সাত-আটজন গ্রাম্য যুবক হাতে লাঠিসোটা নিয়ে বসে আছে। তাদের মনযোগ গাছের উপরে মাচার দিকে। মোটামুটি এই দৃশ্যগুলোই এলোমেলোভাবে ঘুরেফিরে আসবে, এর মধ্য দিয়ে দিন থেকে রাত হয়ে যাবে)


দৃশ্য-ছিচল্লিশ/ সময়-রাত
বটতলা


(গাছের নিচে বাউল আসর বসেছে। গান করছেন কাঙ্গালিনী সুফিয়া ও তার দল। গ্রাম-সমাজে আজ একটা বিশেষ দিন, আজ অন্যরকম কিছু একটা ঘটবে- এই প্রত্যাশায় ইদ্রিস মেম্বার এই বাউল আসর আয়োজন করেছেন। গান শুরু হবার আগে তিনি একটা ছোটখাটো বক্তব্য দিবেন)

ইদ্রিস : প্রিয় গ্রামবাসী, সাবেক গাইছা বাবা অরফে আরিফুদ্দৌলা মধু সাহেবের আস্তানা হইতে আপনাদের স্বাগতম জানাইতেছি, আস্‌সালামু আল্লাইকুম। আপনেরা সকলেই আমাকে চেনেন, জানেন, ভালোবাসেন। আপনাদের সুখে-দুঃখে আমি আপনাদের পাশে থাকছি, ভবিষ্যতেও থাকবো ইনশাল্লাহ্‌। ভাইসব, আপনারা জানেন, আমি এই ইউনিয়নের মেম্বার হিসাবে আপনাদের খেদমত করেছি...
জনৈক : আপনে আবার পেচাল শুরু করলেন কেন? কাঙ্গালিনী সুফিয়ার গান শুনতে এসেছি, তারে গান গাইতে দেন...
ইদ্রিস : কে, কে বলে এই কথা...
(যে বলেছে তাকে খুঁজে পাওয়া যাবেনা, তবে ইদ্রিস নতুন করে গলাবাজির সাহস আর দেখাবেন না)
: যা হউক, গান শুনতে এসেছেন, গান শুনবেন, কিন্তু কেন গান হইতেছে এই ব্যাপারটা কি সবেতে জানেন? জানেন না। আমি আপনাদের বিরক্ত করবো না, সংক্ষেপে জানায়ে দেই ব্যাপারটা। কয়েকদিন যাবত গেরামে একদল আগন্তুক এসেছেন। তাদের মধ্যে একজন নাকি সাধুবাবা, বাকিরা তার শিষ্য-সাগরেদ। তো যা হোক, আর সবার মতো তারে আমিও বিশ্বাস যাই নাই। কিন্তু যখন তার সাথে স্বাক্ষাত করলাম, তিনি আমারে এমন কিছু কথা শোনাইলেন, আমার কাছে মনে হইলো, তার আলগা চুলের আড়ালে যে মাথাটা লুকানো, সেইখানে যথেষ্ট জ্ঞান-গরিমা আছে। গতকালকে এই স্থানে এক অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে যাওয়ায়, সাধুবাবার অন্যরকম কোনো ক্ষমতা আছে কিনা, এইটা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। অবশ্য এটাও সত্য, তিনি কখনই দাবী করেন নাই যে, তার অন্য কোনো ক্ষমতা আছে। তার পরও তিনি কথা দিয়েছেন, এই গেরামের এক নিরুদ্দেশ ব্যক্তি, আপনেদের সকলের চেনা, মোহরের স্বামী আলাউদ্দিনরে তিনি আজ রাইতের মইধ্যে হাজির করবেন। যদি তিনি তা করতে না পারেন, তাইলে রাত্রী শেষে তেনার সাথেই মোহরের বিবাহ অনুষ্ঠিত হবে। কেননা তেনার কারণেই মোহরের নির্ধারিত বিবাহ ভঙ্গ হয়েছে। ...আমরা তাইলে আল্লাউদ্দিনের জন্যে কতক্ষণ অপেক্ষা করতে পারি?
জনৈক : সারা রাইত
ইদ্রিস : এইডা কোন বিবেচনার কথা হইলো না। রাত্রী দশটার পর এমনিই গেরামে আসার সব রাস্তা বন্ধ হইয়া যায়। গাড়ী-ঘোড়া সব বন্ধ, আইবো ক্যামনে? ...তারপরও আমরা না হয় রাত্রী বারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করি, কী বলেন? তাছাড়া কাইল শুক্রবার, একটা পবিত্র দিন। শুভকাজটা তাইলে শুভ দিনের প্রথম প্রহরেই হউক? এখন সুফিয়া খালা, আপনেরে কিন্তু মিল-মহব্বতের গান করতে হইবো, মধ্যরাত পর্যন্ত!

(সুফিয়া গান শুরু করবেন, সবাই গানের সাথে মজে যাবে। কিন্তু মধু মাঁচার ওপর থেকে অস্থির বোধ করবে। সে ক্রমশ মোবাইলে শাজনীনকে ধরবার চেষ্টা করবে, কিন্তু তার মোবাইল বন্ধ। গান যখন পুরোপুরি জমে গেছে, ঠিক সেই সময়ে হঠাৎ করে একটা প্রাইভেট কার এবং তার পেছনে একটা মাইক্রোবাস এসে ঝড়ের বেগে গাছতলাতে থামবে। থামার সময়ে প্রচন্ড শব্দে হর্ন বাজানোর কারণে গান থেমে যাবে। সামনের কার থেকে নেমে আসবে শাজনীন, পেছনের মাইক্রোবাসের দরজা খুলে একজন এসআই ও কয়েকজন পুলিশ কনস্টেবল নেমে আসবে। সবাই অনেকটা হতভম্ব হয়ে যাবে, ক্রমশ ভীঁড় পাতলা হতে থাকবে। মধু, শাহেদ এরা দ্রুত সামনে চলে আসবে)
এসআই : এই খানে ব্যাপারটা কী? হচ্ছেটা কী?
(আলী এবং বাক্কার দুজনেই সুযোগ বুঝে পালিয়ে যাবে, ইদ্রিস মেম্বার পালানোর পথ পাবে না)

কেউ কি আমাকে বলবে, এইখানে কী হচ্ছে?
জনৈক : গান হইতেছিলো, এখন বন্ধ আছে।
এসআই : তা তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু গানটা হচ্ছে কী উপলক্ষে?
জনৈক : এইটা মেম্বার সাবে কইতে পারবো, তেনার ব্যবস্থাতেই গান হইতেছিল।

(ইদ্রিস মেম্বার পালাতে উদ্যত হতেই এসআই তাকে ধরে ফেলবেন)
এসআই : আপনিই কি সেই মেম্বার?
ইদ্রিস : জ্বে না ...জ্বে মানে অনেকদিন আগে একবার মেম্বার হইছিলাম, মানে মেলা দিন, ধরেন দশ পনেরো বছর...
মধু : শুধু শুধু ঝামেলা বাড়াচ্ছেন কেন? ওনারা একটা গানের আসর করেছেন তাতে সমস্যা তো কিছু নাই?
শাজনীন : তোমাকে আর কথা বলতে হবে না। এখনও তোমার শখ মিটেনা, না? সোজা গাড়িতে ওঠো।
মধু : কিন্তু...
শাজনীন : কোনো কিন্তু নয়, এই মুহূর্তে... ইটস্ অ্যান অর্ডার!
এসআই : আরিফ সাহেব, বেটার হয় আপনি ম্যাডামের সাথে চলে যান, বাকি আমি দেখছি।
মধু : আহা, বললেই তো আর যাওয়া যায়না।
শাহেদ : ঠিকই তো, এই রকম চোরের মতো পালায়ে যাবো কেন?
শাজনীন : শাহেদ ভাই, আপনি আর দয়া করে কথা বলবেন না। আপনারা অনেক করেছেন। আরো কত কিছু যে করতে পারতেন, সে আমি বুঝতে পারছি।
চাষী : এইটা ঠিক না, শাজনীন আপু। তুমি একজনের রাগ সবার উপরে ঝাড়তে পারো না। আমি একদম প্রথম থেকে এইগুলার বিপক্ষে ছিলাম...
মধু : ওই, তুই কথা কম ক’
শাজনীন : তুমিও কথা কম কও। অনেক কথা বলেছো, এবার বাড়িতে চলো, আমার কথা শুনবা
এসআই : আরিফ সাহেব, স্যারের... আই মিন আপনার মামার অর্ডার আছে, ফার্স্ট-টাইম আপনাকে গাড়িতে তুলে ফেরত পাঠাতে হবে। আমাকে তো আমার জব করতে হবে...!
মধু : কিন্তু...
শাজনীন : কিন্তু কী? মোহর...? তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তার স্বামীকে খুঁজে পাওয়া গেছে, ছাড়ানোর ব্যবস্থা চলছে। মধু ওঠ তো গাড়িতে, আমার আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না।
মধু : ঠিক আছে যাচ্ছি। কিন্তু, এসআই সাহেব, আপনাদেরকেও একই সাথে রওনা হতে হবে। এইখানে আপনারা কোনো প্রকার অ্যাকশান নিতে পারবেন না। আমার কোনো অভিযোগ নেই।
শাজনীন : আচ্ছা ঠিক আছে, এসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। তুই গাড়িতে ওঠ (অন্য সবার দিকে তাকিয়ে) এই তোরা দাঁড়িয়ে থাকলি কেন? ওঠ গাড়িতে...

(সবাই অনিচ্ছাসত্বেও গাড়িতে উঠে বসবে, ধূলা উড়িয়ে গাড়ি চলে যাবে। ছুটতে ছুটতে গাছতলায় এসে হাজির হবে মোহর)

মোহর : কই গেল, কই গেল তারা...?
মহব্বত : চইলা গেছে মা, তারা সবাই চইলা গেছে
মোহর : কিন্তু গাইছা বাবা? সে ক্যামনে চইলা গেল? আমার মানুষ আমারে ফিরায়ে না দিয়া সে ক্যামনে চইলা যায়? কেন গেল সে? কেন গেল...?
বাক্কার : এখনও তারে গাইছা বাবা ডাকোস? এখনও তার আশায় বইসা থাকোস? লাজ-শরম কিছুই তো আর রাখলি না...
মোহর : অন্তর মইরা গেলে লাজ-শরম দিয়া কী করুম? বিশ্বাস চুরি গেলে থাকে আর কী!
বাক্কার : যার নিজের পরিচয়ই নকল, তারে বিশ্বাস করলে তো ঠকতেই হয়রে বইন...
মোহর : আমি তো তার পরিচয়টারে বিশ্বাস করি নাই, বিশ্বাস করেছিলাম সেই মানুষটারে...
(মোহর কান্নায় ভেঙ্গে পড়বে, ব্যাকগ্রাউন্ডে গানটি শুরু হবে)

গান:

সোনারে মোর জন্ম বৃথা
ফান্দে পইড়া আছি
ঘুম জাগনে ঘোর লাইগা যায়
কেমন কইরা বাঁচি...
চারপাশের এই মানুষগুলা
মিছাই কান্দে হাসে,
মিছাই তারা ঘর বান্ধেরে
মিছাই ভালোবাসে
আমায় নিয়া পার হইয়া যা
মানুষ-কোলাহল
কালো আমার মনের ভিতর
নিত্য ঘোলাজল!
বন্ধুরে তোর এত মায়া
কোথায় রাখি বল ॥

(হঠাৎ মোহর মুখ তুলে তাকাবে, তার চোখে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি। সে উপস্থিত সবার দিকে ঘোর লাগা চোখে তাকাবে, যেন কিছু একটা বলতে বা বুঝতে চায়। সবাই তার দিকে উৎসুক চোখে তাকাবে, কেউ কিছু বুঝতে পারবে না। বাক্কার তার দিকে এগিয়ে যাবে, কিছু একটা বলতে যেতেই মোহর উঠে দাঁড়াবে এবং কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছুটে যেতে থাকবে যেদিক থেকে এসেছিলো, সেই দিকে। বাক্কার যাবে তার পিছুপিছু। গাছ তলায় একাকী দাঁড়িয়ে থাকবে মহব্বতউল্লাহ্। ক্যামেরা মহব্বতউল্লাহর ওপর ফ্রিজ হয়ে যাবে, এখান থেকে পরের দৃশ্যে ডিজল্‌ভড্ হবে)

দৃশ্য-সাতচল্লিশ/ সময়-দিন
বটতলা


(চার বছর পর। একটা গাড়ি এসে থামবে গাছের নিচে। গাড়ি থেকে নেমে আসবে মধু। তার গেট-আপ আগের মতো নয়, ফলে সচরাচর চেনা যাবে না। মধু গাড়ি থেকে নেমে আসতে গিয়ে মহব্বতউল্লাহ্‌কে দেখে চমকে যাবে। মহব্বতউল্লাহ্’র গেট-আপ চার বছর আগের মধুর সাথে প্রায় মিলে যায়। মহব্বতউল্লাহ্ কথা বলছে গ্রামের এক বৃদ্ধের সাথে। তার কথা শুনে মধু অবাক হয়ে যাবে, কারন চার বছর আগে তার সাথে পরিচয়ের শুরুতে মধু তাকে এই কথাগুলোই বলেছিলো)

বৃদ্ধ : বাবা, আমার পোলার জন্যে একটু দোয়া কইরা দেন। বারো মাস এর গায়ে জ্বর লাইগা থাকে
মহব্বত : যার দোয়া তার নিজের চাইতে হয়। আল্লাহ্‌পাক সব সময় যার সমস্যা, তার মুখ থেকে শুনতে পছন্দ করেন।
বৃদ্ধ : আমরা তো দোয়া চাইতেছিই! আমাগো দোয়ায় কী হয়? আপনের সুপারিশের অছিলায় যদি...
মহব্বত : বাবা আপনে কি জানেন? আল্লাহ্‌পাক কোরাআন মজিদে নিজেই বলেছেন, কে আছে এমন যে আমার অনুমতি ছাড়া আমার কাছে সুপারিশ করে?... এখন আমি যে আপনের জন্যে সুপারিশ করবো, আল্লাহ্‌পাক কি সেই অনুমতি আমারে দিয়েছেন?


দৃশ্য-আটচল্লিশ/ সময়-দিন
মাচার ওপর


(মধু ও মহব্বত মাচার ওপর বসে আছে।)

মহব্বত : তারা তো ধরেন চইলা গেল, কিন্তু তার পর থেইকা গেরামে বালা মুসিবত নামতে শুরু করলো। আমি জানতাম এমন হইবো। কামেল লোকের অমর্যাদা! আল্লাহ্‌ কি আর সহ্য করবেন?
মধু : কী রকম বালা মুসিবত?
মহব্বত : মুসিবতের কি আর রকম সকম আছে? ধরেন ছয়মাসে কুত্তার কামড়ে মইরা গেল তিন জন। পানিতে ডুইবা মরছে দুইটা পোলা। আলী’র একটা আধাপাগলি বইন আছিলো। দিন দুপুরে খালের পানিতে নাইমা ডুইবা মরলো। ইদ্রিস মেম্বারের গাভীন গরু সাপের কামড়ে মরলো।
মধু : এইগুলা তো এমনেতেই হইতে পারতো
মহব্বত : পারতো, কিন্তু আগে তো হয় নাই! সব আল্লাহ্‌পাকের ইচ্ছা। ...এরপর থিকা আমার আর সংসারে মন টানে না। বাবার খাদেম হইয়া রাইত দিন এইহানেই থাকি। মানুষজনে আসে, তারারে নিয়া বাবার জন্যে দোয়া-খায়ের করি। যেন বাবায় আবার ফিরা আসে।
মধু : আর সেই মেয়েটার কী হইলো? মোহর? তার স্বামী কি ফিরা আসছিলো?
মহব্বত : আসছিলো, কিন্তু বড় দেরি কইরা ফালাইছিলো।

(মধু চমকে উঠবে, ভয়ঙ্কর বিচলিত হয়ে পড়বে সে। এইখান থেকে ফ্লাশব্যাকে চার বছর আগের সেই রাতের ঘটনার শেষটা দেখা যাবে)


দৃশ্য-ঊনপঞ্চাশ/ সময়-রাত
বটতলা



(গভীর রাত, গাছতলায় একমাত্র মহব্বতউল্লাহ্ বসে আছেন, তার মাথায় গাইছা বাবার ফেলে যাওয়া বিশেষ ধরণের উত্তরীয়। মহব্বতউল্লাহ্‌কে দেখে মনে হবে তিনি ধ্যানমগ্ন কোনো সাধু। বিভিন্নরকম আওয়াজ শোনা যাবে, তার কিছু কিছু স্পষ্ট, কিছু অস্পষ্ট। নানান লোকের সম্মিলিত চিৎকার, হৈহল্লা, কান্নাকাটি... এর কোনোকিছুই মহব্বতউল্লাহ্‌কে স্পর্শ করতে পারছে না। তিনি নিজেতে এতটাই মগ্ন, তার সামনে দিয়ে কে যাচ্ছে কে আসছে খেয়াল করছেন বলে মনে হচ্ছে না। পুরো দৃশ্যটাতে একটা হাহাকার থাকবে, যেন মেলা ভেঙ্গে যাওয়ার পরের শূণ্যতা। হঠাৎ তীক্ষ্ণ কন্ঠের আর্তনাদ শোনা যাবে, মোহররে, আমার মোহররে... এইটা তুই কী করলি... হায় আল্লাহ্‌, আমার মোহর কথা কয়না কেন... বোঝা যাবে মোহর আত্মহত্যা করেছে। লোকজন ছুটে যাচ্ছে মোহরের বাড়ির উদ্দেশ্যে, মহব্বতউল্লাহ্ নির্বিকার। তারও কিছু পরে ত্রিশ-পয়ত্রিশ বছর বয়সী এক লোক ছুটে আসবে বটতলায় গাইছা বাবাকে ডাকতে ডাকতে, মহব্বত কোনো ভ্রুক্ষেপ দেখাবেন না। লোকটা বটতলায় দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদবে, মহব্বতউল্লাহ্‌র পায়ের কাছে উবু হয়ে পড়ে ‘একি হইলো, কেন্ হইলো, আমারে ফিরাইয়া আনলেন যদি, দেরি কেন্ করলেন... আমার মোহররে ফিরাইয়া দেন...’ এই জাতীয় বিলাপ করতে থাকবে, এই লোকটিই মোহরের স্বামী আলাউদ্দিন। হঠাৎ করে মনে হবে, মহব্বতউল্লাহ্ই যেন গাইছা বাবা, আর তিনি যেন সর্বোজ্ঞ- এমন একটি হাসি তার ঠোঁটে লেগে থাকবে)








সমাপ্ত