সোমবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

কপিটাচ্

আমার বন্ধু গিয়াস কিছু করে না।
শুরুতেই একটা ভুল বাক্য লিখে ফেললাম। একটা মানুষ চব্বিশ ঘন্টায় কিছুই করে না- এটা এক কথায় অসম্ভব একটা দাবী। আসলে আমি বলতে চেয়েছিলাম, তার কোনো পেশা নেই। না, এটাও ঠিক হলো না। জীবিকা নির্বাহের জন্য স্বীকৃত পেশা- চাকরি, ব্যবসা বা কৃষিকাজ অথবা অস্বীকৃত কাজ- চৌর্যবৃত্তি অথবা ভিক্ষাবৃত্তি – এর কোনওটাই সে করে না বটে, কিন্তু সে বেকার নয়। বেকার তো নয়ই, বরং অন্য অনেক সাকার (মানে কর্মজীবি আরকি)দের চেয়ে সে বেশি ব্যস্ত, তার আয় রোজগারও মাশা’ল্লাহ ভালো। চার হাজার টাকা দামী সিমকার্ডের যুগেও তার হতে দু’দুটো মোবাইল থাকতো। এখন সিমকার্ড ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায়, তথাপি তার মোবাইল ওই দু’টোই যদিও, তবে সেই প্রথম থেকে এখন পর্যন্ত সে একটা নীতি মেনে চলে। সে কখনও কারো কল রিসিভ করে না। যে’ই কল করুক, নির্বিকারভাবে কলটা কেটে দিয়ে কল ব্যাক করে। অনেক সময় হয়তো ইনকামিং নাম্বারটা আননোন থাকে, সেটা সে চেনার চেষ্টাও করে না। কেন এই বিলাসিতা জানতে চাইলে একদিন বলেছিল, 'আমার তো কোনো অফিস নেই। এই মোবাইল দুটোই আমার অফিস। আর অফিস খরচ তো সব সময় অফিস মালিকেরই চালানোর কথা, তাই না?' যাই হোক, গিয়াসের রোজগার যেমন অনেক ভালো, তার খরচের হাতও দিলখোলা। আমি যেহেতু এখন পর্যন্ত কমপ্লিট বেকার এবং ঠিক কবে নাগাদ এই বেকারত্ব দূর করা সম্ভব হবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই, সুতরাং আমার প্রায়ই গিয়াসের সাথে দেখা করতে হয়, টাকা ধার করতে হয়। বেকার বন্ধুদের টাকা ধার দেয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতিগুলোর একটা হচ্ছে, যে অংকের ধার চাওয়া হবে তার চেয়ে সামান্য বেশি টাকা দেয়া এবং অমায়িক হাসির সাথে জুড়ে দেয়া, 'আমার কাছে আবার ধার বলতে হবে কেন? দিস, চাকরি পেলে শোধ করে দিস, নয়তো কোনো চাপ রাখিস না। আমার ওপর তোর দাবী আছে না?...' বুদ্ধিমান বেকার বুঝে ফেলে, আর দাবী করা যাবে না। গিয়াস টাকা দেবার সময় এমন করে না। বরং এমনভাবে টাকাটা দেয়, যেন পুরনো ধার শোধ করছে কিংবা আমার হাত দিয়ে তার গ্রামের বাড়িতে বাবা-মা’র কাছে টাকাটা পাঠাচ্ছে।
গিয়াস কোথায় থাকে আমার জানা নেই, সে আমাকে কোনোদিন তার বাড়িতে নিয়ে যায়নি। যখনই তাকে ফোন করি, তা মাসে অন্তত দু’বার তো করতেই হয়... বাজার দর যে পরিমাণ বাড়ছে, অদূর ভবিষ্যতে তিন চারবারও করতে হতে পারে! শালার একটা গোল্ডলিফ সিগারেটের দামও ৪ টাকা! আর রিকশাওলারাও যা নবাব হয়েছে একেকটা- সেদিন মালিবাগ থেকে রামপুরার ভাড়া ত্রিশ টাকায় বহু কষ্টে রাজি করিয়ে রিকশায় বসে একটা গোল্ডলিফ ধরাতেই রিকশাওলা ম্যাচটা চাইলো। তারপর মুখের সামনে ফট করে একটা বেনসন ধরিয়ে ফেললো! ম্যাচটা ফেরত দিতে দিতে ধোঁয়া ছেড়ে বলে কিনা, লাইটস্‌-এর সাপ্লাই কইমা গেছে মামা, এই ইলাকায় নাইক্কা। হের লাইগাই রামপুরা যাইতে রাজি হইলাম। রামপুরায় এবেলেবেল
আমার তো মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়, রিকশাওলা রিকশায় প্যাডেলে পা চড়িয়ে বলে, রিকশা টাইনা জুত হয়না মামা, হের লাইগা লাইটস টানি। লাল বেনসনের ধক বেশি হয়া গেছে। হালার পুতেরা দাম বাড়াইতাছে আবার মালও দিতাছে দুই নাম্বার! ... তো এই পরিস্থিতিতে ইজ্জত সম্মান বজায়ে রাখার জন্যই গিয়াসকে ফোন দিতে হয়। আর ফোন করলেই দুটো কমন জায়গায় তাকে পাওয়া যায়। এক হল বেইলি রোডের মহিলা সমিতির গেটের কাছে, নয়তো শান্তিনগর চৌরাস্তায়। দিনরাত এই এলাকায় দাঁড়িয়ে বা বসে থেকে কী করে সে এত টাকা রোজগার করে, তা আমার অনেকবার জানতে ইচ্ছে হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন করিনি। আমার দরকার টাকা, সেটা তার কাছে চাইলে পাওয়া যায়। যা চাই তারচেয়ে বরং বেশিই পাওয়া যায়। কীভাবে পাওয়া যায়, তার উত্স সন্ধান করতে গিয়ে যদি আম ছালা দুটোই যায়? প্রাচীন প্রবাদে তো আর এমনি এমনিই লিখেনি- দুধ দেয়া গরুকে খোঁচাতে নেই, তাতে লাথি যেমন খেতে হয়, তেমনি দুধ খাওয়াও বন্ধ হয়ে যায়।
এমনি একদিন সন্ধ্যা নাগাদ গিয়াসকে ফোন করতেই সে কল ব্যাক করে ডাকলো, বেইলি রোডে আয়। আমি মহিলা সমিতির সামনে আসতেই সে আমাকে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে রওনা দিল সিদ্ধেশ্বরীর দিকে। যেতে যেতে আমি প্রশ্ন করলাম,
‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
‘আমি যাচ্ছি স্টুডিওতে, তুই যাচ্ছিস আমার সাথে’।
‘ফটো স্টুডিও?’
‘না, অডিও রেকর্ডিং স্টুডিও’।
‘তুই স্টুডিওতে কী করিস?’
‘ওখানেই তো আমার কাজ। ওটাই আমার পেশা’
‘মানে? তুই কি গান গাস, নাকি বাজাস?’
‘কোনোটাই না। আমি অ্যারেঞ্জ করি’।
‘যাক, এদ্দিনে জানলাম তুই তাহলে মিউজিক অ্যারেঞ্জার’।
‘আরে না ব্যাটা, মিউজিক অ্যারেঞ্জার অনেক বড় ব্যাপার। আমি অত বড় কিছু করি না...’
‘তাহলে? তোর কাজটা কী?’
'ধর তক্তা মার পেরেক বুঝিস?'
'তার মানে?'
‘চল, দেখবি’।
গলির পর গলি, তস্যগলি পার হয়ে এক জরাজীর্ণ বিল্ডিংয়ের সামনে গিয়ে আমরা থামলাম, বাইরে একটা সাইনবোর্ড ঝুলছে- সপ্তসুর সঙ্গীত নিকেতন। গিয়াস কলিং বেল না বাজিয়ে মোবাইল বের করে কল দিল। কলটা রিসিভ করা হলো না, তবে সদর দরজা খুলে গেল। বাইরের ঘরে মেঝেতে বসে কিবোর্ডে চলতি হিট হিন্দী গানের সুরে কিছু একটা বাজানোর চেষ্টা করছে মাঝ বয়সী এক লোক। এই লোককে শান্তিনগর চৌরাস্তায় প্রায়ই গিয়াসের সাথে সন্দেহজনক নিচু গলায় কথা বলতে শুনেছি। আমি ভাবতাম লোকটা বড়জোর কোনো মুদি দোকানদার কিংবা সদরঘাট টু গাজিপুর রুটের “সুপ্রভাত” বাসের ড্রাইভার হবে হয়তো। এখন দেখি ব্যাটা কিবোর্ড বাজাচ্ছে, সুরটা নকল হলেও বাজনার হাত ভালোই। গিয়াস তার দিকে সালামের ভঙ্গিতে হাত তুলেই আমাকে নিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরের একটা ঘরে ঢুকলো। ভেতরে ঢুকে দেখি সেটা একটা রেকডিং স্টুডিও। দেয়ালে চট দিয়ে গদির মতো করে মুড়ানো, এমনকি দরজার ভেতর দিকটাও তাই। মেঝেতে মোটা কার্পেট। একপাশে একটা বিশাল টেবিলে কম্পিউটার মনিটর, আরো নানান রকম যন্ত্রপাতিতে ঠাসা, যেন কোনো বিমানের ককপিট আর সামনে সাজানো কন্ট্রোল প্যানেলের সুইচ বোর্ড। ছোট বড় গোটা চারেক স্পিকারও আছে। একটা ছেলে সেই সুইচ বোর্ডের উপর উপুড় হয়ে কী যেন করছে। গিয়াস ঢুকতেই ছেলেটা দাঁত কেলিয়ে হাসলো। গিয়াস খুব একটা পাত্তা না দিয়ে কোনো এক সাজ্জাদ ভাইয়ের খোঁজ নিয়ে জানলো এখনও আসেনি। তাই শুনে মনে হল সে একটু বিরক্তও হল। যাই হোক, আমরা বাইরে বেরিয়ে আসলাম। বাইরে লোকাল বাসের ড্রাইভার কিংবা মুদি দোকানদার টাইপের মিউজিশিয়ান তখন মোবাইলে কার সাথে যেন কথা বলছে। এই সুযোগে আমি গিয়াসকে প্রশ্ন করলাম-
‘এই স্টুডিওর নাম কী?’
‘কপিটাচ্’
‘কী টাচ?’
‘কপিটাচ। কপি বুঝিস না? এখানে বেশিরভাগ কপি গান হয় বলে এটার নাম কপিটাচ। এরকম কপিটাচ ঢাকা শহরে অনেক আছে, সে কারণে এটার নাম সাজ্জাদের কপিটাচ’।
‘ও আচ্ছা’।
ততক্ষণে ঘরের তিন নম্বর সদস্যের ফোনালাপ শেষ হয়েছে। গিয়াস পরিচয় করিয়ে দিল-
‘দশরথ দা, এ হল আমার বন্ধু মন্টু। আর মন্টু, উনি হচ্ছেন দশরথ কর্মকার, মিউজিক ডিরেক্টর’।
আমার বিস্ময়ের সীমা রইলো না। যাকে আমি মুদি দোকানদার কিংবা লোকাল বাসের ড্রাইভার ভেবে বসে আছি, সে আসলে মিউজিক ডিরেক্টর! হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, সত্য সাহা, দেবু ভট্টাচার্য্য থেকে নিয়ে আরডি বর্মণ, বাপ্পী লাহিড়ী, এ আর রেহমান নামগুলো আমার মাথায় এসেই মিলিয়ে গেল। আমার বিবর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে দশরথ কর্মকারের কী মনে হল কে জানে, আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
‘কী নাম বললেন? মন্টু! নামের মধ্যে আর্ট নাই। এই নাম দিয়ে তো সিঙ্গার হইতে পারবেন না। নাম শুইনাই কেউ আর গান শুনতে চাইবো না...’
গিয়াস বাধা দিল,
‘আরে মিয়া, হে গান গায় আপনেরে কইলো কেডা?’
‘গান আবার কেডায় বা গায়... গান তো আমরা গাওয়ায়ে নেই... হে হে’
‘রাখেন মিয়া, সবাইরে মুরগা ভাবেন কেন?’
দশরথ বাবু যেমন, আমিও কিছুটা থতমত হয়ে গেলাম। চুপ থাকাটাই সমীচিন ভেবে কথা বললাম না, দশরথ বাবুও চুপ। গিয়াস পকেট থেকে একটা বাশপাতা খাম বের করলো, তার ভেতর থেকে কয়েকটা ছবি দশরথের কিবোর্ডের উপর ফেলে বললো-
‘সাত দিনের মধ্যে পুরা অ্যালবাম করা লাগবো, পারবেন তো? এই হইলো সিঙ্গার। বিদেশী পাট্টি, মাল ভালো দিবো। মাইয়া নিজেই প্রডিউসার’।
দশরথ ছবির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর নিজের মনেই বললেন,
‘ছবি দেইখা গানের গলা বুঝবো ক্যামনে? সাথে আনতে পারলেন না?’
'ফালতু কথা বাদ দেন মিয়া। গানের গলা বুঝার কাম কী? গান কি হে গাইবো, না আপনি গাওয়াইবেন? সুরে পড়লে বোনাস, না পড়লে আপনের যন্ত্রপাতি আছে না? অটো টিউনার মারবেন, কম্প্রেশার মারবেন... ব্যাস। আপনেরে টাকা দিতেছি ক্যান?
‘সেইটা ঠিক আছে, তাও... মানে...’
‘আবার মানে মুনে কী? হে গাইবো ট্যাকা দিয়া, আর আপনি পাইবেন ট্যাকা। কার দায়িত্ব বেশি?... ছবি দেখাইতে আনলাম, চেহারা সুরত ভালো, মিউজিক ভিডিও বানাইতে আলাদা কইরা মডেল পেমেন্ট দেওন লাগবো না। সাজ্জাদ ভাইরে কইলাম আমার টাইম নাই, লেট কইরেন না...’
‘যাকগা, বাদ দেন। মাইয়ার নামটা কী?
‘নাম দিয়া কী করবেন?’
‘আরে এত চ্যাতো ক্যান? প্রজেক্ট সেইভ করতে নাম লাগবো না?’
‘একটা নামে সেইভ করলেই তো হয়... বাদ দেন। মেয়ের নাম ব্যাস বাসন্তী ..’
‘কী কইলা? ব্যাস বাসন্তী! এইটা আবার ক্যামুন নাম রে বাবা!’
‘কেমুন নাম মানে? ওই মিয়া কেমুনের কী দেখলেন? ন্যাশ নাসরিন হইতে পারে, মাস মাসুম হইতে পারে, ব্যাস বাসন্তী হইলে অসুবিধা কী?’
দশরথ বাবু এই একের পর এক আক্রমণে মনে হয় ক্লান্ত। একটু ক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন-
‘ঠিক আছে, তাইলে সিঙ্গারের নাম ব্যাস বাসন্তী, আর মিউজিক ডিরেক্টর ড্যাশ দশরথ!’
আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না, বলে উঠলাম-
‘একটু বাদ পড়লো দাদা, সিঙ্গার ব্যাস বাসন্তী, মিউজিক ডিরেক্টর ড্যাশ দশরথ আর অ্যারেঞ্জার গ্যাস গিয়াস!’
গিয়াস চিত্কার করে উঠলো-
‘ওহ্ হোয়াট আ ক্যাচ!’
আমি গলা মেলালাম-
‘এই না হলে কপিটাচ!’

রবিবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

গল্ফ

ক্রিকেট বিশ্বকাপ আসন্ন। আমরা এবার প্রথমবারের মতো স্বাগতিক। চারিদিকে হট্টগোল। আক্ষরিক অর্থেই হৈহৈ কান্ড রৈরৈ ব্যাপার। এই হুলুস্থুলের মধ্যে ক্রিকেট ছেড়ে গল্ফ নিয়ে আলোচনা করা আর মিলাদ মাহফিলে বসে থাকা অবস্থায় চাইনিজ মোবাইলের (এক্সট্রা লাউড!) রিংটোনে “ও টুনির মা তোমার টুনি কথা শুনে না...” বেজে ওঠা সমান কথা। না করেও পারছি না। আমার কলিগ ইউসুফ ভাই একটু আগে কী প্রসংগে যেন গল্ফের কথা পাড়তেই আমি বললাম, এই খেলাটার আমি কিছুই বুঝি না। সিদ্দিকুর রহমান সম্প্রতি খুবই ভালো খেলছেন এটা জেনে গর্ব হয় অনেক, কিন্তু কেন বা কীভাবে তিনি ভালো খেলছেন, সেটা বুঝতে পারি না বলে বিব্রতও হতে হয়। অবশ্য বিব্রত হবারই বা কী আছে? ৯৭ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন হয়ে কিংবা ৯৯ ও ০৭ বিশ্বকাপে পাকিস্তান ও ভারতকে হারিয়ে গোটা দেশ যখন আনন্দে উদ্বেল, প্রতিবারই আমার মা সমান উত্সাহে চিত্কার করেছেন খেলাটার বিন্দু-বিসর্গ না বুঝেই! তাঁর যুক্তি খুবই স্পষ্ট- বাংলাদেশের ছেলেরা জিতেছে, বাংলাদেশ জিতেছে, খুশি হবার জন্য এটাই যথেষ্ট, কীভাবে জিতলো তাতে কী আসে যায়? ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে জেতার জন্য আমরা আনন্দ করিনি? সেই যুদ্ধটা আমরা কে কতটা বুঝতাম!

তো, এইসব কারণেই দূর্বোধ্য খেলা গল্ফটাকে বোঝার জন্য খুব একটা তাগিদ’ও অনুভব করিনি তেমন। কিন্তু ইউসুফ ভাই নিজে যেহেতু খেলাটা বোঝেন, শিখেছেন কষ্ট করে, হয়তো মোটামুটি ভালো খেলতেও পারেন, সুতরাং তিনি আগ্রহী শিক্ষকের মতো নিয়মকানুনগুলো শেখানোর চেষ্টায় লেগে গেলেন। আমার “বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম” খুব একটা অগ্রসর হতে পারলো না, কেননা সাকিব তাকে ধরে নিয়ে গেল ধূমপানের সঙ্গী করে (সিগারেট ছেড়ে দেবার পরও আমি সিগারেটের কুফল থেকে বাঁচতে পারছি না... কী মুশকিল!)। সে যেটুকু যা বুঝলাম, তা থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগের একটা স্মৃতি ধাঁই করে ফিরে এলো হঠাৎ।

আমি তখন ক্লাস থ্রি কি ফোরে পড়ি। আমাদের বাসা থেকে খুব কাছের দোকানটা প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। যেতে হতো এ পাড়া দিয়ে, ও পাড়া ঘুরে কলোনীর গেট পেরিয়ে, শেষ কিছুটা অংশ বড় রাস্তা দিয়ে। প্রায়ই টুকটাক সদাইপাতির জন্য আমাকে দোকানে যেতে হতো, বলাই বাহুল্য পায়ে হেঁটে। আমি এই এক কিলো হাঁটবার কষ্টটাকে গায়ে মাখতাম না, বরং ব্যাপারটা এনজয় করতাম। সে কারণেই বোধ হয়, একেকবার আপ-ডাউন করতে আমার লেগে যেত দেড় থেকে দু’ঘন্টা! এমনও হয়েছে, চুলায় ডাল বসিয়ে আম্মুর খেয়াল হয়েছে লবণ নেই, আমি যথারীতি লবণ কিনতে দোকানের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে, মাঝপথে পাঁচ ওভার ক্রিকেট খেলে, আউট হয়ে এবং সেই আউটটা বৈধ ছিল, নাকি আম্পায়ার “পার্শিয়াল্টি” করেছে তা নিয়ে বিস্তর ঝগড়া বিবাদ করে, শেষমেষ দোকানে গিয়ে পকেটে হাত দিয়ে পয়সাটা মাঠেই কোথাও পড়ে গেছে আবিস্কার করে, আবারও প্রায় হাফ কিলো (এবার দ্রুত পায়ে) হেঁটে বাবার অফিসে গিয়ে তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে লবণ কিনে বাসায় পৌছে দেখি সবার দুপুরের খাওয়া শেষ!

তো, তেমনি’ই একদিন দোকানে যাচ্ছিলাম কিছু একটা কিনতে। রাস্তায় কনডেন্সড মিল্কের একটা খালি কৌটা পড়ে থাকতে দেখে পা দিয়ে সেটাকে লাথি মারতে শুরু করলাম। আমার টার্গেট হলো রাস্তার একেকটা ভাঙ্গা গর্তে কৌটাটাকে নিয়ে ফেলতে হবে, এক গর্ত থেকে আরেক গর্তে নিয়ে ফেলতে একটার বেশি লাথি খরচ করা যাবে না। সম্ভব হলে এক লাথিতে দু’তিনটে গর্ত পার করতে হবে। টিনের তৈরি খালি কৌটা এবড়োখেবড়ো পাকা রাস্তার উপর দিয়ে ছ্যাঁচড়া খেতে খেতে তারস্বরে চিত্কার করে আপত্তি জানাচ্ছে, সেই আওয়াজে চারপাশ প্রকম্পিত! আমার তাতে আনন্দের সীমা নেই! কায়দা করে এমনভাবে লাথি মারছি, যেন মাটি থেকে অনেকটা উপরে উঠে যায়, যাতে করে ভূপাতিত হবার সময় শব্দ হয় বেশি। আমার টার্গেট হলো, দোকানগুলো যেখান থেকে শুরু হয়েছে, তার কাছাকাছি একটা বড় ম্যানহল। সেখানে ফেলতে পারলেই আমার “পার” কমপ্লিট।

লাস্ট হোলের প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছি, এমন সময় কিছু বুঝে ওঠার আগেই কানদুটো গরম হয়ে গেল, বাঁই করে মাথা ঘুরে পড়ে যাবার দশা। একটু পরে “চটাশ!” শব্দটা শুনলাম (ব্যাটা থাপ্পড়টা মেরেছিল শব্দের চেয়েও দ্রুত গতিতে!)। তাকিয়ে দেখি মাঝবয়সী এক লোক, রাগে দাঁত কিড়মিড় করে তেড়ে আসছে আমার দিকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আরেকবার চটাশ! সরে যাবারও সময় পেলাম না। তারপরই শুরু হলো তার খিস্তিখেউড়! “.... এর বাচ্চা, ...এর পুত... কানের পোকা মার‌্যা দিছে! এ ...র ব্যাটা, এড্যা কি তোর বাপের রাস্তা পাছু? ...র ভাই...”।

হে পৃথিবী দ্বিধা হও, নয়তো কেউ একজন লাথি মেরে আমাকেই ওই গর্তটাতে ফেলে দিয়ে হোল পূর্ণ করো! আশপাশের সমস্ত লোক দাঁত কেলিয়ে হাসছে আমার দূর্গতি দেখে, একটা ব্যক্তিও নেই আমার পক্ষে কথা বলার, নিদেনপক্ষে সহানুভূতি জানাবার...।

আজ হঠাৎ এই ঘটনা মনে পড়াতে নিজের মনেই হাসলাম। যে কাজটা করতে গিয়ে নাবালক বয়সে আমি ভরা বাজারে থাপ্পড় খেয়েছিলাম, অপমানের চূড়ান্ত হয়েছিলাম, সেই একই কাজ করে টাইগার উডস্, সিদ্দিকুর রহমান’রা বিশ্বব্যাপি সম্মানিতই শুধু নন, লাখো কোটি টাকার মালিকও বনে যাচ্ছেন!

আহারে, গল্ফটা যদি সময় মতো বুঝতাম! আফসোস!!

বুধবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

এসো আমার দেশে, ক্রিকেট ভালোবেসে

নানান বরণ মানুষরে ভাই নানান তাদের ভাষা
একটা কাপের লড়াই মাঠে, মনেতে এক আশা

।। এসো আমার দেশে ও ভাই এসো আমার দেশে
এসো আমার দেশে সবাই ক্রিকেট ভালোবেসে ।।

মাঠের খেলা ব্যাটে বলে জমবে লড়াই দলে দলে
মাঠের বাইরে মিলবো গলে জয় পরাজয় ভুলে
বিশ্বসভায় লাল-সবুজের নিশানটা দাও তুলে ।।

।। এসো আমার দেশে ও ভাই এসো আমার দেশে
এসো আমার দেশে সবাই ক্রিকেট ভালোবেসে ।।

চলবে লড়াই ছক্কা চারে ক্যাচ, রান আউট, বাউন্সারে
শতক নাকি উইকেট ঝড়ে মাতন ক্রিকেটজ্বরে
বিশ্ব-ক্রিকেট-যুদ্ধ যে আজ আমার ছোট্ট ঘরে ।।

।। এসো আমার দেশে ও ভাই এসো আমার দেশে
এসো আমার দেশে সবাই ক্রিকেট ভালোবেসে ।।

সুর: ফোয়াদ নাসের বাবু

বিশ্বকাপ ক্রিকেট উপলক্ষে দেশ টিভি'র ফিলার তৈরির জন্য নির্মীতব্য গানের লিরিক

নেশা

আমার ছোট্ট লাটিমটাকে আমি খুঁজিনা কতকাল!
বাজারের পয়সা মেরে বানানো
জীবনের প্রথম রোজগার থেকে কেনা
যক্ষের ধন সেই লাটিমটার কথা আমি ভুলেই গেছিলাম
জাবেদ ভাইয়ের ভয়ানক দাঁতাল লাটিমের ঘা খেয়ে ছাল উঠে যাওয়া
লাটিমটাও কি ভুলে গেছে আমাকে?
নাকি অলক্ষ্যে আজও সে অপেক্ষায়
নাকি প্রতীক্ষায় থাকে-
একদিন বুঝি আমি সত্যিই খুঁজবো তাকে...
হয়তো এই আশপাশেই
কোথাও সে আছে অভিমান করে
খুব বেশি খুঁজতেও হবে না, শরতের বৃষ্টির মতো ঝরিয়ে ফেলে অভিমানটুকু
চাইলেই সে ধরা দেবে হাতের মুঠোয়...
তবু আমি খুঁজিনা... কেন যে!
স্বীকার করি যে
আটআনা পয়সার আজকাল আর
মোটেই কোনও দাম নেই
তাছাড়া সে পয়সাও এমন কিছু শ্রমের ঘামের ছিল না
নিতান্তই অসম্মানের উপার্জন
তবু সে ছিল আমার প্রথম অর্জন!

মাঝে মাঝে মনে হয়
আমার শেষ সিগারেটটা বুঝি অভিশাপ দেয় আমাকে
উপেক্ষার অপমানে নিষ্ফল গুমরে গুমরে
অভিশাপ দেয়!
আমি এমনকি তাকে পুড়িয়েও মারিনি
স্রেফ ফেলে দিয়েছিলাম অবহেলে...
আমি বড় অল্পেই মুখ ফিরিয়ে নেই
নয়তো আঠারো বছরের সম্পর্ক কেউ এভাবে
এক কথায় ভেঙ্গে দিতে পারে?

আমার শরীরের সবচে’
অপছন্দের প্রতঙ্গ বুঝি আমার হাতদুটো
যতটা আবেগ এই বুকে
যতটা মায়া আমার ক্ষুদ্র চোখদুটোয়
আর যতখানি উদগ্র বাসনা আমার হৃদয়-মন আর শরীর জুড়ে
তার সাথে এই হাতদুটো বড় বেমানান
কত কিছুই তো জানে এরা
জানেনা শুধু আঁকড়ে ধরতে কোনও কিছু

আমি আমার অসীম
একাকীত্বের মাঝে ঘুরপাক খেতে খেতে
ক্লান্ত হই
শ্রান্ত হই
আতঙ্কিত হই...
আমার কোনও নেশা নেই!
নেই সুতীব্র বাসনা,
সুগভীর বেদনার একান্ত অনুভব...

উদগ্র কামনায় আঁকড়ে ধরার কোনো তাড়না যার নেই
তাকে আদৌ মানুষ বলা যায় কি?