বুধবার, ১১ নভেম্বর, ২০০৯

যখন বেলা শেষের ছায়ায়...(টিভি নাট্যরূপ)

(দ্রষ্টব্য: এই নাটকের পাত্রপাত্রীরা প্রায় সবাই দিনাজপুর থেকে আগত হবার সুবাদে নাটকের অধিকাংশ সংলাপ দিনাজপুরের গ্রামীণ কথ্যভাষায় লিখিত। আশা করি পাঠকের জন্য খুব বেশি দূর্বোধ্য হবে না।)


দৃশ্য: এক
এয়ারপোর্ট ভবনের প্রবেশপথ


[দুটো ট্যাক্সি ক্যাবে করে একদল লোক এসে পৌঁছুবে, সিকিউরিটির বাধার মুখে রবিন এবং কাজল ছাড়া আর সবাইকে ট্যাক্সি থেকে নেমে যেতে হবে। ট্যাক্সি দুটো টার্মিনাল ভবনে ঢুকে গেলে বাকিরা হত-বিহ্বল চেহারায় দাঁড়িয়ে থাকবে]

ইন্টারকাট

[রবিন ও কাজল ট্যাক্সি থেকে বেশ বড় কয়েকটা লাগেজ নামাচ্ছে]

রবিন : এইটা ফির কের্‌কম হইল্‌! অরা যদিল ঐঠে খাড়া থাকে তো আসিয়া কাম কী হইল্‌?
কাজল : তুই চুপ করি বসেক তো অ্যালা, ঐলা মুই দেখোছোঁ।
রবিন : কেম্বা করি কী দেখিবু? পেসেঞ্জার ছাড়া বেলে কাকো ঢুকিবা দিবা নাহায়!

ইন্টারকাট

[দলের সবাই লোহার গ্রীলের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, বোরকা পরা রবিনের মা ক্রমাগত কাঁদছেন, রবিনের বাবা’ও বিচলিত, ছোট ভাইবোন, শাহেদ-কামাল কিংকর্তব্যবিমূঢ়, তবে সবচে’ অস্থির অবস্থা হলো আকবর চাচা’র]

আকবর : এ-এ-শ্! কাকো ঢুকিবা দিবা নাহায়? কাথা একখান কহি দিল্‌ আর হই গেইল্‌! হামেরা এদ্দূর পথ ছুটি আসিনু কি এত্তি খাড়া থাকিবা তনে?
রশীদ : মোর ছোয়াকোনা আমরিকাত চলি যাছে, মুই তাক এত্তি খাড়া থাকি বিদায় করিম- এইটা কী বিচার?
আকবর : কান্দিনা বারে কান্দি না। মুই দেখোছোঁ কিবা করি ভিতরত ঢুকি পড়া যায়।

ইন্টারকাট

কাজল : তোক কিছু দেখিবা হোবে না। তুই এত্তি বেগ-বোচকা ধরি খাড়া থাক। মোক্‌ অ্যালা বিরইল্যা বেরেনে কাম করিবা দে।
রবিন : কী করিবু তুই?
কাজল : খাড়া থাকি দেখেক।

[কাজল চলে যায়, টাইটেল মিউজিক শুরু হয়]

টাইটেল

[টাইটেলের ভেতরে দেখা যায়, সিকিউরিটির লোকজনদের সাথে কাজল নানান ভঙ্গিমায় হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে, বিশেষ কায়দায় হাত মেলাচ্ছে, বাকিরা সবাই গেট পার হয়ে ভেতরে ঢুকছে। আবার দেখা যাবে, কাজল কোত্থেকে এক উর্দ্ধতন কর্মকর্তাকে ধরে নিয়ে আসবে, তিনি রবিনসহ গোটা দলটাকে মেইন বিল্ডিংয়ের ভেতরে ঢুকিয়ে দেবেন। সবাই সিকিউরিটি চেকপোস্ট পার হয়ে ভেতরে এলে টাইটেল শেষ হবে]


দৃশ্য: দুই
এয়ারপোর্ট ভবনের ভেতরে


[দলের সবাই এয়ারপোর্ট বিল্ডিংয়ের ভেতরে এসে বসেছে। রবিন আর কাজল ছাড়া বাকি সবাইকে দেখা যাবে]

আকবর : হয় বারে, ঠিকে কহিছেন। এই দ্যাশত তামাল্লায় সম্ভব। খালি সিস্টেম করি চলিবা হোবে।
রশীদ : ঠিকে ঠিকে। তয় ছোয়াকোনার বেরেন আছে যা হউক। কেম্বা করি সবাকে মেনেস করি ফালাইছে, দেখিছেন?
আকবর : মেনেস তো আর অয় করে নাই, মেনেস কইছে তো পাইসা। পাইসায় করে কাম, মদ্দের হয় নাম।
রশীদ : কী বারে কামাল, রবিন কোটে? অয় কাজলক ধরি কইত্‌ গেইল বারে?
কামাল : ফ্লাইটের খোঁজ নিতে গেছে।
আকবর : এইটা খোঁজ নিবারে ফির অত্তি যাবা হোবে? কাখো পুছ করিলে হইল!
শাহেদ : এইটা আপনার দিনাজপুর না চাচা, বাহাদুর বাজারে খাড়া থাকি পুছ করবেন, ঢাকা মেলের খবর হইছে? আর যে সে লোকে কই দিবে।

[আকবর অপ্রস্তুত হয়ে যাবেন, কামাল হেসে উঠবে। তাই দেখে রশীদ বিরক্ত হবেন। তিনি অকারণেই কামালকে বকা দিবেন]

রশীদ : রবিন ওত্তি ফেলাইটের খোঁজ নিবা গেইল্‌, কাজল সবারে ভিতরে ঢুকা মেনেস করিল, তোমরা খাড়া থাকিলেন ক্যান বারে? তোমরা কি এইঠে খাড়া থাকিবা তনে আইছেন?
আকবর : রশীদ মিয়া, এর্‌কম করি কাথা কইছেন কেন বারে? তোমার ছোয়া কি তোমার একারে নাকি? অদেরও তো দোস্ত হোবে নাকি? তোমার ছোয়া আমরিকাকাত চলি যাছে, তাই দেখি অরা আইছে বিদায় দিবা; তাতে তোমার কেন জ্বলেছে বারে?
রশীদ : মোর জ্বলিবে কেন বারে, মোর তো আমোদ নাগেছে। মোর ছোয়া মোক ছাড়ি সাত সমুদ্দুর পার হই চলি যাছে, মোর তো আমোদ নাগেছে!
আকবর : আমোদ তো নাগিবেই! আশপাশের দশ বিশটা গেরাম খুঁজি দেখেক, এরকম আর একখান ছোয়া খুঁজি পাবেন নাহায়। কী কাথা বারে, মোর বয়েস পোচ্‌পান্ন ছাড়ি গেইল, মোর অ্যালাও চট্টগ্রামেতই যাওয়া হলি না বারে, আর হামারে রবিন মাত্র পঁচিশ বচ্ছর বয়সে আমরিকার মতোন দ্যাশত চলি যাছে!
কামাল : ডিভি লাগলে ওরকম যাওয়াই যায়...
আকবর : এ...শ্‌...! কাথা একখান কহি দিল্‌, আর হই গেইল্‌! কেন বারে, মোর দ্যাশত কি ডিভি এইটা পয়লাবার লাগিল নাকি? সামাদ মিয়ার ছোয়াটাও তো বেলে ডিভি পাইছোলো, তোমারে শাহিনা বু’র স্বামী তো এখন যাছে কি তখন যাছে। আসাদ মুন্সীর বেটার বেলে কাগজপত্র তামাল্লায় ঠিক, খালি পেলেনেত কোন ছিটটাত বসিবে- এইটা ঠিক করিবা পাছে না... এইল্লা কাথা শুনি শুনি মুই মানুষ হই গেনু! “ডিভি লাগেলে ওরকম যাওয়াই যায়!”

[রবিন আর কাজলকে দেখা যাবে ব্যস্ত ভঙ্গিতে এদিকেই আসছে। ওরা কাছে আসতেই আকবর গলা চড়িয়ে ডাকবেন]

আকবর : কী হইল বারে, তোমারে ফেলাইট কতদূর?
রবিন : ফ্লাইট চার-পাঁচ ঘন্টা লেট হবে চাচা। টেকনিক্যাল প্রবলেম।
রশীদ : কী প্রবলেম?
রবিন : বললো তো টেকনিক্যাল....
আকবর : হয় বারে! গেট পারাইতে টেকনিক, বিল্ডিংয়ে ঢুকিবা টেকনিক, এখন ফির বেলে পেলেনত উঠিবাতনেও টেকনিক করিবা হোবে!
কাজল : এই টেকনিক সেই টেকনিক নাহায় চাচা।
আকবর : নাহায় তো ফের কি? গোটাল দুনিয়াটাই হই যাছে টেকনিকাল!
কাজল : আরে চাচা, আপনি যেইটা ভাবেছেন, সেইটা নাহায়, ওমার বিমানেত কোন যন্ত্রপাতি নষ্ট হই থাকিবা পারে, চাক্কার মধ্যে হাওয়া কম হই গেইছে হয়তবা, পাইলট আসিবারে লেট করেছে হয়তো...

[শেষ দিকের কথাগুলো ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে যাবে, কামালকে দেখা যাবে ভীষণ চিন্তিত ভঙ্গিতে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে তার ভেতর থেকে একটা বাস-টিকেট বের করছে। টিকেটটা উল্টে-পাল্টে সে দেখতে থাকবে আর দলের বাকি সবার দিকে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে। সবাই কী নিয়ে কথা বলছে তা যেন তার মাথায় ঢুকবে না। এক পর্যায়ে সে আপন মনে হাঁটতে হাঁটতে দলের সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে]

দৃশ্য: তিন
দলের অন্য সবার থেকে পৃথক কোন স্থান

[কামাল দলের সবার কাছ থেকে একটু আলাদা হয়ে আপন খেয়ালে হাঁটছিলো, হঠাৎ শুনতে পাবে শাহেদ তাকে ডাকছে। সে ফিরে তাকাবে]

শাহেদ : কিরে, কই যাস? তোর হইছে কী?
কামাল : কিছু হয় নাই।
শাহেদ : কিছু তো মনে হয় হইছে। হঠাৎ তুই চলে আসলি এই দিকে? কী চিন্তা করতেছিস?
কামাল : [কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকার পর] রবিনের ফ্লাইট দেরি হবে?
শাহেদ : তাই তো বললো। ক্যান তুই শুনিস নাই? তোর সামনেই তো বললো।
কামাল : [বিরক্তিসুচক শব্দ করবে]
শাহেদ : তোর সমস্যাটা কী? লেট করলেই তো ভালো। আবার কবে আসে না আসে তার ঠিক আছে? একটু বেশি সময় থেকে গেল! আমার তো মনে হয় আবার আসেই কিনা!
কামাল : সেটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু আমার তো দশটার বাসে টিকিট করা আছে। দশটার মধ্যে যদি ওর ফ্লাইট ওকে না হয়?
শাহেদ : আরে, দশটা বাজতে এখনও অনেক দেরি।
কামাল : কিসের দেরি! এমনিতেই ফ্লাইট ছাড়ার কথা সাড়ে চারটায়। পাঁচ ঘন্টা লেট মানে কি? সাড়ে নয়টা। বাংলাদেশের লেট আবার ঘড়ি-ঘন্টা মানে নাকি?
শাহেদ : [কিছুক্ষণ চুপচাপ ভাবার পর] তুই পন্ডিতি করে টিকিট করতে গেছিলি ক্যান? বুকিং দিয়ে রাখতি?
কামাল : আরে তখন কি বুঝছি নাকি এরকম হবে। তাছাড়া... টাকা থাকতেছে না।
শাহেদ : থাকতেছে না মানে? কই যাচ্ছে?
কামাল : [বিরক্ত, উত্তেজিত] উড়ে যাচ্ছে। দিনাজপুর থেকে ঢাকা আসতেই ছয়শ টাকার বেশি খরচ হয়ে গেছে। টিকিট না করলে যাওয়ার ভাড়াও থাকতো না।
শাহেদ : এত কী খরচ করলি?
কামাল : কী আবার, যা দেখি তাই কিনতে ইচ্ছা করে। রবিনেক একটা মানিব্যাগ গিফট করলাম, দেড়শ’ টাকা দাম। রবিন কইলো, আইসক্রিম খাবি?... আইসক্রিম খায়ে জোর করে বিল দিবার যায়ে দেখি বিল হইছে আশি টাকা! এইটুক দুই বাটি আইসক্রিমের দাম আশি টাকা!

[রবিন গলা চড়িয়ে ডাকতেই শাহেদ কিছু না বলে চলে যাবে। কামাল কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে উল্টো ঘুরে হাটতে থাকবে। চেয়ারে বসে থাকা সাজ্জাদের OS থেকে তার উদ্দেশ্যবিহীন হাটতে থাকা দেখা যাবে। সেখান থেকে ফ্রেম ওয়াইড হলে সাজ্জাদকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রবিনদের দলটার দিকে তাকাতে দেখা যাবে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে ক্যামেরা প্যান করে দলটাকে ধরবে। কাছাকাছি আসতেই রশীদ সাহেবের কথা শোনা যাবে]

রশীদ : বুঝিলু বাবা, ভালো-মন্দ তামাল্লায় নিজের কাছে। নিজে ঠিক তো জগত ঠিক। নামাজ কালাম ঠিকমতে পড়িবু...
আকবর : ঠিকে কাথা। ঐঠেও কিন্তুক আজকাল অনেক মোছলমান আছে বারে। মর্জিদও হই গেইছে। আরে সেকি আলিশান মর্জিদ বারে! জুম্মার নামাজ মর্জিদে যায়ে পড়িবু। ঐঠেকার মর্জিদ হামারে মতন নাহায়, ঐঠে পেশাবখানাতও এছি ফিট করি থুইছে! এক্কেরে লিগাল কাথা বিয়াই, হেভি আরামের জাগা! একদম ঠান্ডা...
কাজল : ঐ দেশে ঠান্ডাতে আরাম নাই চাচা, সারা দেশটাই ঠান্ডা। আমেরিকার ঠান্ডা মানে কষ্ট!
আকবর : [অপ্রস্তুত] ঠিকে কহিছেন বারে, ঠিকে কহিছেন। কিন্তু বিয়াই, হামারে দ্যাশের মতোন ওত্তি মর্জিদে জুতা-সেন্ডেল চুরি হয়না, এইটা কিন্তুক ঠিক।
রনি : এ ভাই, তুই কিন্তুক যায়েই মোর মোবাইল কিনি পাঠাবু। আর সিডি ওয়াকম্যান একটা।
রীতা : মোর জুতা ভুলিবু না, ভাই। আর একটা কেমেরা দিবু, ফিলিম ছাড়া ছবি উঠে ঐগুলা।
রনি : আরি মোক কোলে কম্পিউটার কিনি দিবা হোবে। সজিবের যেরকম আছে, ওরকম- ছেমছাং
শাহেদ : ছেমছাং নারে বোকা, স্যামসাং। আর ওইটা কম্পিউটারের নাম নারে, ওইটা তো মনিটরের নাম।
রনি : নাহায়, মোক ঐল্লাই দিবা হোবে।
রশীদ : তোরা থামিশ অ্যালা! উল্টা পাল্টা খরচ করিননা বারে। ঐঠে নামিয়াই যা হোউক একখান কাম-কাজ জুটাই নিও। ডলার পাঠাইতে দেরি করিও না। মোর তো দেখি যাছেন, আর কোন উপায় নাই, তামাল্লায় বেচিয়া তোমারে হাতোত দিনু। ডলার না পাঠাইলে না খায়ে থাকিবা হোবে। [রবিনের মা বোরকার আড়াল থেকে নতুন করে কাঁদতে শুরু করবেন] আহারে তুমি ফের কান্দাকাটি শুরু কইছেন কেন বারে?
মা : দেখি শুনি সাবধানে যাইস বাবা, আস্তাত (রাস্তায়) উল্টাপাল্টা কিছু খাইস না... ঠিকঠাক মতে পৌছায় চিঠি দিবু...
রশীদ : এইল্লা কাথা কহিবা বহুত টাইম পাবেন। ফেলাইটের মেলা দেরি।
রবীন : কামাল কই রে? অক তো দেখি না
শাহেদ : অঁয় পড়েছে মাইনকা চিপায়
কাজল : কেন, অর ফের কী হইল?
শাহেদ : শুনিস পরে
রবিন : দেখ তো কই গেল?
কাজল : ওই তো আসতেছে।
শাহেদ : দোস্ত তোমার কপালটা কিন্তু হেভি ভালো। শুরুতেই ক্যালিফোর্নিয়ার মতো শহরে থাকতে পারতেছো। ডিভি জিতে যারা যায়, তাদের বলে শুরুতে টেকসাস ক্যানসাস এইসব বিরান জায়গায় পাঠায়ে দেয়।
কামাল : টেকসাস ক্যানসাস এইগুলা বিরান জাগা তোরে কে কইল?
শাহেদ : কেউ কয় নাই, এমনিই কইলাম।
কামাল : এমনি এমনি একটা কথা কয়ে ফেললি?
শাহেদ : কইলে তোর অসুবিধা কী? তাছাড়া আমি ইংলিশ ছবিতে দেখছি। কেন, তুই দেখিস নাই? ওয়েস্টার্ন গল্পে পড়িস নাই?
কামাল : ছবিতে দেখলে আর গল্পে পড়লেই হয়ে গেল? ছবিতে গল্পে সবকিছু সত্যি থাকে নাকি?
কাজল : যাই বলিস রবিন, তোর ভাগ্য কিন্তু আসলেই ভালো। তোর নামটা নিয়ে অন্তত কোন ক্যাচাল হবে না। শুরু থেকেই তোর নামটা ইংরেজী ধরণের। নাইলে আমেরিকানরাতো বাংলা নামগুলা উচ্চারণই করতে পারে না। কেন পড়িস নাই, হুমায়ূন আহমেদকে উচ্চারণ করে ‘হিউমাউন আহামাড’!
[শাহেদ ছাড়া সবাই হেসে উঠবে]
শাহেদ : হুমায়ূন আহমেদ কি বাংলা নাম নাকি? এটা তো আরবি নাম!

[সবাই আবারও হেসে উঠবে]

আকবর : কামের কাথা শোনেক আগোতে। তোমার পেলেন কি ডাইরেক?
রবিন : না চাচা, এখান থেকে দিল্লী যাবে। ওখানে দু’ঘন্টার ব্রেক। আরো প্যাসেঞ্জার উঠবে। তারপর সোজা নিউইয়র্ক।
আকবর : তারপর?
রবিন : তারপর নিউইয়র্ক থেকে ক্যালিফোর্নিয়ার প্লেনে উঠতে হবে।
আকবর : ওত্তি ক্যালিফোর্নিয়ার পেলেন আলাদা তো? তাইলে ওইটা ঠিকঠাক মতে খুঁজি বাইর করিবা হোবে। তার আগোতে মাল সামানা যা আছে, তামাল্লায় গোনে গোনে বুঝি নিবা হোবে। আর পেলেন খুঁজি না পাইলে এত্তি ওত্তি পুছ করিবেন। কাখো না পাইলে পুলিশোক যাই পুছ করিবেন। ওত্তিকার পুলিশ হামারে মতোন নাহায়, ওরা পাবলিকেক হেল্প করিবাতনে রেডি থাকে। বিদেশী দেখিলে তাক আব্বা কই ডাকে, বুঝিলু? আর পেলেন খুঁজি না পাইলে কান্দি ভরাইয়েন না বারে, পেলেনেতই যাবা হোবে এরকম তো কাথা নাহায়। বাসেত চড়ি যাবা পাবেন, বাসের সিট পেলেনের থাকি কম নাহায়। আর যে আস্তা (রাস্তা)! আলিশান কারবার বারে! আস্তা এর্‌কম ফেলাট, বাসেত চড়ি যাছেন না পেলেনেতই আছেন বুঝা পাওয়াই মুশকিল। ...মোর সমুন্ধির মামা শ্বশুর আমরিকাত থাকে। গেল বৎসর আইছোলো, ওরঠে শুনিনু...
রবিন : কাজল, তোর ঠিক পেছনে.. আস্তে! আস্তে ঘুরিস, যেন্‌ টের না পায়। দ্যাখ, একটা লোক বসি আছে। অনেকক্ষণ ধরি বেটা এদিক লক্ষ্য করি আছে।

[এক এক করে সবাই সাজ্জাদকে দেখবে, সাজ্জাদ যেন বুঝতে পারবে, তাকে সবাই দেখছে; সে ভীষণ রকম নির্বিকার থাকবে। সবাই আবার নিজের নিজের জায়গায় ফিরে আসবে]

শাহেদ : ছিনতাইকারি নয় তো?
কামাল : দূর, ছিনতাইকারি’র চেহারা এরকম হয় নাকি?
শাহেদ : তুই মনে হয় ছিনতাইকারি দেখছিস কতো?
কামাল : বাস্তবে দেখি নাই তো কি, ফিল্মে দেখছিনা? নাটকে?
শাহেদ : ফিল্মে নাটকে দেখলেই হয়ে গেল? ফিল্মে নাটকে সবকিছু সত্যি দেখায় নাকি?
আকবর : হয় বারে পেপারত পড়েন নাই, এয়ারপোর্টে দুধ্বষ্য ডাকাতি, ডুবাইগামী আর নয়ত সৌদি ফেরত যাত্রীর সর্বস্ব লুট।
রবিন : ঐগুলা অবশ্য এয়ারপোর্টের বাইরে ঘটে।
রশীদ : তালে ঠিক এত্তি বসি আছে মক্কেল ধরিবা তনে। মক্কেল এইঠে থাকি বাইর হইলেই তাক ফলো করি যায়ে কাম সারিবে।
কাজল : আগোত থাকি এইলা ভাবেন নাতো চাচা, নাও হবার পারে। পেসেঞ্জারও তো হবার পারে।
আকবর : পেসেঞ্জার হলি মাল-সামানা থাকিল নাহায়?
কামাল : এইল্লা বড় ব্যবসায়ীদের ব্যাপার কী বুঝবেন? এই ফ্লাইটে দিল্লী যাবে, মিটিং শেষ করি ফির রাতের ফ্লাইটে ফেরত আসবে।
আকবর : তা’ও হবার পারে। যাহোক রবিন শোনেক, একটা কাথা সবসময় মনে রাখিবা হোবে। আমরিকাত দুইটা জিনিস হইল ফিরি। এক হইল মোদ, আর দুই নম্বরটা হইল বেটিছোয়া। দোনোটাই ডেনজোরাস। ধইছেন কি মইছেন। ধলা চামেড়ার মাগি দেখি পাগেলা হই যান না বারে। ঐল্লা দ্যাশের তামাল্লার এইডোস ধইছে- এইটা খেয়াল রাখিবা হোবে। এইবার যা হোউক, টপ্পাস করি ডাক পইছে, চলি যাছেন, যান। কিন্তুক ছয় মাসের মধ্যে দ্যাশে আসি বেহা করি বহু নি যাইয়ো। তখন আর টেনশন থাকিবে নাহায়। আর যেহেতু শীতের দ্যাশ, শরীল গরম রাখিবাতনে মোদ খাবা হোবে, কম কম করি খাবেন। ঐল্লা দ্যাশোত অল্প করি মোদ খাওয়াটা ফ্যাশোন। কিন্তুক নেশা করিবাতনে মোদ ধইছেন তো মইছেন।

[রবিনের মা নতুন করে আবার কান্না শুরু করবেন। রবিনের বাবা তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। আকবর চাচা একটুক্ষণ বিব্রত থাকার পর কাজল আর রবিনকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন, রশীদ সাহেবের মোবাইল বেজে উঠবে, তিনি ফোনে প্রায় চিৎকার করে কথা বলতে থাকবেন। এদিকে রনি রীতা বার বার ভাইয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে থাকবে, তাদের নানান রকম দাবী-দাওয়া স্মরণ করিয়ে দিতে থাকবে]

রশীদ : হ্যালো? কে বিয়াই? ... জোরে বলেন, শুনা যাছে না। অ্যাঁ.. হামেরা তো এয়ারপোর্টের ভিতরোত। ...না না... অ্যাঁ? বুঝা পাই না.. হ্যাঁ হ্যাঁ বলেন...কি? টাঙ্গাইল? সন্ধ্যা তো হই যাবে বারে... না না আসেন, ওত্তি ফেলাইট লেট আছে... হ্যাঁ হ্যাঁ, টেরেনের মতোন পেলেনও লেট করে...

[কামাল আর শাহেদ একপাশে সরে আসবে। দুজন পাশাপাশি বসবে, তাদের ঠিক উল্টেদিকে যে সাজ্জাদ বসে আছে, এটা খেয়াল করবে না]

কামাল : শাহেদ, তোর কাছে টাকা কত আছে?
শাহেদ : আমার কাছেও তোর মতোই অবস্থা।
কামাল : কাজল আজকে যাবে না?
শাহেদ : না। ও তো দোকানের মাল কিনবে। দুদিন পরে যাবে। তুই কাজলেক কয়ে দেখ।
কামাল : না না, অক কিছু কওয়া যাবে না।
শাহেদ : কেন? অক কইতে সমস্যা কি?
কামাল : আছে সমস্যা। তুই বুঝবি না। তাছাড়া...
শাহেদ : তাছাড়া কি?

[এর মধ্যে ওদের পেছন থেকে সাজ্জাদ উঠে কোন একদিকে চলে যাবে, ব্যাপারটা শাহেদ বা কামাল কেউ খেয়াল করবে না]

কামাল : এর মধ্যেই ওর কাছ থেকে তিনশ টাকা ধার নিছি।
শাহেদ : কইস কি! ... তোর শালা আসারই দরকার ছিলো না।
কামাল : আমারও তাই মনে হচ্ছে।
শাহেদ : মনে হচ্ছে মানে? মনে হওয়া হওয়ির কি আছে। শালা তুই বন্ধুক বিদায় দিবার আসছিস না ধারের টাকায় ফুটানী মারবার আসছিস?
কামাল : কথা কইস না তো! এমনিতেই মেজাজ খারাপ আছে।
শাহেদ : এ-শ্‌-! পকেটে নাই পাত্তি, মেজাজের পইলতায় বাত্তি! তোর মেজাজ নিয়া তুই বসি থাক, মোর কাম আছে।

[শাহেদ উঠে চলে যাবে, কামাল কিছুক্ষণ তার চলে যাওয়া দেখবে, তারপর নিজেও উঠে শাহেদের উল্টোদিকে হাঁটতে থাকবে]


সাজ্জাদকে দেখা যাবে ইনফর্মেশন ডেস্কের কারো সাথে কথা বলছে। সে কথা শেষ করবার আগেই কামালকে দেখবে, কামাল টয়লেটের দিকে যাচ্ছে। সে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে কামালকে অনুসরণ করবে]

[কামাল দাঁড়িয়ে আছে ইউরিনালে, তার ঠিক পাশের ইউরিনালে গিয়ে দাঁড়াবে সাজ্জাদ]

সাজ্জাদ : কেমন আছেন?
কামাল : [অপ্রস্তুত, পুরোপুরি কফিউজড]
সাজ্জাদ : ফ্লাইট যতটা লেট হবার কথা ছিলো, ততোটা হবে না। ধরুন বড়জোর ঘন্টা খানেক। অবশ্য কনফার্ম হতে আরো কিছুক্ষণ সময় লাগবে, তারপরই অফিশিয়ালি অ্যানাউন্স করবে।
কামাল : কিন্তু আপনি জানলেন কীভাবে? তাছাড়া আমরা যে ঐ ফ্লাইটেরই অপেক্ষায় আছি, তাই বা কে বললো?
সাজ্জাদ : প্রথমটা জেনেছি অফিশিয়াল সূত্রে। আমার বন্ধু এখানে চাকরি করে, সে এখন ডিউটিতে আছে। তাছাড়া আমি তো প্রায়ই এয়ারপোর্টে এসে বসে থাকি, অনেকের সাথেই বেশ খাতির হয়ে গেছে। এটুকু খবর বের করা কোন ব্যাপারই না।... আর দ্বিতীয়টা বলেছেন আপনিই।
কামাল : আমি?
সাজ্জাদ : ইয়েস! তবে আমাকে নয়, আপনার বন্ধু শাহেদকে।
কামাল : আমার বন্ধুর নাম...
সাজ্জাদ : সেটাও জেনেছি আপনার কথা থেকেই। বাস মিস করবার টেনশনে আপনারা আমাকে খেয়ালই করেননি, আমি আপনাদের ঠিক পেছনেই বসে ছিলাম। আপনার নামটা অবশ্য জানা হয়নি, কারণ আপনার বন্ধু সেটা উচ্চারণ করেন নি।
কামাল : কামাল
সাজ্জাদ : আমি সাজ্জাদ। বাই দ্য ওয়ে, আপনার বাস মিস করার টেনশন তো দূর করলাম, এখন বলেন, কী খাওয়াবেন?
কামাল : এমনভাবে বলছেন যেন টেকনিক্যাল প্রবলেমটা আপনিই সলভ করেছেন?
সাজ্জাদ : হেই, আই’ম্‌ জাস্ট কিডিং, ডোন্ট টেক ইট সিরিয়াসলি, হা হা হা...। চলুন কোথাও গিয়ে বসি।

[সাজ্জাদ এগিয়ে যাবে, কামাল কিচক্ষণ তার গমণপথের দিকে তাকিয়ে থেকে অনিচ্ছাসত্বেও অনুসরণ করবে]


[রশীদ সাহেবের হাতের মোবাইল বেজে উঠবে, তিনি রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে লাইন কেটে দিবে। তিনি হ্যালো হ্যালো করতেই থাকবেন, এর প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে রবিনের মধ্যে। বোঝা যাবে কলটা আসলে তার ছিলো। সে অস্থির বোধ করবে, একটু পরে বাবার কাছে ফোনটা চাইবে। কিন্তু রশীদ সাহেব ফোন দিতে চাইবেন না। এর মধ্যে আবারও কল আসবে, এবার রবিন মোটামুটি জোর করে ফোনটা নিয়ে নিবে, কিন্তু ততোক্ষণে লাইন কেটে গেছে। রবিন বাবাকে আড়াল করে নাম্বারটা পড়বে এবং মুখস্থ করে নিয়ে ফোন দিয়ে দিবে। তারপর কাজলকে নিয়ে একদিকে চলে যাবে]

আকবর : কী হইল বারে, ছোয়া কোনা ফোন করিবা চহেছোলো, দিলু না কেন বারে?
রশীদ : মোবাইল ধরি কোনটে আলাপ করিবে, বুঝা পান নাই বিয়াই?... এই চেংড়ি কোনাই অক খাইল্‌ বারে!
আকবর : আর তো চিন্তার কিছু নাই! তোমার ছোয়াল তো চলি যাছে আমরিকাত। ওত্তি যায়ে কি আর এইল্লা প্রেম-পিরীতি স্মরণ থাকিবে?
রশীদ : মোর তো ঐঠেই চিন্তা। ওত্তি মন লাগাই থাকিবা পারে তো হয়।

[সাজ্জাদ ও কামাল দল থেকে অনেকটা দূরে বসে আছে পাশাপাশি। তাদের অবস্থান থেকে দলটাকে দেখা যায়, কিন্তু দলের অন্যরা পারতপক্ষে তাদেরকে লক্ষ্য করবে না]

সাজ্জাদ : আচ্ছা কামাল সাহেব, এভাবে বিদায় দিতে না আসলে হতো না? বিশেষ করে এই ফেয়ারওয়েল টিমে আপনাদের, মানে এই... বন্ধুদের উপস্থিতির খুব কি আবশ্যকতা ছিলো?
কামাল : দেখুন, রবিন আমার সবচে’ প্রিয় বন্ধু। সে আমেরিকায় বেড়াতে যাচ্ছেনা, চিরতরে থাকতে যাচ্ছে। আর কবে দেখা হবে, কে জানে। সে চলে যাচ্ছে, আমি তাকে বিদায় দিবো না?
সাজ্জাদ : কেন নয়? নিশ্চয়ই দেবেন। আমার প্রশ্ন আসলে এটা নয়। আমি জানতে চাচ্ছিলাম, বিদায়টা কি দিনাজপুরে থেকেই দেয়া যেতো না? দিনাজপুর রেল স্টেশনে কি বাস টার্মিনালে, কিংবা ধরুন আপনার কিংবা রবিন সাহেবের বাসাতেই...?
কামাল : আমার বন্ধু আমেরিকায় চলে যাচ্ছে, আর আমি তাকে বিদায় জানাতে ঢাকা পর্যন্ত আসবো না?
সাজ্জাদ : আসবেন বৈকি, এসেই তো গেছেন। কিন্তু সেটা কতটা যৌক্তিক, তা কি ভেবে দেখেছেন? “তুমি চলে যাচ্ছো, আর দেখা হবে না”- এটা কি ঘরে বসেই মেনে নেয়া যেতো না? তবু আমরা আমাদের সীমিত সঞ্চয় ব্যয় করে পেছন পেছন ছুটে যাই, যদ্দূর যেতে পারি আরকি! তারপর একসময় ডান হাতের কব্জিটা ডানে বামে হেলিয়ে দুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফিরে যাই। বিদায়ীর সঙ্গী হবার এই যে অভিনয়, কতটা দরকার এর?
কামাল : আপনি এটাকে অভিনয় বলছেন কেন? আবেগের কি কোনই মূল্য নেই?
সাজ্জাদ : নিশ্চয়ই আছে। প্রশ্নটা আবেগ নিয়ে নয়, আবেগ প্রকাশের ধরণ নিয়ে। আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি, আপনি আপনার বন্ধুর সাথে ঢাকা পর্যন্ত এলেন, বাকিটুকু যাচ্ছেন না কেন?
কামাল : কী অদ্ভুত কথা! রবিনের কাছে আমেরিকা যাবার টিকিট আছে, ভিসা আছে। আমার তো পাসপোর্টই নাই, আমি কীভাবে যাবো?
সাজ্জাদ : অর্থাৎ বাকিটুকু যাবার সামর্থ থাকলে যেতেন?
কামাল : দেখুন, রবিন যাচ্ছে তার নিজের কাজে, সে সেখানে থাকতে যাচ্ছে। আমি তার সাথে গিয়ে কী করবো?
সাজ্জাদ : কেন, ঢাকা পর্যন্ত যখন এসেছেন, তখন আমেরিকা পর্যন্তও সাথে যান, আমেরিকায় গিয়ে বন্ধুকে নামিয়ে দিয়ে আসেন! ... আচ্ছা ধরুন, ফ্লাইট আজ রাত দশটার আগে ওকে হবে না। আপনি কী করবেন? টিকেট ক্যানসেল করে থেকে যাবেন?
কামাল : [বিব্রত] দেখুন, আপনি তো জেনেই গেছেন, আমি আসলে সে রকম প্রস্তুতি নিয়ে আসিনি। ...কিন্তু সবার ক্ষেত্রে তো তা নয়। যেমন ধরুন কাজল, সে তো থেকে যেতে পারে। ইনফ্যাক্ট সে থাকবেও, দুই দিন পরে যাবে।
সাজ্জাদ : কিন্তু রবিন তো আজকেই চলে যাচ্ছে, তাহলে কাজল কেন আরো দুদিন পরে যাবে? অর্থাৎ সে এসেছিলো নিজের কাজে, এই সুযোগে বন্ধুকে সি-অফ করলো। দ্যাটস্‌ ইন্টেলিজেন্ট!
কামাল : তার মানে বলতে চাচ্ছেন আমার আসাটা বোকামী হয়েছে?
সাজ্জাদ : আমি কিছুই বলতে না চাইলেও সত্যি কিন্তু এটাই দাঁড়াচ্ছে!

[নতুন করে আরো দু’তিনজন আত্মীয় স্বজন বিচিত্র ধরণের পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে দেখা করতে আসবে। রশীদ তাদের দেখে আনন্দিত হবেন]

রশীদ : কে বারে মনসুর, ভিতরে তোমাক ঢুকিবা দিল? কেম্বা করি ঢুকিলেন বারে?
মনসুর : আর কইয়েন না খালু, আসিবা তো দিবারে চাহে না, বহুত কাউয়া-ক্যাচাল করি শ্যাষে আড়াইশ টাকা পারহেড দি’ ঢুকিবা হইল্। তা রবিন কোটে?
মা : কোটে ফির? ওত্তি দ্যাখেক, “আও কাড়া মেশিন” (কথা বলার যন্ত্র, অর্থাৎ মোবাইল ফোন) কানেত ধরি পিরীতের আলাপ জুড়েছে! এই চেংড়ি কোনাই মোর সর্বনাশ করিল! মোক এক্কেলে আস্তাত নামাই দিল বারে!
রশীদ : আহ্‌! একনা হুশ করি কাথা কহেক। বাহিরের মানুষ সাথোত আছে- একনা উদ্দিশ করেন।
আকবর : তা মনসুর মামু, হতোত এইল্লা কী?
মনসুর : এই টিনের ভিতর আছে চাল কুমড়ার বড়ি, আর ভুট্টার খই। আর এইটার মধ্যে ওলের বড়ি।
কাজল : [ইতিমধ্যে সেখানে উপস্থিত হবে] এইল্লা কাস্টমসে আটকাই দিবে, ভাই; পার করিবা পাবেন না...।

[সাজ্জাদ হঠাৎ নড়েচড়ে বসে কামালের দিকে তাকাবে]

সাজ্জাদ : আপনাকে শুরুর দিকে বলেছিলাম আমি প্রায়ই এয়ারপোর্টে এসে বসে থাকি। কেন তা কি জানেন?
কামাল : [বিড়বিড় করে, প্রায় অস্পষ্ট স্বরে] মক্কেলের খোঁজে
সাজ্জাদ : জ্বী?
কামাল : জ্বী না, কিছু না! .. কেন?
সাজ্জাদ : মানুষ দেখতে। প্রতিদিন নানান মানুষ নানান দেশ থেকে আসছে, যাচ্ছে। তাদের ফিরিয়ে নিতে কিংবা বিদায় জানাতে আসছে কত মানুষ! কেউ আসছে প্রাণের টানে, কেউ কর্তব্যবোধ থেকে, কেউবা অযথাই... কেন? কেন এত ব্যকুলতা! কী তাদের সম্পর্ক? কিসের এত ব্যগ্রতা?... আমি বসে বসে দেখি আর অনুভব-আবিস্কারের চেষ্টা করি, যাত্রী আর তার সঙ্গীদের মধ্যে সম্পর্কটা কী? সেটা কতটা গভীর? ... নাকি শুধুই ফর্মালিটি?

[আকবর চাচা ও রশীদ সাহেবদের পিভি থেকে রবিনের ফোনালাপ দেখা যাবে। রবিনের পিভিতে তার বাবা-মার বিরক্ত চেহারা দেখা যাবে, রশীদ সাহেবের ফোন বেজে উঠবে]

রশীদ : হ্যালো? এ বাবা মন্টু, হামেরা তো ভিতরত।

[আকবর তার হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে কথা বলতে থাকবেন]

আকবর : হ্যালো মন্টু মামু? আর কন না বারে, বহুত কাউয়া-ক্যাচাল করি ভিতরত ঢুকিবা দিছে। তুই ওত্তি একনা সিস্টেম করেক। আরে হামেরা ফির বাহির আসিম ক্যামনে? ... নাহায় নাহায়... একবার ঢুকিবা দিছে বার বার দিবে নাকি?... নাহায়, রবিনেকো যাবা দিবা নাহায়। ওমার এখন বেডিং কাড আর এম্বায়-ওম্বায় কিবা কাড নিবা হোবে...
কাজল : বেডিং কার্ড না চাচা, বোর্ডিং কার্ড। আর ওইটা এম্বায়-ওম্বায় না, এম্ব্যার্কেশন কার্ড।
আকবর : এইল্লা তুই অক বুঝাই কহেক।

[সাজ্জাদ ও কামাল একই ভঙ্গিতে বসে কথা বলছে]

সাজ্জাদ : আপনি হয়ত ভাবছেন এই অদ্ভুত ধরণের স্টাডি আমি কেন করি? ...কে জানে কেন! খেয়াল বলতে পারেন, নানান রকম শখ থাকে না মানুষের?... বাদ দিন এসব। আপনাকে বরং একটা গল্প শোনাই, অবশ্য ইফ ইউ আর নট ফিলিং বোরড্‌।
কামাল : না না, বোরড হতে যাবো কেন? বেশ তো সময় কাটছে। আপনি বলুন।
সাজ্জাদ : আমার স্কুল জীবনের অনেকটাই কেটেছে গাইবান্ধা জেলায়, মহিমাগঞ্জ নামে একটা গ্রামে। সেখানে একটা চিনিকল আছে, বাবা সেখানে চাকরি করতেন। আমাদের একটা কুকুর ছিলো।
কামাল : কুকুর একটা ছেলেবেলায় আমিও পুষতাম। তা আপনার কুকুরের নাম কী ছিলো? কোন জাতের?
সাজ্জাদ : দেশী জাতের। বাবা একসঙ্গে দুটো বাচ্চা কুড়িয়ে এনেছিলেন। লালটার নাম লালু, আর কালোটা কালু হতে গিয়ে হয়ে গেল ভুলু। সেকালে লালু-ভুলু নামে একটা ছবি খুব হিট করেছিলো। যাই হোক, লালুটা একদিন কাউকে কিছু না বলে উধাও হয়ে গেল। কিন্তু ভুলু যেমন ছিলো প্রভুভক্ত, তেমনি বিশ্বস্ত। আমাদের জিএম সাহেব একবার তাকে নিয়ে গেলেন পুষবার জন্য। সেই রাতেই সে বাড়িতে এসে হাজির। গলায় একটা ছেঁড়া দড়ি। ব্যাপার কী? ব্যাপার গুরুতর। সিকিউরিটি গার্ডদের দুজনকে, জিএম সাহেবের ছেলেকে, এমনকি তাকেও ভুলু আঁচড়ে-কামড়ে একাকার করেছে। দড়িটা তার গলায় বাঁধা গেলেও অপরপ্রান্ত সে কিছুতেই খোঁটায় বাঁধতে দেয়নি।

[ইন্টারকাটে দেখা যাবে, রবিনদের দলের কাছে বেশ বড়সড় একটা জটলা তৈরি হয়েছে। আরো অন্তত জনা দশেক মানুষ সেখানে জড়ো হয়েছে। এদিকে রবিনের ফ্লাইটের সময়, স্পিকারে অ্যানাউন্স করা হবে। কামাল একটু অস্থির হবে]

সাজ্জাদ : ভুলুর বীরত্বের কাহিনী থাক, আসল ঘটনায় আসি। আমরা যখন অন্য সুগার মিলে বদলি হয়ে গেলাম, তখন ভুলুকেও সঙ্গে নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বাবা দিলেন না। মুখে বললেন নতুন জায়গায় সে অ্যাডজাস্ট করতে পারবে না। আসলে বাবার ভয় ছিলো প্রুতিবেশীরা হয়ত তীর্যক মন্তব্য করবে- “ফুটানী দেখ, কুত্তা নিয়ে এসেছে”। যাই হোক, আমরা ভুলুকে পাশের বাড়ির খোকনদের হাতে তুলে দিয়ে রওনা হলাম।

[এই অংশ থেকে ফ্লাশব্যাক দেখানো হবে। একটা ট্রাক বা পিক-আপে করে মালপত্র নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, অন্য একটা মাইক্রোবাস বা রিকশায় চড়ে কিছু লোক বিদায় নিচ্ছেন। একটা ছোট বাচ্চা ক্রমাগত কাঁদছে, আর তার পাশে দাঁড়িয়ে একটা কালো রঙের কুকুর ক্রমাগত লেজ নাড়ছে। ছেলেটার সমবয়সী আরো কিছু ছেলেমেয়ে তাদের ঘিরে থাকবে। ছেলেটার বাবা হাত ধরে তাকে নিয়ে গাড়িতে তুলবেন, গাড়ি ছেড়ে দিবে। কুকুরটা পিছন পিছন যেতে থাকবে। ফ্রেম ডিজলভ্‌ড হয়ে বাস্তবে ফিরে আসবে]

কামাল : তারপর?
সাজ্জাদ : ট্রেন ছেড়ে দেবার পর আমরা ভুলুকে দেখতে পেলাম। ভুলু ছুটছে ট্রেনের পাশে পাশে...

[আবারও ফ্লাশব্যাক। দেখা যাবে পূর্বে দেখানো বাচ্চাটা ট্রেনের জানলা থেকে চিৎকার করে কাঁদছে আর বলছে-‘ফিরে যা, ভুলু ফিরে যা, ভুলু তুই আসিস না, ফিরে যা...’। বাইরে দেখা যাবে ট্রেনের পাশে পাশে ছুটছে সেই কালো রঙের কুকুরটা। বাচ্চাটা ভিষণ এক্সাইটেড, বাবা-মা তাকে ধরে রাখতে পারে না, এমন অবস্থা। সাজ্জাদের কথা শোনা যাবে ভয়েসওভার হিসেবে]

সাজ্জাদ : ভুলু তার সমস্ত প্রভুভক্তি, অন্ধ আবেগ আর এই নিদারুণ অকৃতজ্ঞ, অতি সাধারণ মানুষ ক’টার জন্যে তার অসাধারণ, অসম্ভব ভালোবাসা নিয়ে ছুটছে। আমি চিৎকার করে ভুলুকে ফেরাতে চাইলাম, ‘ভুলু ফিরে যা, ভুলু তুই ভুল করিস না, ফিরে যা’। ট্রেনের প্রবল শব্দে আমার চিৎকার চাপা পড়ে গেল, ভুলু কিছুই শুনতে পেলো না। শুনতে পেলেও মানতে পারলো না। সে ছুটতেই থাকলো। ভুলু জানতো না, যন্ত্র বড় জোরে ছোটে। আর যে মানুষেরা যন্ত্রের ভেতরে গিয়ে চড়ে বসে, তারাও হয়ে যায় যন্ত্র, নিদেনপক্ষে যান্ত্রিক! এই ভাবনাও তার মনে আসেনি, তার দৌড়ের শেষপ্রান্তে সে তার প্রভুর দেখা পাবে কিনা। একবারের জন্যেও সে ভাবেনি, আমরা তাকে যদি সানন্দে বরণই করবো, তবে ফেলে গেলাম কেন? তাই যদ্দূর দেখতে পেয়েছি, ভুলু ছুটছিলো...।

[রবিনের কানে মোবাইল, সে এখনও দলের সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন। রবিনের বাবা-মা, ভাই-বোনেরা সবাই তার সাথে কথা বলবার জন্যে আগ্রহী, রবীন সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করছে না। তাকে দেখে বরং মনে হবে, প্লেনে উঠতে কেন দেরি হচ্ছে, তাই নিয়ে সে বিরক্ত। কামালের অনুপস্থিতি রবিন যেন খেয়ালই করছে না। এদিকে আকবর চাচা বা অন্যদের মধ্যে কামালের খোঁজ পড়বে]

রশিদ : কেরে শাহেদ, কামাল কোটে?
শাহেদ : এদিকই তো ছিলো। গেছে হয়তো কোন দিকে।
আকবর : এইল্লা ফের কেরকম কাথা বারে? একটা মানুষ হামারে সাথ আসিল, হামারে সাথ থাকিল, এখন আসল টাইমে আসি তার কোন পাত্তা নাই?
শাহেদ : পাত্তা নাই তো আমি কী করবো? অর পাত্তা রাখার জন্যে মনে হয় আসছি আমি?
কাজল : এইগুলা আবার কী কথা বলিস রে? এরকম করি কেউ কয় নাকি? তোর সাথ ওর আবার কিছু হইছে নাকি?
শাহেদ : আমার সাথ আবার কী হোবে। যা হবার অর নিজের সাথে হইছে। আগেত থাকি টিকিট করি ফালাইছে, এখন বাস মিস করার টেনশনে হুশ-জ্ঞান হারায়ে ঘুরে বেড়াছে।
রবিন : কেন, বাস মিস হবে কেন? টিকিট কখনকার করছে?
শাহেদ : দশটার বাসে। তখন তো তোর ফ্লাইট লেট হবার কথা ছিলো। অয় মনে হয় এখনো জানে না, তোর ফ্লাইট ওকে হইছে।
আকবর : নাহায় বারে, ছোয়াকোনাক খুঁজি বাইর করো। কোটে গেইল বারে, খুঁজি দেখো...

[সাজ্জাদ মাথা নিচু করে বসে আছে, তার চোখ সামান্য ভেজা। কামাল খুব আলতো করে একটা হাত তার কাঁধে রাখবে]

কামাল : তারপর? ভুলুর আর কোন খোঁজ পেয়েছিলেন?
সাজ্জাদ : হ্যাঁ পেয়েছিলাম। বগুড়া থেকে ফেরার পথে খোকনের বাবা, রওশন চাচা তাকে দেখতে পান রেল লাইনের ধারে। যতক্ষণ শরীরে বল ছিলো, ভুলু ছোটা থামায়নি। বোকা ভুলুটা একনাগাড়ে ছুটে গিয়েছিলো প্রায় পঁচিশ মাইল পথ। তারপর ক্ষুধা-তৃষ্ণায়-ক্লান্তিতে বসে পড়ে, শুয়ে পড়ে চিরতরে। ...রওশন চাচা বলেছিলেন, শেষ শোয়াটাও সে শুয়েছিলো আমরা যেদিকে গিয়েছি, সেদিকেই মুখ করে।

[সাজ্জাদ বসে আছে মাথা নিচু করে। তার ঝুলে যাওয়া কাঁধে হাত রেখে বসে আছে কামাল। তাদের পিভি'তে দলটাকে দেখা যাবে, কাজল হঠাৎ কামালকে দেখতে পেয়ে জোরে ডাকতে থাকবে, কিন্তু কামাল স্থির-দৃষ্টিতে দেখতে থাকবে রবিনকে, যেন রবিন ছাড়া আশপাশে আর কেউ নেই। কামালের দেখাদেখি কাজলও তাকাবে রবিনের দিকে, রবিনের মা তাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কাঁদছেন, রবিন তাতে সীমাহীন অস্বস্তি বোধ করছে। সে এক পর্যায়ে মায়ের আলিঙ্গন-মুক্ত হবার জন্যে কিছুটা রুঢ় আচরণ করবে, এতে বাবা বা ভাই বোনেরাও অস্বস্তি বোধ করতে থাকবে। আকবর চাচা বা অন্য আত্মীয়-স্বজনরা কেউ রবিনের মনযোগ আকর্ষণ করতে পারবে না, সে ইতিমধ্যে তার সমস্ত লাগেজ ট্রলিতে উঠিয়ে প্যাসেঞ্জার্স অনলি লেখা গেটের সামনে দাঁড়িয়েছে। সে এমনকি পেছন ফিরেও তাকাচ্ছে না।

সাজ্জাদ :কী দেখছেন, কামাল সাহেব?
কামাল : [অবাক হয়ে তাকাবে, কিছু বলবে না কিংবা বলতে পারবে না]
সাজ্জাদ : আপনি এখন কী করবেন, কামাল সাহেব?... ওই যে দেখছেন, আপনার বন্ধু রবিন, ডলারের দেশে পৌঁছুনোর জন্যে কেমন উদ্গ্রীব! আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সূত্র কাজ শুরু করে দিয়েছে। যে সময় আপনাদের কাছ থেকে পালাই পালাই করছে, সেই সময়টাই রবিনের আর কাটতে চাইছেনা। কী করবেন, কামাল সাহেব? এগিয়ে যাবেন, বন্ধুকে শেষ বিদায় দিতে? আপনার বন্ধু তো মহান টাকা-পয়সার দেশের আকর্ষণে ধরিত্রী মায়ের কোল ছাড়ছেন, গর্ভধারিণীকেও ইতিমধ্যেই বিরক্তি বলে ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন। রবিন তো দেশের মাটি ছাড়ার আগেই মা-মাটির টানকে ভুলতে পেরেছেন, আপনি কেন এখনও দ্বিধা কাটাতে পারছেন না? '...আমার কুকুর ভুলু, মানুষের সাথে থেকে থেকে আনুগত্য, বিশ্বস্ততা আর প্রভুভক্তি শিখেছিলো; বিষয়বুদ্ধি, স্বার্থজ্ঞান আর রূঢ় বাস্তবতা শিখতে পারে নি। পশুবত আচরণ পশুরাও ততটা পারেনা, যত দ্রুত শিখে যায় মানুষ! কী করবেন? ভুলুর মতো হত্যে দিয়ে ছুটবেন রবিনের পিছে পিছে? পারবেন না। ঐ রানওয়েটা অনেক বড়, অনেক লম্বা। ঐখানে ছুটতে গেলে বাতাসকেও হার মানাতে হয়, তবেই সেটা পার হওয়া যায়। নয়তো মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবেন, কেউ ফিরেও তাকাবে না। ভুলু বোকা ছিলো, সস্তা আবেগ দমন করতে পারেনি। আপনি কী করবেন, কামাল সাহেব?

[কামাল খুব ধীরে মাথা তুলে তাকাবে সাজ্জাদের দিকে, সেখান থেকে একবার ফিরে তাকাবে রবিনের দিকে, তার চোখে শূণ্য দৃষ্টি। সে কাউকে চিনতে পারবে বলে মনে হবে না। থমথমে চেহারায় সে উঠে দাঁড়াবে, তারপর ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে গেটের দিকে যেতে থাকবে। সবাই অবাক হয়ে তার আচরণ লক্ষ্য করবে, আরো জোরে তাকে ডাকতে থাকবে। কিন্তু সে কোন ভ্রুক্ষেপ না করে বেরিয়ে যাবে, নাটক শেষ হয়ে যাবে]



সমাপ্ত

মঙ্গলবার, ১০ নভেম্বর, ২০০৯

লালছবি [একটি "প্রায় লোমহর্ষক" নাটকের পাণ্ডুলিপি]

দৃশ্য : এক
সময় : দিন
স্থান : ঈষণের বাড়ি

[এলোমেলো অগোছালো একটা বাড়ি। বসার ঘর, শোবার ঘর, ডাইনিং স্পেস... পুরো বাড়িটা এতটাই অগোছালো যে কোন্‌টা কোন্‌ জায়গা আলাদা করে চেনার উপায় নেই। ক্যামেরা থাকবে ক্যামেরাম্যানের শোল্ডারে, একজন মানুষকে নানান কাজকর্ম করতে দেখা যাবে। শটগুলো দেখে ডিসকভারি/ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলের কোন ডক্যুমেন্টারী বলে মনে হতে পারে। ফ্রেমের ব্যক্তিটির নাম ঈষণ খান, বয়স আনুমানিক ৪৫ বছর। তার চেহারাটা কোনমতেই পরিস্কার বোঝা যাবে না, অন্তত শোল্ডারে ক্যামেরা থাকা অবস্থায় একদমই না। এখানে দ্বিতীয় চরিত্রের নাম শিমুল সরকার, সে হলো ক্যামেরাম্যান। দ্বিতীয় আরেকটা ক্যামেরা থেকে তার চেহারা ও অভিব্যক্তি দেখা যাবে। এর মধ্যে শিমুলের শটগুলোকে ভিউফাইন্ডারের ক্রস চিহ্ন ও REC লেখা সাইন দিয়ে আলাদা করা যেতে পারে। লাইট অস্পষ্ট, তবে ঈষণ খান নিজেই লাইট সেট করছে ঘরের বিভিন্ন অংশে- এমন দেখা যাবে। এসব কাজের ফাঁকেই তাকে নানান কথাবার্তা বলতে শোনা যাবে, সবই ক্যামেরাম্যানের সাথে কথোপকথন]

ঈষণ: তোমার হাউজটার নাম যেন কী?
শিমুল: পেপারওয়েট প্রোডাকশন্স। নামটা একটু উদ্ভট, না?
ঈষণ: নাম কখনো উদ্ভট হয় না। নাম তো নামই, তার আবার উদ্ভট কী?
শিমুল: তা ঠিক, তবু প্রথমবার শুনলে লোকে বলে- এটা আবার কেমন নাম?
ঈষণ: একটা দেশ আছে, নাম গুয়াতেমালা। বাঙালীদের কাছে সে নামটা কেবল উদ্ভটই না, অশালীনও, কী বলো?
শিমুল: (হাসি) অকাট্য যুক্তি!
ঈষণ: রাইট। যুক্তির কাছে নতি স্বীকার করাই সবচে’ যৌক্তিক। এনিওয়ে, তোমার নামটা এবার বলো।
শিমুল: আমার নাম তো আপনি জানেন। শিমুল সরকার।
ঈষণ: তারপরও জানতে চাইলাম, তারও যুক্তি আছে। তোমার নামটা রেকর্ড হয়ে থাকলো। কারণ তুমিও আমার ছবির একজন পারফর্মার
শিমুল: কিন্তু... আপনার সাথে আমার পারফর্মেন্সের ব্যাপারে কোন চুক্তি হয়নি।
ঈষণ: তোমার সাথে কোন ব্যাপারেই কোন চুক্তি হয়েছে বলে মনে পড়ছে না।
শিমুল: আমার সাথে না হোক, আমার হাউজের সাথে হয়েছে...
ঈষণ: শোনো, বাংলাদেশে এখন ঘরে ঘরে চ্যানেল, ঘরে ঘরে প্যানেল। মিডিয়ার সেই রমরমা দিন আর নাই। তোমরা লাখ লাখ টাকার যন্ত্রপাতি কিনে হাত গুটিয়ে বসে আছো। আঙুল চুষতে চুষতে তোমাদের আঙুলে এমন ঘা হয়েছে যে, চুক্তি করার জন্য কলম ধরবার সাধ্য নাই।
শিমুল: তাই বলে আপনি...
ঈষণ: তাই বলে কী?

[শিমুল ক্যামেরার রোল বন্ধ করে দিবে]

: রোল বন্ধ করলে কেন? ক্যামেরা রোল করো। তোমার সাথে তিনদিন বোথ শিফটের কন্ট্রাক্ট, তুমি এই তিনদিন তোমার কাজ করে যাবে। ডিরেক্টরের কথাই আইন- এই এথিক তোমার শিক্ষায় ছিলো না?

[শিমুল আবার ক্যামেরা ঘাড়ে নিয়ে রোল দিবে]

শিমুল: তার মানে আমাকে তিনদিন বোথ শিফট ক্যামেরা ঘাড়ে করে আপনার সাথে বকবক করতে হবে?
ঈষণ: তা বলিনি। আর ক্যামেরা সব সময় শোল্ডারে রাখারও যুক্তি নাই। তুমি ট্রাইপডে বসাতে পারো, চাইলে ডলিও নিতে পারো। জার্ক হলেও ক্ষতি নেই। আমার জার্ক কন্ট্রোলের নিজস্ব কায়দা জানা আছে।
শিমুল: আপনার ছবির গল্পটা কী? অন্য পারফর্মাররা কোথায়?
ঈষণ: আমার ছবির কোন গল্প নেই। ইউনিটটাও একদমই ছোট। পারফর্মার- প্রোডাকশন- টেকনিশিয়ান... সব মিলিয়ে মাত্র দুজন।
শিমুল: তারমানে আপনি আর আমি?
ঈষণ: ইয়েস। আর গল্প একেবারেই নেই, তাও বলা যায় না। একটা গল্প অবশ্য আছে। সেটা আমার জীবনের গল্প। সেই অর্থে ছবির নাম জীবন থেকে নেয়া রাখা যেতে পারে।
শিমুল: এই নামে একটা বিখ্যাত ছবি অলরেডি আছে। জহির রায়হানের...
ঈষণ: আই নো আই নো। কিন্তু সেটা ছিলো জীবনের সত্য হতে পারতো এমন গল্পের অভিনয়। আর আমারটা একশ’তে একশ’ভাগ সত্যি এবং এতে কোন অভিনয় নেই।
শিমুল: জানতে পারি কি, এই ছবি আপনি কোথায় চালাবেন বা বিক্রি করবেন?
ঈষণ: না। জানতে পারো না। জানতে চাইতেও পারো না। তুমি কোথায় ক্যামেরা অপারেটিং শিখেছো, কতটা শিখেছো, এর দ্বারা তোমার কী কী পারপাস সার্ভ হয় এসব আমি জানতে চাইনি, চাইতে পারিনা।
শিমুল: কিন্তু আর সব কিছু বাদ দিলেও ছবির কোয়ালিটি, কালার মোড, ডেপ্‌থ অব ফিল্ড, রেজোলেশন... এসব অ্যাডজাস্ট করার জন্যও তো ব্রডকাস্টিং মিডিয়াটা জানা দরকার।
ঈষণ: কাট্‌। রোল বন্ধ করো। কতক্ষণ রোল হয়েছে দেখে বলো তো।
শিমুল: পনের মিনিট একুশ সেকেন্ড দশ ফ্রেম।
ঈষণ: এতক্ষণ পর তোমার খেয়াল হলো ডেপ্‌থ অব ফিল্ড, রেজোলেশন এসব অ্যাডজাস্ট করার কথা?

[শিমুল একটু অপ্রতিভ হবে, ঈষণও বিরক্ত হবেন]

: প্যাক আপ! যাও গা। আজ আর কাজ করবো না, কাল সকালে আসো। সেম টাইম, সেম প্লেস।
শিমুল: আই’ম্‌ স্যরি। মানে আমি কি আপনাকে...
ঈষণ: নো নো নো। ইটস ওকে। আমি এমনিতেই প্যাক আপ করতাম। কারণ আমারও প্যাক আপের সময় হয়ে গেছে।

[ইঙ্গিতে ঘরের অগোছালো আসবাবপত্র দেখাবে]

শিমুল: মানে?
ঈষণ: এইসব যা কিছু দেখছো, এগুলো আমি বিক্রি করে দিয়েছি। বলতে পারো নিজেকে ছাড়া আর সব কিছু আমি বেচে দিয়েছি।
শিমুল: বলেন কি!
ঈষণ: এখনো বলিনি পুরোটা। কালকে বলবো। যাই হোক, তুমি কি ক্যামেরা রেখে যাবে?
শিমুল: জ্বী না। সেটা নিয়মে নাই। ক্যামেরা অবশ্যই হাউজে ফেরত দিতে হবে, প্রতিদিন।
ঈষণ: যদি আউটডোরে যাও? কয়েকদিনের জন্য...?
শিমুল: সেটা আলাদা ব্যাপার , কিন্তু...
ঈষণ: ভয় পাচ্ছো, আমার খাট- আলমারির সাথে তোমার ক্যামেরাও না বিক্রি করে দেই?
শিমুল: দিলেই বা বিশ্বাস কী?
ঈষণ: রাইট, ভেরি ইন্টেলিজেন্ট। কখনো কাউকে বিশ্বাস করতে নাই। দাও, ক্যাসেটটা বের করে দাও।

[শিমুল ক্যাসেট বের করে দিবে, তার পর ক্যামেরা ট্রাইপড নিয়ে চলে যাবে]

দৃশ্য : দুই
সময় : দিন
স্থান : ঈষণের বাড়ির সামনে

[বাড়ির সামনে একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে, তাতে ঈষণ খানের ঘরের সমস্ত ফার্নিচার তোলা হয়েছে। একজন লোক ঈষণ খানের হাতে বেশ কিছু টাকা দিবে, তারপর ট্রাকের কেবিনে চড়ে বসবে। ট্রাক ছেড়ে দিবে, ঈষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকবে। দ্বিতীয় ক্যামেরায় দেখা যাবে শিমুল পুরো দৃশ্যটা শোল্ডারে ক্যামেরা রেখে ধারণ করছে। বরাবর সে ঈষণের পেছনে থাকবে। ট্রাকটা চলে গেলে ঈষণ খান ঘরে ঢোকার সিঁড়ির দিকে পা বাড়াবে, ক্যামেরা তাকে ফলো করবে। সিঁড়ির বাঁক ঘোরার সময় ঈষণের চেহারা দেখা যেতে গিয়েও যাবে না। ক্যামেরা তাকে ফলো করে ঘরের ভেতর আসবে, সেখান থেকে একটা ব্যালকনিতে চলে আসবে। ঈষণ খান বাইরের উজ্জ্বল আলোকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে ক্যামেরার দিকে তাকাবেন, তার চেহারা কিছুই বোঝা যাবেনা]

ঈষণ: আমার নাম ঈষণ খান। আমি নিজেকে একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করি। যদিও অদ্যাবধি কোনো চলচ্চিত্র আমি নির্মাণ করিনি, তবু আমি সজ্ঞানে, সুস্থ মস্তিস্কে দাবী করছি, আমার চেয়ে মেধাবী, আমার চেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং আমার চেয়ে সাহসী ফিল্ম মেকার আর একজনও নেই, অন্তত বাংলাদেশে নেই। আমি কোন ফিল্ম বানাইনি কেন? মুড আসেনি। হ্যাঁ, স্বীকার করছি, গত পঁচিশটা বছর যে ছবিটা বানানোর জন্যে আমি প্রিপারেশন নিচ্ছি, তার গল্পটা একটু গোলমেলে, মেকিংটা আরো বেশি জটিল। ঠিক কীভাবে শুরু হয়ে কীভাবে কোথায় এটা শেষ হবে, কেউ বলতে পারবে না।
একটা ছবি বানানোর জন্য, তাও আবার প্রথম ছবিটাই বানানোর জন্য পঁচিশ বছর একটু বেশিই দীর্ঘ সময়, মেনে নিচ্ছি। কিন্তু যদি বলি, আমি জীবনে একটাই ছবি বানাবো- তাহলে...? যা’ই হোক, একটু আগে আমার জীবনের সমস্ত সম্পত্তির শেষ কিস্তি বিক্রি হয়ে গেল। আমার এখন সম্বল সব মিলিয়ে কুড়ি হাজার টাকা। আমার প্রথম ছবি বানানোর জন্য আমি এখন সম্পূর্ণ প্রস্তুত, কিন্তু আমার ছবির বাজেট বলতে মাত্র এই কুড়ি হাজার টাকা, দুইয়ের পরে চারটা শূণ্য। মাত্র চারটা। ...সাতটা না হোক, ছ’টা না হোক, নিদেনপক্ষে পাঁচটা হলেও চলতো, কিন্তু ... কী করবো, আর কিছু তো বেচার নেই, নিজেকে ছাড়া। আর নিজেকে বেচলে তো অনেক আগেই বেচতে পারতাম, তাহলে আর আজকে... যাই হোক, নো কমপ্লেইন। কুড়ি হাজারই সই।
আমার বয়স পঁয়তাল্লিশ, অর্থাৎ সামনে পড়ে আছে পুরো একটা জীবনের প্রায় সিকিভাগ। এই দুইয়ের পিঠের চার শূণ্য দিয়েই তার একটা গতি করতে এবং করে যেতে হবে। করে যেতে মানে দিনের পর দিন গতি করতে থাকা, নাকি কোন রকম একটা গতি করে রেখে চলে যাওয়া?
আমি কি চিন্তিত?

[তারা আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকে পড়বে, ঈষণের চেহারা এক ঝলক দেখা গেল কি গেল না, আবার অস্পষ্ট হয়ে যাবে। আলো অ্যাডজাস্ট হতেই দেখা যাবে ঈষণ ক্যামেরার দিকে উল্টো ঘুরে গেছে। ক্যামেরা ট্রাইপডে বসানো হবে]

ঈষণ: আমি মোটেই চিন্তিত নই, তবে মনে হচ্ছে আমার ক্যামেরাম্যান ভীষণ রকম চিন্তিত। ওয়েল ওয়েল ওয়েল।

[ঈষণ মাথা নিচু করে টাকা গুনতে গুনতে ঘুরে দাঁড়াবে, আবারও তার চেহারা দেখা যেতে গিয়েও যাবে না]

: এই নাও শিমুল, তোমার তিন দিনের পাওনা নয় হাজার যোগ আরো এক হাজার বোনাস। এবার নিশ্চিন্ত?
শিমুল: ওটা পরে দিলেও চলবে।
ঈষণ: নো নো, এই সিকোয়েন্সে তোমার কোনো ডায়লোগ নেই। তুমি আজ শুধুই ক্যামেরাম্যান। নাও, টাকাটা রাখো।

[শিমুল এগিয়ে গিয়ে টাকাটা নিবে। এবারও ঈষণের চেহারা দেখা যাবার একটা সম্ভাবনা তৈরি হবে, কিন্তু শেষ মুহূর্তে ঈষণ সাবধান হয়ে যাবেন। তিনি যে সুকৌশলে ক্যামেরাকে ফাঁকি দিচ্ছেন, নিজেকে আড়াল করছেন, এটা এতক্ষণে দর্শকদের কাছেও স্পষ্ট হয়ে যাবে]

শিমুল: কিন্তু আপনার ন’হাজার দেবার কথা ছিলো, বোনাস কেন দিচ্ছেন? তাছাড়া কাজও তো শেষ হয়নি।
ঈষণ: কাজ তো শেষ হবে। আজ না হোক, কাল হবে। দিয়ে দিলাম। খরচ হয়ে যেতে পারে না?
আর বোনাসের কথা বলছো? আমার সামর্থে থাকলে তোমাকে এক হাজার নয়, এক লাখ টাকা বোনাস দিতাম। আমার ছবি শুরু করতে যে পঁচিশ বছর দেরি হয়েছে, তার মধ্যে পাঁচ বছর দেরি হয়েছে তোমার জন্য। পাঁচ বছর আমি তোমারই মতোন একজন ক্যামেরাম্যান খুঁজছিলাম।
শিমুল: বলেন কি!
ঈষণ: এখনো বলিনি পুরোটা। বলবোও না। যাই হোক, রোল অফ করো। চলো বাইরে যাই। ট্রাইপড থাক। পুরো ছবিটা আঁধার শ্যাঁতশেঁতে হয়ে যাচ্ছে। কিছু আউটডোর শট নেয়া যাক। সেই ফাঁকে কিছু প্রপস-কস্টিউম কিনে ফেলা দরকার। মজার ব্যাপার কি খেয়াল করেছো, ছবি বানানোর এই প্রস্তুতিগুলোও আমার ছবির অংশ।

দৃশ্য : তিন
সময় : দিন
স্থান : আউটডোর

[ঈষণ খান ও শিমুল ঘর থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা নিবে। রিকশায় বসে শিমুল কোলের ওপর ক্যামেরাটা রাখবে, সেখান থেকে ঈষণ খানের শরীরের কিছু অংশ দেখা যাবে, কিন্তু মুখ দেখা যাবে না। কিছুক্ষণ পর ঈষণ নিজের কোলে ক্যামেরাটা নিয়ে আসবে, তখন শিমুলের মুখসহ শরীর দেখা যাবে, রাস্তাও দেখা যাবে। তারা দুজনে গল্প করতে করতে যাবে, কিন্তু তাদের কথা শোনা যাবে না। রিকশা একটা মার্কেটের সামনে এসে দাঁড়ালে তারা নেমে এসে ভাড়া মিটিয়ে রিকশা ছেড়ে দিবে। ক্যামেরা রোল করাই থাকবে, এই অবস্থায় তারা মার্কেটে ঢুকে পড়বে। তবে ক্যামেরাটা ধরার কায়দায় কেউ বুঝতে পারবে না যে, রোল চলছে। মার্কেটে ঢুকে ঈষণ কিছু কেনাকাটা করবে, বেশির ভাগই পোষাক-পরিচ্ছদ। সে যা কিছু কিনবে, সবই এক জোড়া করে। কাপড় কিনতে গিয়ে আবিস্কৃত হবে, ঈষণ ও শিমুল দুজনেরই শারীরিক গড়ন একই মাপের, শুধু বয়সের পার্থক্য। কেনাকাটা শেষ করে তারা একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে যাবে]

দৃশ্য : চার
সময় : দিন
স্থান : রেস্টুরেন্ট

[রেস্টুরেন্টে ঈষণ আর শিমুল বসবে মুখোমুখি। ক্যামেরাটা একটা চেয়ারের ওপর রাখা থাকবে, রোল বন্ধ অবস্থায়। খাবারের অর্ডার নিয়ে ওয়েটার চলে যেতেই হঠাৎ শিমুলের খেয়াল হবে, রোল বন্ধ করা আছে। সে ব্যস্ত হয়ে রোল চালু করতে যেতেই ঈষণ খান বাধা দিবে]

ঈষণ: দরকার নেই। রোল বন্ধই থাক। ক্ষুধার্ত মানুষের খাওয়ার দৃশ্যে তেমন কোন শিল্প নেই। এটা আমার ছবির মধ্যেও নেই। বাই দ্য ওয়ে, তুমি কি যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষুধার্ত?
শিমুল: এটা একটা অবান্তর প্রশ্ন। সেই সকাল থেকে তো একসাথেই কাজ করছি। আপনি যদি ক্ষুধার্ত হন তো আমি হব না কেন?
ঈষণ: তুমি ক্ষুধার্ত, তবে আমার মতো হয়তো নও। কারণ কাল বিকেলের পর থেকে আমি কিছুই খাইনি। তোমাকে বিদায় করে দিয়ে নিচে নেমে কয়েকটা ফোনকল করেছি, আর এককাপ চায়ে ভিজিয়ে একটা পাউরুটি খেয়েছি। আমার কাছে সব মিলিয়ে বিশটা টাকাই ছিলো।
শিমুল: বলেন কি!
ঈষণ: এখনো বলিনি পুরোটা। রিকশা ভাড়া তোমার কাছ থেকে নিলাম, খেয়াল করোনি? কারণ আমার কাছে আজ সকালে পাওয়া টাকার বাইরে কোন টাকা ছিলো না। লোকগুলো আজকে যদি কোন কারণে না আসতো, তাহলে আজ খাওয়াও হতো না, শুটিংও হতো না।
শিমুল: এই অবস্থা... আমাকে বলেন নি কেন?
ঈষণ: বলিনি, কারণ বলি না! বাদ দাও। তুমি ছবি দেখ?
শিমুল: দেখি। তবে দেশি ছবি দেখি না।
ঈষণ: দ্যাটস্‌ ফাইন। দেশি ছবিতে আসলে দেখার কিছু নেই। কমার্শিয়াল ছবি তো বলাই বাহুল্য, বিকল্প-স্বকল্প কী কী সব নাম দিয়ে এরা ট্রেন্ড তৈরি করার একটা পাঁয়তারা কষছে দিনের পর দিন। না হচ্ছে কমার্শিয়াল না হাচ্ছে আর্ট ... এসব বাদ দাও। কোন ধরণের ছবি বেশি দ্যাখো?
শিমুল: সব ধরণের। মানে হাতের কাছে যা পাই আরকি। অ্যাকশন, রোমান্টিক...
ঈষণ: হরর ফিল্ম দ্যাখো?
শিমুল: খুব কম। হিন্দী ফিল্মে হরর ছবিগুলোই সবচে’ পুওর।
ঈষণ: ওহ্‌ মাই গড, তুমি হিন্দী ছবির কথা বলছিলে! হতাশ করলে। যাই হোক, বাইরের ছবি দ্যাখো না? মানে এশিয়ার বাইরে...
শিমুল: হলিউডের কথা বলছেন?
ঈষণ: হ্যাঁ এবং না। হলিউডেই যে সবচে’ সেরা ছবিগুলো তৈরি হয়, তা নয়। আবার যেকোন দেশের যেকোন নির্মাতার স্বপ্ন থাকে, হলিউডে গিয়ে ছবি বানানোর। এনিওয়ে, নন-গ্রামাটিক্যাল ছবির প্রতি আগ্রহ আছে?
শিমুল: আমি ঠিক বুঝলাম না।
ঈষণ: স্নাফ মুভি দেখেছো কখনও?
শিমুল: দ্যাখা দূরে থাকুক নামও শুনিনি।
ঈষণ: সেটা দোষের না। তোমার লজ্জিত হবারও কিছু নেই। আমি বাজি রেখে বলতে পারি, এদেশে যারা নিজেদের ফিল্ম মেকার, ডিরেকটার, ছবিওয়ালা... ইত্যাদি ইত্যাদি ভাবে, তাদের অনেকেরই এই ধারার ছবি সম্পর্কে কোন আইডিয়া নেই। অথচ স্নাফ মুভি হলো বিশ্বের সবচেয়ে কম খরচে নির্মীত, কিন্তু সবচেয়ে ব্যবসাসফল ছবি। গড়পড়তা একেকটা স্নাফ মুভি দুই-তিন কোটি টাকায়ও বিক্রী হয়!
শিমুল: দুই-তিন কোটি!!
ঈষণ: গড়পড়তা। যত্ন নিয়ে বানাতে পারলে আরো বেশি দাম পাওয়া যায়।
শিমুল: এসব মুভি চলে কোথায়? নিশ্চয়ই সিনেমা হলে না?
ঈষণ: এগুলো আসলে সবার জন্যে নয়। স্নাফ মুভির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো বিভৎসতা। পাশবিক একটা ব্যাপার থাকা খুব জরুরী। বেশির ভাগ স্নাফ মুভিতেই নগ্নতা থাকে, ডাবল এক্স রেটেড করা থাকে, কিন্তু স্নাফ হবার জন্যে নগ্নতা- যৌনতা এসব একেবারেই আবশ্যক নয়। যা দরকার তা হলো- বিভৎসতা, হিংস্রতা...
শিমুল: লাইক হরর মুভি
ঈষণ: না, হরর ফিল্মে যা ঘটে তা কাল্পনিক। ভ্যাম্পায়ার বলে কোন চরিত্র আদৌ ছিলো না পৃথিবীতে। বাট স্নাফ মুভি ইজ রিয়েলিস্টিক। অ্যাবসলিউট রিয়েলিটি নিয়ে এই বস্তু তৈরি হয়। বিকৃত রুচির কিছু মানুষ আছে পৃথিবীতে, যাদের ঠিক কত টাকা আছে, তার হিসেব রাখার জন্যে গোটা একটা কোম্পানী খুলতে হয়। এই লোকেরাই হলো স্নাফ মুভির সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক, ক্রেতা, দর্শক-সমাজ... যাই বলো না কেন।
শিমুল: ইন্টারেস্টিং! কিন্তু আমরা এসব নিয়ে আলোচনা করছি কেন?
ঈষণ: কারণ, একটা স্নাফ মুভি- আমরাও বানাবো। অন্তত আমি তো বানাবোই। জানা প্রয়োজন, তুমি কি আমার সাথে থাকবে?
শিমুল: কিন্তু ... মানে বানানো তো যায়ই, কিন্তু বিক্রী করবেন কোথায়? আপনার কি কোন...
ঈষণ: বিক্রীর ব্যবস্থা না থাকলে কি বানানোর আইডিয়া মাথায় আসে? এই ব্যবস্থা করতেই তো পঁচিশটা বছর গেল। যাই হোক, তুমি আমার সাথে কাজ করবে? ভেবে বলো। ইউ উইল বি আ মিলিওনিয়ার! ক্যামেরার পিছনে তোমাকে থাকতে হবে না, ক্যামেরাই তোমার পিছে পিছে ঘুরবে... করবে কাজ আমার সাথে?
শিমুল: কবে বানাবেন? আই মিন কতদিন...
ঈষণ: আজকে! এখন। তুমি বললে এখনই কাজ শুরু করে দিই। আমার সব প্রিপারেশন নেয়া আছে। শুধু দরকার একজন ক্যামেরাম্যান, যে আমার কথা শুনবে, আমার ইশারা বুঝতে পারবে। এবং আমার প্রতি বিশ্বস্তও থাকবে। বুঝতেই পারছো কেন আমি...
শিমুল: আমি একটু ভেবে দেখি।
ঈষণ: দ্যাখো। ভেবে দ্যাখো। আমার কোন তাড়া নেই। কাল তো দেখা হচ্ছেই, কাল জানাও। চাইলে আরো সময় নাও। আমার অনেক তাড়া, আবার কোন তাড়া নেই।
শিমুল: সেটা বুঝতেই পারছি। পঁচিশ বছর যে ধৈর্য ধরে আছে, তার তাড়া থাকা এবং না থাকা দুটোই সমান সমান।
ঈষণ: তুমি ভিষণ ইন্টেলিজেন্ট। এই জন্যেই তোমাকে দরকার। উই ইউল বি আ টিম। পারহ্যাপস্‌ দ্য বেস্ট পসিবল কম্বিনেশন| আজ চলে যাও। এখান থেকেই প্যাক আপ। কাল সকাল দশটায়। আমার বাসায়।

[তারা রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আসবে, শিমুল একটা রিক্‌শা বা সিএনজি ডেকে তাতে উঠে বসবে, রিকশা চলতে শুরু করতেই পেছন থেকে ঈষণ কথা বলে উঠবে। তার গলার আওয়াজ একটু রহস্যময় শোনাবে। এই দিনদুপুরেই যেন শিমুল একটু কেঁপে উঠবে]

: একটা কথা শিমুল।

[শিমুল রিক্‌শা থামাবে, নেমে আসতে যেতে ঈষণ ইশারায় বসে থাকতে বলবে। তারপর তার হাত ধরে খুব রহস্যময়, প্রায় ফিসফিস করে, কিন্তু বেশ আন্তরিক সুরে কথা বলবে]

: আমার সম্পর্কে তোমার ধারণা কী? আমরা তো একসাথে কাজ করলাম প্রায় দুদিন। ইভেন তুমি এখন আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানো, বিশেষত আমার পছন্দ-অপছন্দ, পরিকল্পনা... কী মনে হয়? কেমন মানুষ আমি? কেমন বুঝছো আমাকে?
শিমুল: এখনই বলবো?
ঈষণ: না, এখন বাসায় যাও। ঠান্ডা মাথায় ভাবো, কাল শুনবো। তবে হ্যাঁ, সত্য কথা শুনতে চাই। কথা দিচ্ছি, সত্যিটা যাই হোক না কেন, তোমার সাথে আমি কাজ করবো। যাও, বেস্ট অব লাক।

[শিমুলকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঈষণ চলে যাবে উল্টোদিকে ঘুরে হাটতে হাটতে। তার হাতে সদ্য কেনা কাপড়ের এক সেট প্যাকেট। আরেক সেট শিমুলের হাতে। শিমুল কিছুক্ষণ তার চলে যাওয়া দেখে যে মুহূর্তে রিকশাকে যেতে বলবে, ঠিক তখনই ঈষণ তার দিকে ফিরে বলবে-]

ঈষণ: কালকের কস্টিউম তোমার হাতে। এগুলোই পরে এসো।

দৃশ্য : পাঁচ
সময় : দিন
স্থান : ঈষণের বাড়ি

এই প্রথম ঈষণ খানকে ক্যামেরার পেছনে দেখা যাবে। একটা জোন লাইট করা হয়েছে, একটা চেয়ারে বসে আছে শিমুল। তার পোষাক-পরিচ্ছদ ঈষণ খানের অনুরূপ। ক্যামেরা ট্রাইপডের উপর বসানো, হাইট আপ করা, শিমুলের মাথার ওপর ইঞ্চিপাঁচেক হেড রুম রাখা হয়েছে, তার পায়ের সামনে ফুট দুয়েক জায়গা ফ্রেমের ভেতরে থেকে গেছে। ক্যামেরার মিনি এলসিডিতে ফ্ল্যাট লাইটে শিমুলকে দেখা যাচ্ছে, মোটামুটি অ্যাটেনশান অবস্থায় বসে আছে। লাইট কন্ট্রাস্ট আর ফোকাস অ্যাডজাস্ট হতেই ঈষণ রোল দিবে। তারপর নিজেই কথা বলতে থাকবে।

ঈষণ: রোলিং, ফাইভ ফোর থ্রি টু ওয়ান জিরো অ্যাকশন। বলো।
শিমুল: কী বলবো?
ঈষণ: তোমাকে কালকে একটা প্রশ্ন করেছিলাম, সে প্রসঙ্গে বলো।
শিমুল: কোন প্রসঙ্গে?
ঈষণ: ওহ্‌ হো! ভুলে গেছো, না ভুলে যাওয়ার ভান করছো? আমার সম্পর্কে তোমার ধারণা কী? আমার সম্পর্কে মূল্যায়ণটা কেমন জানতে চাচ্ছি।
শিমুল: প্রশ্নটা ইচ্ছে করেই আপনার মুখ দিয়ে উচ্চারণ করিয়ে নিলাম। কেন, তার ব্যাখ্যা আশা করি দরকার নেই। যাই হোক, আপনি কি সত্যি উত্তর চান?
ঈষণ: নিশ্চয়ই চাই। টোটাল আনসেন্সর্ড!
শিমুল: আমি কি কেবল অ্যাজ এ ডিরেক্টর আপনাকে মূল্যায়ণ করবো, নাকি...
ঈষণ: ঈষণ খান-কে মূল্যায়ণ করো। হোয়াট এভার হি ইজ, ডেস্ক্রাইব দ্য টোটালিটি।
শিমুল: এক কথায় আপনাকে মূল্যায়ণ করা যায়- আপনি একজন ব্যর্থ মানুষ।

[ঈষণ খানের চেহারায় হালকা হাসির আভাস এসেই মিলিয়ে যাবে। তাকে মনযোগ দিয়ে ভিউফাইন্ডারে তাকিয়ে থাকতে দেখা যাবে, যদিও শটে কোনপ্রকার মুভমেন্ট থাকবে না। শিমুলের কথা শুনতে শুনতে একসময় ঈষণ ক্যামেরা ছেড়ে দিয়ে পেছনে হাঁটাহাঁটি করতে থাকবে, তার অভিব্যক্তি বদলে যেতে থাকবে। হাঁটতে হাঁটতে শেষ দিকে সে শিমুলের চেয়ারের পেছনে চলে আসবে, শিমুল সেটা খেয়াল করবে না। তার কথা বলার মধ্যে এক ধরণের জেদ লক্ষ্য করা যাবে, যেন সে এই দু’দিনের সার্বিক অভিজ্ঞতায় যার পর নাই বিরক্ত, সুযোগ পেয়ে সমস্ত বিরক্তি সে একবারে উগরে দিচ্ছে]

: একজন ব্যর্থ মানুষের সব রকম বৈশিষ্ট্য আপনার মধ্যে আছে। ব্যর্থ লোকেরা অস্থির হয়, ধৈর্য্য কম হয় তাদের। আপনারও তাই। না, আপনি কথায় কথায় অস্থির হন না, কিন্তু আপনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, বা নিলেও হুট করে নেন। সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন নি বিধায় আপনার প্রথম ছবি শুরু করতে পঁচিশ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে- এটা সিদ্ধান্তহীনতা বা অস্থিরতার সবচে’ বড় উদাহরণ। আর প্রথম দিন হুট করে যে প্যাক আপ করে দিলেন, সেটা প্রমাণ করে আপনার মধ্যে কোন প্রফেশনালিজ্‌ম নেই। আপনি যে একজন দাম্ভিক লোক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যেটুকুই শ্যুট করা হয়েছে, সেটা দেখলেই... আদৌ যদি তা দেখার সুযোগ কেউ পেয়ে থাকে- তো সে নিশ্চিতভাবেই বুঝতে পারবে, আপনি একজন দাম্ভিক এবং অহঙ্কারী। জানিনা কীভাবে আপনি এই মাধ্যমে এসেছেন, হয়তো কোনভাবে কোনদিন ভালো কিছু করেওছিলেন, সেখান থেকেই আপনার ধারণা হয়ে গেছে, আপনি এই দেশের তথা এই ব্রহ্মাণ্ডের শ্রেষ্ঠ নির্মাতা। আর সেই দম্ভই আপনাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। একজন হতাশাগ্রস্থ, ভেঙ্গে পড়া মানুষ বলতে আপনাকেই বোঝায়। আপনি যে পঁচিশ বছরের গল্প শোনাচ্ছেন, তার কোন ভিত্তি নেই। আমি এই দুদিন ভালো মতো খোঁজ নিয়েছি, ‘ঈষণ খান’ নামে কোন নির্মাতাকে আমাদের মিডিয়া চিনে না। কোন মাধ্যমের কেউই আপনাকে চিনে না, আপনার প্রতি আগ্রহী নয়। একটা লোক পঁচিশ বছর ধরে ছবি বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে, অথচ তাকে কেউ চিনে না- আমাদের দেশের মিডিয়াটা খুব ছোট, এই গল্প এখানে কেউ বিশ্বাস করবে না। তাছাড়া আপনার চলচ্চিত্র নির্মাণের কোন বাস্তব জ্ঞান আদৌ আছে কিনা, তাতেও আমার সন্দেহ আছে। এই দু’দিনে প্রায় আড়াই ঘন্টা শুটিং হয়েছে, আপনি একবারও ক্যামেরায় লুক থ্রু করেননি, মনিটর নেননি, লাইট অ্যারেঞ্জ করেন নি, এমনকি ক্যামেরার কালার ব্যালান্সও করেন নি। পঁচিশ বছর ধরে যে ছবি বানাবেন বলে তৈরি হচ্ছেন, তার কোনো স্ক্রিপ্ট নেই, কাহিনী নেই, পারফর্মার নেই... আপনি আসলে কী করছেন তা আপনি নিজেও জানেন না। কোত্থেকে কে আপনাকে এই ফিল্ম বানানোর বুদ্ধি দিয়েছিলো... আমার ধারণা কুবুদ্ধি, সেটাই আপনাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। কারণ আপনি না পারেন এর বাইরে ভাবতে, না পারেন এর ভেতরে থাকতে। আপনি একটা ব্যর্থতার মহাকাব্য ছাড়া আর কিছু নন, আর আপনার সাথে কাজ করতে গিয়ে আমারও এটা পণ্ডশ্রম ছাড়া আর কি? আপনি আসলে...
ঈষণ : হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি ব্যর্থ। আমি ধ্বংস, আমি একটা বাতিল ইতিহাস, ব্যর্থতার মহাকাব্য। কিন্তু তুমি একবারও বলতে পারবে না, আমি প্রতিভাবান নই। আমার মধ্যে ক্রিয়েটিভিটি নেই- এই কথা তুমি বলতে পারবেনা।
শিমুল: যে ক্রিয়েটিভিটি প্রকাশ হতে পারে না, তার দ্বারা আপনাকে মূল্যায়ণ করা যায় কী করে?
ঈষণ: হ্যাঁ স্বীকার করছি, আমার ক্রিয়েটিভিটি আমি প্রকাশ করতে পারিনি, বিকোশিত হয়নি। তার জন্যে আমি একা দায়ী নই। দায়ী পুরো সিস্টেম। আমাদের দেশে সিস্টেম না থাকাটাই একটা সিস্টেম। আমি কেন ছবি বানাতে পারিনি তা আমি যেমন জানি, তুমিও তা অনুমান করতে পারো। আমি নতুন করে অজুহাত দিবো না। কিন্তু আমি স্পষ্টভাবে দাবী করছি, দেশে সিনেমার নামে যা তৈরি হচ্ছে, তা একটা সিনেম্যাটিক তেলেসমাতি ছাড়া আর কিছু না, কিচ্ছু না। আমি এইসব ছবি বানাবো না, সারাজীবন ছবিই বানাবো না, তবু এই ছবি বানাবো না। ... কিন্তু আমি কী করবো? আমি তো ছবি বানানো ছাড়া আর কিছু জানি না। আমার অগাধ টাকা নেই, বিশাল কোনো কিছুই নেই, বিশাল একটা স্বপ্ন ছাড়া। কিন্তু শিমুল, তুমি অস্বীকার করতে পারো সুনীলের সেই কবিতা? আর সব মরে, স্বপ্ন মরেনা... অমরত্বের অন্য নাম হয় ...? আমি পারিনি। কিছুই আমি পারিনি, গড়তে কিছু পারিনি, জুড়তেও পারিনি। একটু একটু করে তিল তিল করে নিজেকে তৈরি করেছি- ছবি বানাবো। টাকা নেই। প্রডিউসার আমার কাহিনী শুনবে না, তার নিজের গল্প বানাতে হবে। তার জীবনের সত্য কাহিনী, যেটা সদ্য মুক্তি পাওয়া হিন্দী ছবির কাট টু কাট নকল! বার বার একই কাহিনী, একই ঘটনা। শেষমেষ ঠিক করলাম নিজেই বানাবো ছবি। কিন্তু বার বার সিডিউল পড়ে, বারবার পিছিয়ে যায়। নতুন নায়িকা পেলে সবাই ধেই ধেই করে নাচতে থাকে, কে কার আগে তাকে বিছানায় তুলবে। নতুন ডিরেক্টারকে বিপদে ফেলাও মনে হয় তেমননি একটা রীতি। তাই শেষ হয়ে গেল জমানো টাকা।
...এইটা আমার শেষ চেষ্টা ছিলো। এবার অনেক ভেবেচিন্তে এমন একটা কাহিনী লিখলাম, যাতে পারফর্মারই কেবলমাত্র দুজন নয়, বরং সর্বসাকুল্যে সে দুজনই প্রোডাকশন ইউনিট। আমার সেই স্ক্রিপ্ট নাটক শুরুর তিনদিন আগে হারিয়ে গেল! আমি কি হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিবো? বেচতে বেচতে সবই তো বেচে ফেলেছি, এবার আত্মহত্যা ছাড়া আর তো কোন পথ খোলা নেই!
ভেবেছিলাম, কাজ করতে করতে কাহিনীটা নতুন করে সাজিয়ে নিবো, হলনা। মাথাই ঠান্ডা রাখতে পারছিনা, কাহিনী।

[হঠাৎ ঈষণ হিস্টিরিয়া রোগীর মতো করতে থাকবে, চেয়ারের পেছন থেকে সামনে চলে আসবে। তার পিঠ দেখা যাবে, সে ক্যামেরার দিকে পেছন দিয়ে শিমুলের মুখোমুখি মাটিতে হাঁটু দিয়ে বসে পড়বে, তার হাত পকেটে ভরা]

: কিন্তু না, এবার আর পরাজয় নয়, এবার আমি জিতবো। এই মুখ আমি কাউকে দেখাবো না। আমি শেষ হয়ে যাবো, তবু হেরে যাবো না।

[আচমকা ঈষণ পকেট থেকে হাত বের করবে, তার হাতে লাল রঙের কাঁচের শিশি। শিমুলকে কিছু বুঝতে না দিয়ে সে বোতলের ঢাকনা খুলে ভেতরের তরলটা মুখে ঢেলে দিবে, মুহূর্তে তার চেহারা বদলে যাবে। সে দুহাতে মুখ ঢেঁকে চিৎকার দিয়ে উঠবে, বোঝা যাবে তরল অ্যাসিডে নিজের মুখ সে ঝলসে দিয়েছে। ঘটনার আকস্মিকতায় শিমুল বিষ্ময়ে বিমুঢ় হয়ে যাবে, কী করবে ভেবে না পেয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াবে, তার সামনে ঈষণ মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছে। ঈষণ অস্ফুটে ‘পানি’ বলে আর্তনাদ করতেই শিমুল ছুটে যাবে পানির খোঁজে। এদিকে ঈষণ সহ্য করতে পারছিনা বলতে বলতে পকেট থেকে একটা রিভলবার বের করে নিজের নাক বরাবর তাক করে ট্রিগার টেনে দিবে। গুলির আওয়াজে মাঝপথেই থমকে দাঁড়াবে শিমুল। আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে দেখবে, ঈষণ খানের নিথর দেহ পড়ে আছে ক্যামেরার সামনে। এতক্ষণে তার খেয়াল হবে, ক্যামেরা চলছে। সে ছুটে গিয়ে রোল বন্ধ করতেই খুব স্বাভাবিকভাবে উঠে বসবে ঈষণ খান। শিমুল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে]

ঈষণ: কেমন লাগলো আমার অভিনয়?
শিমুল: মানে... পিস্তলের গুলি...
ঈষণ: খেলনা পিস্তল। আসলের মতো দেখতে, তেমনি বাঁজখাই আওয়াজ। যে ব্যাটারা বানায়, তাদের মাথা আছে, যাহোক।
শিমুল: কিন্তু এসবের কী মানে... আমি ঠিক
ঈষণ: ভয় পেয়েছো? হা হা হা... দেখলে তো, ডিরেক্টর হিসেবে না হোক, অ্যাক্টর হিসেবে আমার প্রতিভা তোমাকে স্কীকার করতে হবেই হা হা হা... হ্যাট্‌স অফ টু মি! এন্ড চিয়ার আপ বয়, উই হ্যাভ ডান ইট!
শিমুল: মানে? আমরা কী করেছি? কিছুই তো বুঝতে পারছি না...
ঈষণ: পারবে পারবে। সব বুঝতে পারবে। আগে এই খানে বসো। ঠান্ডা হয়ে বসো। তারপর পুরো ব্যাপারটা চিন্তা করো, সব বুঝতে পারবে।

[শিমুল আবার আগের চেয়ারটাতে গিয়ে বসবে, ততক্ষণে ঈষণ উঠে নিজের মুখের ময়লাগুলো পরিস্কার করছে। সেই অবস্থাতেই দুজনে কথা বলবে।]

শিমুল:দাঁড়ান দাঁড়ান, আমাকে একটু বুঝে উঠতে দিন! ...আপনি একটা স্নাফ মুভি বানাবেন বলেছিলেন
ঈষণ: যেখানে একটা বিভৎসতা থাকবে, নিষ্ঠুরতা থাকবে
শিমুল: আর সেই বিভৎসতা আপনি সৃষ্টি করলেন নিজেকে নিজেই হত্যা করে।
ঈষণ: হ্যাঁ, কারণ হত্যা দৃশ্য ছাড়া স্নার্ফ মুভি করা যায় না।
শিমুল: দর্শক জানবে একজন অহঙ্কারী, দাম্ভিক, সম্বলহীন, নি:স্ব...
ঈষণ: কিন্তু দারুণ প্রতিভাবন চলচ্চিত্র নির্মাতা নিজের ব্যর্থতা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করলো।
শিমুল: আর এদিকে নিজের মৃত্যুদৃশ্য বিক্রী করে ঈষণ খান কামিয়ে নিলো দুই-তিন কোটি...
ঈষণ: উঁহুঁ, দুই মিলিয়ন
শিমুল: মিলিয়ন? আপনি তো বলেছিলেন কোটি। এখন বলছেন বিশ লাখ...
ঈষণ:ইয়েস, বিশ লাখ। বিশ লাখ ডলার! দুই-তিন কোটি টাকার চেয়ে বিশ লাখ ডলার মাপে একটু বড়। হা হা হা

[কথা বলতে বলতেই কোন এক ফাঁকে ঈষণ খান ক্যামেরা থেকে ক্যাসেটটা বের করে নিবে, এবং নতুন একটা ক্যাসেট ভরে রোল করবে, সেটা শিমুল একদমই খেয়াল করবে না]

শিমুল: বিশ লাখ...! মানে প্রায় চৌদ্দ কোটি! ওহ মাই গড। এই এতটুকু একটা কাজের দাম... কিন্তু-
ঈষণ: কিন্তু কী?
শিমুল: আমার একটা খটকা লাগছে। এত টাকা দিয়ে তারা একটা ক্যাসেট কিনবে কেবল একটা মৃত্যুদৃশ্যের অভিনয় দেখতে?
ঈষণ: আগেই তো বলেছি, এরা বিকৃত রুচির...
শিমুল: তাতে কোন সন্দেহ নেই, সেটা নিয়ে প্রশ্নও নেই। কিন্তু কথা হচ্ছে, একটা ডামি দেখে ... আই মিন অভিনয় দেখে এত টাকা কেন তারা দিবে? পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি সিনেমায় মৃত্যুদৃশ্যের অভিনয় থাকে, সেসব দেখেই তারা তাহলে সন্তুষ্ট নয় কেন?
ঈষণ: আমি আগেই অনুমান করেছিলাম, তুমি বুদ্ধিমান। আর বুদ্ধিমানদের সাথে কাজ করতে আমি পছন্দ করি। যদিও একজন বোকা লোকের চেয়ে পার্টনার বুদ্ধিমান হলে যেকোন এফোর্ড প্রায় তিনগুন বেশি দিতে হয়, তারপরও পছন্দ করি। কারণ বুদ্ধিমান লোক আমার অনেক কাজ সহজ করে দেয়।
শিমুল: কীভাবে?
ঈষণ: এভাবে!

[আচমকা সে শিমুলের পেছন থেকে তার গলায় একটা স্টিলের সরু তার পেঁচিয়ে দিবে, সাধারণত শ্বাসরোধ করে হত্যার কাজেই এই অস্ত্রটা ব্যবহার করা হয়। শিমুল কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারটা তার গলায় শক্তভাবে বসে যাবে। ক্যামেরার ভিউ থেকে শিমুলের মুখে মৃত্যুভীতি দেখা যাবে, আর দেখা যাবে ঈষণ খানের দুটো হাত। অন্য ক্যামেরায় ঈষণ খানের মুখটা ক্লোজ ফ্রেমে দেখা যাবে, সেই মুখে হত্যাকারীর নারকীয় অভিব্যক্তি। পৈশাচিক বিভৎসতায় ঈষণ একটু একটু করে হাতের চাপ বাড়াচ্ছে, আর সেই সাথে ভয়ানক একটা স্বরে কথাও বলে চলেছে। আর এদিকে শিমুল একটু একটু করে মৃত্যুটাকে দূরে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করছে, কিন্তু যতই সে চেষ্টা করছে, ততই আরো বেশি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ঈষণ খানের কথা শেষ হওয়া মাত্রই সে মরে যাবে এবং ফ্রেম ডার্ক হয়ে এন্ড টাইটেল উঠতে থাকবে]

ঈষণ: তোমার অনুমান সঠিক। যারা একটা মৃত্যুদৃশ্য দেখার জন্য দুই মিলিয়ন ডলার খরচ করে, তারা আসলে সিনেমা দেখতে চায় না, তারা দেখতে চায় বাস্তব। তারা বাস্তবিকই হত্যাকন্ডটি ঘটাতে চায়। সেজন্যেই এতগুলো টাকা তারা খরচ করে। আমি পাঁচ বছর তোমার অপেক্ষায় ছিলাম, সে তোমাকে খুন করবো বলে। তোমাকেই খুঁজছিলাম কারণ তোমার সাথে আমার আকার আকৃতি পোষাকের মাপ, এমনকি গায়ের রঙ, ব্লাড গ্রুপ পর্যন্ত মিলে যায়। এতগুলো ম্যাচিং দরকার ছিলো, কারণ তোমার ডেডবডিটাকে সনাক্ত করা হবে ঈষণ খান হিসেবে। একটু আগে যে টেপের রোল তুমি বন্ধ করেছো, সেই টেপ চলে যাবে পুলিশের কাছে, তারপর তাদের হাত ঘুরে মিডিয়ার কাছে। সবাই জানবে, ফ্রাস্ট্রেটেড ফিল্ম ডিরেক্টর ঈষণ খান দেনার দায়ে দেউলিয়া হয়ে আর নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে না পারার লজ্জায় আত্মহত্যা করেছে। আর এই ঘটনার একমাত্র স্বাক্ষী ক্যামেরাম্যান শিমুল পুলিশী হয়রানীর ভয়ে পলাতক। অন্যদিকে ঈষণ খানের চেহারা যেহেতু কারো কাছে চেনা নয়, তোমার ক্যামেরাতেও সেই মুখ দেখা যায়নি একবারো, সুতরাং ঈষণ খান অন্য কোন নাম নিয়ে নিশ্চিন্ত মনে বসবাস করবে সকলের সামনে। কেননা, ঘটনার একমাত্র স্বাক্ষী শিমুলই তো মৃত! আর এই মৃত্যুদৃশ্যের সাথে আগের টেপের পুরো অংশটা জুড়ে দিয়ে যে ছবিটা তৈরি হবে, তাতে এই লোমহর্ষক স্নাফ মুভিটির বাজারদর কোন মতেই দুই মিলিয়ন ডলারের কম হতে পারে কি? হা হা হা... কার এত বড় সাহস, ঈষণ খানের মেধা যোগ্যতা আর প্রতিভা নিয়ে প্রশ্ন তোলে?



সমাপ্ত

হঠা‍‍ৎ যদি

দৃশ্য: এক / সকাল
অফিসের হলরুম

[মি. জামশেদ খান হলরুমের ভেতর দিয়ে জনা দশেক কর্মচারীর সালাম গ্রহণ করতে করতে নিজের চেম্বারের দরজা অতিক্রম করবেন। ফাইল হাতে পিএস লিয়ানা তাকে অনুসরণ করলে দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। বন্ধ দরজার ওপর নেমপ্লেট দেখা যাবে- Jamshed Khan, MD, Islam Grouop

দৃশ্য: দুই / কন্টিনিউড
জেকের চেম্বার

[জেকে তার চেয়ারে বসতে বসতে লিয়ানা'র দিকে হাত বাড়িয়ে দিবেন, লিয়ানা তার হাতে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক ধরিয়ে দিবে। চেয়ারে বসে সেটা খুলতেই ফোন বেজে উঠবে। তিনি বিরক্ত চোখে একবার ফোনটা দেখবেন, তারপর তীব্র দৃষ্টিতে তাকাবেন লিয়ানা’র দিকে। লিয়ানার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যাবে]

জেকে : কী ব্যাপার? এটা বাজছে কেন?
লিয়ানা : স্যার এটা ডিরেক্ট কল। যিনি কল করেছেন তিনি আপনার এক্সটেন্‌শন নাম্বার জানেন।
জেকে : সেটা আমার প্রশ্ন ছিলো না। আমি অফিসে আসার পর অ্যাট লিস্ট থার্টি মিনিটস্‌ কোন ফোন রিসিভ করিনা- এটা আপনার জানা থাকা উচিৎ।
লিয়ানা : স্যার উনি যদি সরাসরি কল করেন তো...
জেকে : হাউ ডেয়ার ইউ ক্রস মি! আমার সাথে আর্গুমেন্টে যাবার আগে আপনার ভেবে দেখা উচিৎ, অন্য কোন অপশন আপনার হাতে ছিলো কিনা। ইউ শুড হ্যাভ ডিসকানেক্টেড দ্য ফোন।
লিয়ানা : স্যরি স্যার

[সে ফোনটা সত্যি সত্যিই ডিসকানেক্ট করে দিবে]

জেকে : কফি।
লিয়ানা : রেডি আছে স্যার।... স্যার, একটু আগে এক্স-মিনিস্টার জাহিদ চৌধুরী সাহেব একটা কার্ড পাঠিয়েছেন, এখনই দেখবেন?
জেকে : এক্স-মিনিস্টার সাহেবের কার্ড ক্যান ওয়েট, নট মাই কফি। দিনের প্রথম কফি টাইমলি না খেলে আমার মেজাজ ঠিক থাকে না। আর আমার মেজাজ চটে গেলে এক্স কেন, অ্যাকটিং মিনিস্টারও ঝামেলায় পড়বেন, ইউ নো দ্যাট।
লিয়ানা : স্যরি স্যার। এক্ষুণি দিচ্ছি।

[লিয়ানা কফির মগ টেবিলে রাখবে]

জেকে : ইউনিকর্ন-এর ফাইলটা এনেছেন? মতিউর সাহেবকে বলুন লাস্ট শিপমেন্টের ডিটেইল নিয়ে ঠিক দশটায় বোর্ড রুমে বসতে। সোবহান সাহেব চিটাগাং অফিসের প্রবলেম নিয়ে একটা ডিটেইল রিপোর্ট করবেন। লাঞ্চের আগেই আমি তার সাথে বসতে চাই। সাদেকের কাছে আমার প্রশ্ন- আমাদের চৌদ্দটা গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট বাতিল হলো কী কারণে? অল এভরিথিং ক্লিয়ার?... ওকে। ...হার্ভেস্টারের ব্যাপারটা কী? মেইল এসেছে?
লিয়ানা : ভেন্যু নিয়ে সমস্যা, স্যার। ওরা রিকোয়েস্ট করেছে, আপনি যেন বার্লিনের পরিবর্তে লিসবন প্রেফার করেন।
জেকে : মিটিং কি স্যাটার্ডে’তে? আই অ্যাম স্কেজ্যুলড ফর প্যারিস অন থার্সডে, ইজ ইট? ওকে, দেন আমি প্যারিসের পরিবর্তে বার্লিন লিসবন কোনটাই প্রেফার করছি না। হাওয়েভার, তারা যদি ভেনু চেঞ্জের প্রস্তাব করে, তো আমাদেরও করবার রাইট আছে, কি বলেন? প্রোপজ প্যারিস ওর ক্যানসেল দ্য ডিল।
লিয়ানা : স্যার...!
জেকে : আই রিপিট, ক্যানসেল দ্য ডিল। কার্ডটা খুলেছেন?
লিয়ানা : কোন কার্ড, স্যার? ও আচ্ছা, না স্যার। আপনার যদি ব্যক্তিগত হয়ে থাকে...
জেকে : আমার ব্যক্তিগত হয়ে থাকলে আমার ব্যক্তিগত ঠিকানায় আসতো। অফিসে এসেছে মানেই ওটা অফিশিয়াল পারপাসে এসেছে। খুলুন, খুলে দেখে বলুন, ব্যাপারটা কী।

[লিয়ানা খাম খুলে দেখবে, তারপর জেকের দিকে বাড়িয়ে দেবে]

লিয়ানা : জাহিদ সাহেবের বড় ছেলের বিয়ে, আগামী শুক্রবার, স্যার। ইউ আর কর্ডিয়ালি ইনভাইটেড উইথ ফ্রেন্ডস এন্ড ফ্যামিলি।
জেকে : [খানিকক্ষণ ভেবে নিয়ে] ফোনটা অ্যাকটিভ করুন।

[লিয়ানা ফোন অ্যাকটিভ করতেই সেটায় রিং বাজতে থাকবে, লিয়ানা এবং জেকে দুজনেই ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকবে। জেকে লিয়ানা’র দিকে তাকাতেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে। জেকে ফোনের স্পিকার অন করবেন]

অপরপ্রান্ত : ব্যাপার কী রে ভাই, রিং হতে হতে কেটে গেল, তারপর তখন থেকে ট্রাই করছি...
জেকে : স্যরি স্যার, লাইনটা আমিই ডেড করেছিলাম। আপনি ফোন করেছিলেন তা তো বুঝতে পারিনি। এনিওয়ে, আপনার কার্ড পেলাম।
অপরপ্রান্ত : আরে রাখেন আপনার কার্ড। আপনার সাথে কি কার্ড চালাচালির সম্পর্ক নাকি? আমার উচিৎ ছিলো নিজে গিয়ে বলে আসা...
জেকে : সেইটা না করেই তো আমারে মেরে ফেললেন রে ভাই! এখন আমি যদি না যাই তো আপনি ভাববেন আমি মাইন্ড করেছি। এদিকে ঘটনা তো অন্যরকম। আই হ্যাভ টু লেফট ফর প্যারিস অন থার্সডে!
অপরপ্রান্ত : এইটা আপনি কী বললেন? অবশ্য দোষটা আমারই, আপনার সাথে পরামর্শ না করেই ডেট ঠিক করেছি...
জেকে : আরে না না, কী বলেন স্যার... আমার জন্যে...
অপরপ্রান্ত : ফার্স্ট কার্ডটাই আপনারে পাঠায়েছি, বাকিগুলি এখনও বিলি করা শুরু হয় নাই। আমি বরং ডেট পিছায়ে দেই...

[লিয়ানা একটা ফাইল হাতে নিয়ে প্রবেশ করবেন]

জেকে : স্যার, আমারে আর লজ্জা দিয়েন না, প্লিজ। আপনি আমার জন্যে ছেলের বিয়ে পিছায়ে দিতে পারেন, আর আমি সামান্য একটা ট্যুর পিছায়ে নিতে পারবো না? ডোন্ট ওরি, প্যারিস ক্যান ওয়েট।
অপরপ্রান্ত : সো নাইস অব ইউ, জেকে সাহেব, মনে বড় বল পেলাম।

[সৌজন্যমূলক কথা বলে লাইন কেটে দিবেন]

লিয়ানা : মেইল কি সেন্ড করবো, স্যার?
জেকে : সেন্ড করবেন মানে? এখনো করেন নি?
লিয়ানা : এখনও করিনি স্যার।
জেকে : হোয়াই? এতক্ষণে তো রিপ্লাই চলে আসার কথা ছিলো
লিয়ানা : স্যার আমি ভাবলাম, ...মানে আপনি ফোনে যে রকম বললেন...
জেকে : ওহ্‌ গড, আপনি আমার নির্দেশ ফলো না করে ফলো করছেন আমার টেলি কনভারসেশন? হোয়াট ননসেন্স!
লিয়ানা : মানে স্যার ঠিক তা নয়.. মানে... আমি ভাবলাম আপনি জাহিদ স্যারের প্রোগ্রামে অ্যাটেইন করবেন বললেন, সুতরাং
জেকে : মিস লিয়ানা, আপনি এই অফিসে পুরো ছয় বছর চাকরি করছেন। আমার কাছে কোন কাজটার প্রায়োরিটি কতখানি, সেটা আপনার জানা থাকা উচিৎ!
লিয়ানা : স্যরি স্যার।
জেকে : আমি প্যারিসে আইফেল টাওয়ার দেখতে যাচ্ছি না যে, ইচ্ছে হলো গেলাম কিংবা ইচ্ছে হলো না তো বিয়ে বাড়িতে বোরহানী খাবার লোভে ট্যুর ক্যানসেল করলাম।
লিয়ানা : স্যার আমি দুঃখিত, আমার ভুল হয়ে গেছে। দুঃখিত এবং লজ্জিত।
জেকে : ওকে ওকে। ইট্‌স অলরাইট। শুনুন, শুক্রবার ঠিক সন্ধ্যায় জাহিদ সাহেবের বাড়িতে আমার গাড়ি পৌঁছুবে। সেই গাড়িতে আমার ফ্যামিলির সাথে আপনিও থাকবেন। আপনার দায়িত্ব, প্রেজেন্টেশনের সাথে আমার হাতে লেখা একটা চিঠি জাহিদ চৌধুরীর হাতে পৌঁছে দেয়া।
লিয়ানা : ওকে স্যার, আমি মনে করে আপনার কাছ থেকে চিঠি লিখিয়ে নেবো।
জেকে : গুড। নাও ইউ টক লাইক মাই সেক্রেটারী। [উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে] মতিউর সাহেব রেডি?
লিয়ানা : ইয়েস স্যার।
জেকে : আমি বোর্ডরুম থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে চাই। নো ফোন কল, নো পার্সোনাল মিটিং, নাথিং ইমার্জেন্সি।

[জেকে বেরিয়ে যাবেন, এইখান খেকে টাইটেল শুরু হবে]

দৃশ্য: তিন
জেকে’র বাসা

[জেকে'র স্ত্রী আসমা খুব মনযোগ দিয়ে কোন বই বা ম্যাগাজিন পড়ছেন। তার মেয়ে অরিত্রি কিছুক্ষণ আশপাশে

ঘুরঘুর করে মনযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে শেষে সরাসরি কথা বলে উঠবে]

অরিত্রি : মা, বাবা তো এখনো আসলো না।
মা : হু
অরিত্রি : চারটায় আসার কথা ছিলো
মা : ও
অরিত্রি : এখন বাজছে পাঁচটা পঁচিশ।
মা : আচ্ছা।
অরিত্রি : আচ্ছা মানে? ওহ্‌ মা, তুমি মুখ থেকে বইটা সরাবে?
মা : বই সরাতে হবে কেন? আমি তো তোর কথা শুনছি। প্রতিটা কথায় সাড়া দিচ্ছি...
অরিত্রি : ডিসগাস্টিং! মা, বাবার ফেরার কথা ছিলো চারটায়, এখন বাজছে পাঁচটা পঁচিশ। আমি অলরেডি একঘন্টা পঁচিশ মিনিট লেট।
মা : তো?
অরিত্রি : তো মানে? বাবার আজকে আমার সাথে আমার কলেজে যাবার কথা! বাবা কথা দিয়েছেন। আমার টিচাররা ওয়েট করছেন, গর্ভনিং বডির মেম্বাররা ওয়েট করছেন। তাদের সাথে বাবার মিটিং!
মা : সেখানে কি সব স্টুডেন্টেরই বাবাদের যাবার কথা?
অরিত্রি : মা, তুমি ভালো করেই জানো, সব স্টুডেন্টদের জেকে'র মতো বাবা নেই।
মা : বাহ্‌, সুন্দর বলেছিস তো! জেকে'র মতো বাবা... আচ্ছা, তোর কী মনে হয়, সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে কালে-ভদ্রে যে মানুষটাকে দেখতে পাওয়া যায়, যাকে সবাই জেকে বলে চেনে, জানে, মানে; সে কি আসলেই

তোর বাবা?
অরিত্রি : মা! কী বলছো এসব...?
মা : ভুল বলছি না রে মা, খুব একটা ভুল বলছি না। লোকটা আগে মানুষ ছিলো। এখন আর মানুষই নেই, বাবা হবে কীভাবে! সে একটা যন্ত্র... একটা টাকা বানানোর মেশিন। মেশিনের মতো টাকা বানানোর একঘেয়ে নেশার ঘোরে লোকটা কখন জামশেদ থেকে জেকে হয়ে গেল, আমিই এমনকি টের পেলাম না। নাও জেকে ইজ আ ব্র্যান্ড নেইম!
অরিত্রি : মা, আমি মানে... আই’ম স্যরি, মা।
মা : নো নো, বেবি, ডোন্ট ফিল স্যরি। ইটস অল রাইট। অ্যান্ড ইটস অল ইন দ্য গেম। এতদিন আমি অভিযোগ করে করে ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছি, এবার তুমি শুরু করেছো। তাও ভালো। তোর তো তবু অভিযোগ শোনার আমি আছি, আমার কে আছে, বল?

[অরিত্রি কিছুক্ষণ নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকবে, তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে। খানিক পরে নিচে থেকে গাড়ি স্টার্ট নেয়া এবং ছেড়ে চলে যাওয়ার আওয়াজ পাওয়া যাবে। তিনি পর্দা উঠিয়ে বাইরে তাকাবেন, তারপর চিন্তিত হয়ে মোবাইলে জেকে’র নাম্বার ডায়াল করবেন। ফোন বন্ধ পাওয়া যাবে। তিনি একটু বিরক্ত হবেন]



দৃশ্য: চার / রাত
জেকে’র অফিস

[অফিস ফ্লোর প্রায় ফাঁকা, লিয়ানা কেবল ফ্রন্ট ডেস্কে বসে আছে। অরিত্রি অতি দ্রুত পায়ে হেঁটে ভেতরে ঢুকবে এবং জেকের চেম্বারের দিকে যেতে থাকবে, লিয়ানা উঠে দাঁড়িয়ে তার সাথে কথা বলবে]

লিয়ানা : স্লামালেকুম ম্যাডাম। স্যার তো চেম্বারে নেই।
অরিত্রি : চেম্বারে নেই তো কোথায় আছে?
লিয়ানা : স্যার বোর্ডরুমে। খুব জরুরী মিটিং চলছে।
অরিত্রি : ডাকুন। আমার কথা বলুন। ইট’স মাচ মোর ইম্পর্টেন্ট দ্যান হিজ সো কল্ড মিটিং।
লিয়ানা : স্যরি ম্যাডাম, তাঁকে এখন ডাকা যাবে না। স্যার বলে দিয়েছেন, কোন অবস্থাতেই যেন তাকে ডাকা না হয়। নো ফোন কল, নো পার্সোনাল মিটিং, নট ইভেন ইমার্জেন্সি।

[অরিত্রি গ্রাহ্য না করে ভেতরে যেতে উদ্যত হতেই লিয়ানা তার সামনে এসে পথ রোধ করে দাঁড়াবে]

লিয়ানা : আমাকে আমার ডিউটি করতে দিন, প্লিজ। স্যারের অর্ডার...
অরিত্রি : টু হেল উইথ ইওর অর্ডার অ্যান্ড টু হেল উইথ ইওর ডিউটি!

[অরিত্রি লিয়ানাকে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে যাবে]



দৃশ্য: পাঁচ/ রাত
বোর্ডরুম


[জেকে বসে মিটিং করছেন, তার চারপাশে নানান রকম ফাইল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অরিত্রি বেশ শব্দ করে ভেতরে ঢুকতেই সবাই চমকে তাকাবে, অরিত্রিকে দেখে তারা উঠে দাঁড়াবে নাকি বসেই থাকবে সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে মাঝামাঝি একটা অবস্থায় আঁটকে থাকবে, সবার চেহারায় অস্বস্তি, জেকের চেহারায় চূড়ান্ত রকমের বিরক্তি]

জেকে : সে কি! তুমি এখানে কী করছো? ...লিয়ানা-
অরিত্রি : লিয়ানা মানে তোমার পিএস তো? শি ইজ ফাইন। ওয়েল ম্যানার্ড অ্যান্ড হাইলি কনশাস অ্যাবাউট হার জব। ওবিডিয়েন্ট অ্যান্ড ডিউটিফুল। ...অ্যান্ড ইউ গাইজ অলসো।
জেকে : হোয়াট ননসেন্স! সংযত হও। বেটার ইউ গো টু মাই চেম্বার, অ্যান্ড ওয়েট দেয়ার। আমি তোমার সাথে পরে কথা বলছি।
অরিত্রি : না। পরে নয়, এখনই। তোমার সাথে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিলো ঠিক চারটায়। এখন বাজছে নিয়ার অ্যাবাউট সেভেন। দেন অফকোর্স আই’ম দ্য ফার্স্ট প্রায়োরিটি। আর আপনাদের ব্যাপারটা কী? সাতটা বাজতে চললো, আপনারা বাসায় যাবেন না? বাবার নাহয় স্ত্রী-সন্তান-ঘর-সংসার নেই, আপনাদেরও কি নেই?
জেকে : অরিত্রি! বিহেভ ইওরসেলফ। ইউ আর নো লংগার আ কিড। অ্যান্ড ইউ আর টকিং ইনসাইড মাই অফিস। আমার স্টাফদের সাথে বেয়াদবী করবার কোন অধিকার তোমার নেই। এটুকু বিবেচনার মতো বয়স তোমার নিশ্চয়ই হয়েছে।

[স্টাফরা জেকের অনুমতির অপেক্ষা না করেই ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে, অরিত্রি কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থেকে এক পর্যায়ে বসে পড়বে। তাকে দেখে মনে হবে সে কিছুটা হতবুদ্ধি, কিছুটা অনুতপ্ত]

অরিত্রি : আই অ্যাম স্যরি বাবা, আমার ভুল হয়ে গেছে।
জেকে : [কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে, যেন অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিলেন এভাবে বলবেন] ওকে, ইট’স অলরাইট।
অরিত্রি : নো, ইট’স নট অলরাইট। আমার এরকম উদ্ভট আচরণ করা উচিৎ হয়নি। আমি খুবই জঘন্য আচরণ করেছি। ...তুমি আংকলদের ডাকো, আমি তাদের স্যরি বলবো...
জেকে : আচ্ছা ঠিক আছে, লাগবে না সেসব। ওনারা তোমাকে চেনেন, জানেন, বোঝেন। কিচ্ছু মনে করবেন না। ...তাছাড়া দোষ আমারও ছিলো। আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম তোমার সাথে কলেজে যাবো। আই’ভ্‌ ব্রোকেন মাই কমিটমেন্ট, যেটা আমি কখনো করি না! সো, আই অ্যাম অলসো স্যরি, বাবাই!
অরিত্রি : ঠিক তো? ...তাহলে অত জোরে ধমক দিলে কেন? আমি যদি কেঁদে ফেলতাম? তাহলে কি তোমারও কান্না পেতো না?

[বলতে বলতে সে সত্যিই কেঁদে ফেলবে, জেকে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উঠে দাঁড়াবেন]

জেকে : আরে আরে কী মুশকিল! এসব কী শুরু করলি...। আচ্ছা বাবা, বলছি তো আমি স্যরি... এবার কান্না থামা...
অরিত্রি : না, থামাবো না। তোমার কিচ্ছু মনে থাকে না। তোমার বাবাই সোনার কান্না থামাতে গেলে আইসক্রিম লাগে!
জেকে : ওহ্‌ ড্যাম ইট..! লিয়ানা- লিয়ানা...

[লিয়ানা এসে ঢুকবে]

: আইসক্রিম। আমার মেয়ে আইসক্রিম খাবে।

লিয়ানা : নিশ্চয়ই স্যার। আমি এক্ষুণি ব্যবস্থা করছি। কোনটা আনবো ম্যাডাম, মানে আপনার কোন চয়েস...?
জেকে : তাই তো, তোর জানি কোনটা বেশি পছন্দ...
অরিত্রি : থাক, তোমাকে আর মনে করতে হবে না...
লিয়ানা : ওকে ম্যাডাম, আমি দেখছি।
জেকে : আচ্ছা লিয়ানা, আমরা তো ফুড প্রোডাক্ট-এরও ব্যবসা করি, তাহলে আমাদের ব্র্যান্ডের কোনো আইসক্রিম নেই কেন?
অরিত্রি : ওহ্‌ গড, বাবা তুমি ব্যবসা ছাড়া একটা কিছুও ভাবতে পারো না, তাই না? আমি একটা আইসক্রিম খেতে চেয়েছি, তাতেও তোমার ব্যবসা বাড়ানোর চিন্তা মাথায় এলো?

[লিয়ানা নিঃশব্দে বেরিয়ে চলে যাবে, জেকে জোরে হেসে উঠবেন, প্রাণখোলা হাসি]

জেকে : বাবাই শোন্‌, আমার ব্যবসার এখন যে কারেন্ট সিচুয়েশন, তাতে করে আমি যদি এই মুহূর্তে সব স্টপ করে দিয়ে শুধু তাকিয়ে থাকি, তাতেই এটা বছর খানেকের মধ্যে দ্বিগুণ হয়ে যাবে। কিন্তু আমি যদি শুধু ঐ তাকিয়ে থাকাটা ছেড়ে দিই, দেখবি এক মাসের মধ্যেই সব হাপিস হয়ে যাবে।
অরিত্রি : তুমি ব্যবসাটা খুব ভালো বোঝো, তাই না বাবা?
জেকে : ইয়েস মাই বেবি! অ্যান্ড আই’ম প্রাউড টু বি আ রিয়েল বিজনেসম্যান।
অরিত্রি : ব্যবসার মতো আর কিছুই কি তোমাকে টানে না?
জেকে : কেন টানবে না, এই যেমন ধর... মানে...
অরিত্রি : বাবা, তুমি আমার সম্পর্কে কতটুকু জানো?
জেকে : তোর সম্পর্কে জানবো মানে? তোর সম্পর্কে আবার জানা না জানার কী আছে?
অরিত্রি : এই যেমন, আমার কী ভালো লাগে, মন্দ লাগে, আমার বন্ধু কারা, আমি কোন ক্লাসে, কোন কলেজে পড়ি... আমার বয়স এখন কত চলছে...?

[জেকে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে যাবেন, তাকে দেখে মনে হবে তিনি গভীর চিন্তায় পড়ে গেছেন। বোঝা যাবে মেয়ে যেসব অনুযোগ করছে তার কোনটাই তিনি খণ্ডাতে পারছেন না। তাঁকে বেশ অসহায় দেখাবে]

অরিত্রি : বাবা, আমার জন্মদিনটা কি তোমার মনে আছে?

[জেকে নিরুত্তর]

অরিত্রি : আজ কত তারিখ তা কি তোমার মনে আছে, বাবা?
জেকে : আজ মঙ্গলবার, ১৪ জুলাই। ঠিক বললাম?
অরিত্রি : হ্যাঁ ঠিক বলেছো। কিন্তু এই প্রশ্নটা কেন করলাম, সেটা তোমার এখনো মনে পড়লো না। ... কাল পনেরোই জুলাই, মা’র জন্মদিন। বহুদিন তুমি মধ্যরাতে মাকে উইশ করে চমকে দাওনি।

[জেকে করুণ চোখে তাকিয়ে থাকবেন, কিছু একটা বলতে যাবেন, পারবেন না। তাঁর গলা ধরে আসবে, চেহারায় অপরাধবোধ জেগে উঠবে। তিনি অসহায় বোধ করবেন, অস্থির-অস্বস্তি বোধ করতে থাকবেন। অরিত্রি কথা বলতেই থাকবে]

অরিত্রি : তুমি ঘড়ি না দেখে পৃথিবীর যেকোন প্রান্তের সময় বলে দিতে পারো, প্রায় সবগুলো শহরের শেয়ার বাজারে তোমার টাকা খাটে, ডলার-পাউন্ড-ইয়েনের বাজার-দর কষতে তোমার ভুল হয় না, অথচ তোমার মেয়ের বয়স কত, তুমি জানো না। তোমার স্ত্রীর জন্ম-তারিখ তোমার মনে থাকে না। ...কবে তুমি আমাদের কাছ থেকে এতটা দূরে চলে গেলে, বাবা? তুমি কি জানো, মার এখন সন্দেহ হয়, তুমি বুঝি আর মানুষ নেই। একটা যন্ত্রে পরিণত হয়েছো। টাকা বানানোর যন্ত্র। তোমার ব্র্যান্ড নেম নাকি "জেকে", পারহ্যাপস্‌ দ্য বেস্ট ব্র্যান্ড অব দ্য কান্ট্রি! ... তুমি যন্ত্র-জীবন মেনে নিতে পারো বাবা, আমরা পারছিনা। প্লিজ ফিরে এসো বাবা, উই নিড ইউ। ফর গডস সেক, বিলিভ আস, উই লাভ ইউ। অ্যান্ড উই রিয়েলি ডু কেয়ার!

[জেকে মাথায় হাত দিয়ে চুপচাপ বসে আছেন, তার মাথা নিচু, চোখ বন্ধ। অরিত্রি নিঃশব্দে বের হয়ে চলে যাবে, জেকে খেয়াল করবেন না। লিয়ানা প্রবেশ করবেন, হাতে আইসক্রিম]

লিয়ানা : সেকি, ম্যাডাম কোথায়, স্যার?
জেকে : [মাথা নিচু অবস্থাতেই] বোধ হয় চলে গেছে।
লিয়ানা : কিন্তু স্যার আইসক্রিম... মানে আমি কি খুব বেশি দেরি করে ফেলেছি?
জেকে : ইটস অলরাইট লিয়ানা। দেরি আপনার নয়, দেরি হয়েছে আসলে আমার।... আপনি এক কাজ করুন, বাসায় চলে যান। আর হ্যাঁ, বাসায় যাবার আগে একটা মেইল পাঠিয়ে দিয়ে যান। আমি প্যারিস যাচ্ছিনা।
লিয়ানা : স্যার...?

[জেকে লিয়ানার অবাক চেহারার সামনে দিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে চলে যাবেন]




দৃশ্য: ছয় / দিন
জেকে’র বাসা থেকে রাস্তা (গাড়ির ভেতর)

[জেকে'র বাড়ির গাড়ি বারান্দায় একটা জিপ দাঁড়িয়ে, সেই গাড়িতে হালকা কয়েকটা লাগেজ, যেমন ফ্রুট বাস্কেট, বড় ফ্লাস্ক, হট-পট এরকম কিছু সরঞ্জাম তোলা হচ্ছে। গাড়িতে এসে উঠবেন জেকে, আসমা, অরিত্রি এবং লিয়ানা। সবার পোষাক-আষাক এবং অভিব্যক্তিতে বেড়াতে যাবার মুড বোঝা যাবে। গাড়ি বেরিয়ে আসবে, তারপর হাইওয়ে ধরে চলতে থাকবে। কার-স্টিরিওতে গান বাজতে থাকবে- "হঠাৎ যদি আমি থেমে যেতাম"। গানটা কার, শিল্পী কে, কার কম্পোজিশন এইসব নিয়ে জেকে, অরিত্রি আর লিয়ানা আলোচনা করতে থাকবে। গাড়ি একসময় একটা ট্যুরিস্ট স্পটে এসে থামবে। সবাই গাড়ি থেকে নেমে আসবে]


দৃশ্য: সাত/ দিন
পার্ক

[জেকে মেয়েকে নিয়ে জায়গাটা ঘুরে ফিরে দেখতে বেরিয়েছেন, আসমা আর লিয়ানা বসে গল্প করছে]

আসমা : আচ্ছা লিয়ানা, তুমি আমাকে ম্যাডাম ম্যাডাম করছো কেন? তুমি জেকে’র স্টাফ, তাকে স্যার বলবে, ঠিক আছে। আমার তো আর স্টাফ নও।
লিয়ানা : তাহলে কী বলে ডাকবো?
আসমা : তোমার যা ইচ্ছা। ভাবী ডাকতে পারো।
লিয়ানা : ভাবী না ডেকে বরং আপা ডাকি?
আসমা : ডাকতে পারো। চাইলে আন্টিও ডাকতে পারো, আমার কোন আপত্তি নেই। আর তাছাড়া আমার মেয়েই প্রায় তোমার বয়েসী...চুল সাদা হতে ধরেছে, বুড়ো তো হয়েই গেলাম, আর কত?
লিয়ানা : জন্মদিনে এসব ভাবতে নেই, ম্যাডাম....ওহ্‌ না আপা!
আসমা : একটা ব্যাপার কি খেয়াল করেছো লিয়ানা, জন্মদিনেই সাধারণত এই ধরণের ভাবনাগুলো বেশি বেশি মাথায় আসে...
লিয়ানা : এই জন্যে আমি জন্মদিন কখনো সেলিব্রেটই করি না।
আসমা : সেকি! আমার কথা আলাদা, আমার বয়স হয়েছে.... কিন্তু তুমি কেন এই বয়সে... নো নো ইয়াং লেডি, বৈরাগ্য-ভাবনার বয়স তো এটা নয়। কাম অন চিয়ার আপ! লিভ দ্য লাইফ উইথ অল ইটস কালার।
লিয়ানা : আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন। আপনার সাথে আমার আরো আগে আলাপ হওয়া উচিত ছিলো।
আসমা : কেন নয়? আমি কথা বলার মানুষই পাইনা! তোমার স্যার তো সারাদিন তোমাদের সাথেই থাকেন। আর অরিত্রি? একান্ত বাধ্য না হলে সে আমার কাছেও ঘেঁষে না। ...আমি তাই সারাদিন পড়ি। পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে এক সময় নিজের সাথেই কথা বলতে শুরু করি। আশপাশে কেউ থাকলে ভাববে এ কি পাগল হয়ে গেল নাকি?... কিন্তু জানো, আশপাশে কেউ থাকেই না!
লিয়ানা : আমি বলি কি, স্যারকে নিয়ে আপনি ক’দিন ঘুরে আসেন। স্যার তো দিন কয়েক পরে প্যারিস যাচ্ছেন, আপনি আর অরিত্রিও সাথে চলে যান...
আসমা : কী লাভ? সে থাকবে সারাদিন তার বিজনেস মিটিং নিয়ে, আমরা হোটেলের রুমে বসে প্যারিসের ভিউকার্ড দেখবো, রোডম্যাপ মুখস্থ করবো!

[লিয়ানা মাথা নিচু করে বসে থাকবে]

আসমা : আমার বাবাকে তুমি দ্যাখোনি। তিনি এখন কানাডায়, আমার বড়ভাইয়ের ওখানে থাকেন। বাবা সবসময় একটা কথা বলতেন, বি সামবডি। কিছু একটা হও। বাবার সাথে জামশেদের প্রথম যেদিন দেখা হলো, বাবা প্রশ্ন করলেন- তোমার পরিচয়?’ জামশেদ বললো- আমি জামশেদ খান, এম. কম. পাশ করেছি। বাবা যে কী খুশি হলেন, বললেন- অনেকদিন পর একজন মানুষ পেলাম, যে "আমার" নয়, "আমি" বলে নিজের পরিচয় দেয়
লিয়ানা : সত্যিই তো, আমার একশ' বিঘা জমি আছে- এই পরিচয়ের চেয়ে আমি এমএ পাশ করেছি কিংবা আমি এই কাজটা শিখেছি বা এটা করতে জানি -এই পরিচয়টা কি অনেক বেশি গৌরবজনক নয়?
আসমা : অথচ সেই জামশেদ খান কীভাবে যেন জেকে হয়ে গেল! এখন তার পরিচয়- জেকে ইজ ওয়ান অব দ্য বিগেস্ট ক্যাপিটালিস্ট ইন দিস কান্ট্রি!

[অরিত্রিকে দেখা যাবে এদিকে আসছে, তার হাতে নানা বর্ণের বেশ কিছু ফুল। বোঝা যাবে, পার্কেরই কোনখান থেকে সংগ্রহ করা, তাজা ফুল। সে ফুলগুলো মা'র দিকে ছুড়ে দিবে]

অরিত্রি : এই নাও মা, তোমার জন্মদিনের উপহার। খুশি তো? এটা কিন্তু বাবার দেয়া।
মা : তোর বাবা কখনো বাজারের কেনা ফুল আমার হাতে দেয়নি। সব সময় এখান ওখান থেকে ফুল ছিঁড়ে নিয়ে এসে দিতো।
অরিত্রি : তুমি সেটা সাপোর্ট করতে? আমার তো ফুল ছিঁড়তে ভীষণ মায়া লাগে, কষ্ট হয়।
লিয়ানা : আমারও তাই। আমার কাছে মনে হয়, আমি যত সুন্দর করেই সাজাই না কেন, ফুলগুলো গাছে যত সুন্দর ছিলো, ততটা সুন্দর দেখাবে না।
আসমা : একবার কী হয়েছে জানিস, আমার একটা গোলাপ দেখে এত ভালো লাগলো, জেদ ধরে বসলাম সেটা আমার চাই'ই চাই। জামশেদ বেচারা আর কী করে, অন্য লোকের বাগান, মালি দারোয়ান কেউ নাই দেখে বীরের মতোন ঢুকে পড়লো ভেতরে। তা ঢুকেছিস ভালো কথা, গেট দিয়ে ঢোক। না তিনি ঢুকলেন দেয়াল টপকে।
অরিত্রি : ওয়াও! হাও রোমান্টিক! তারপর?
আসমা : তারপর আবার কী? বাগানের ভিতর ছেড়ে রাখা কুকুর ছিলো। এমন তাড়া করলো, বেচারা হাঁচড়ে পাছড়ে দেয়াল টপকে... ট্রাউজার ছিঁড়ে হাত পা ছিলে সে এক বেকায়দা অবস্থা!

[তিনজনেই গলা ছেড়ে হেসে উঠবে]


দৃশ্য: আট / দিন
পার্ক

[জেকে বসে আছেন একটা বেঞ্চের ওপর। তার পাশের জায়গাটা খালি। তিনি এদিক ওদিক তাকিয়ে বেঞ্চের ওপর শুয়ে পড়বার ভঙ্গি করতেই চমকে উঠবেন, একটা ফুটফুটে সুন্দর বাচ্চা মেয়ে বসে আছে। এই একটু আগেই সেখানে কেউ ছিলো না, ফলে জেকের বিষ্ময়ভাব সহজে কাটতে চাইবেনা। তিনি স্বাভাবিক হতে চাইবেন, মেয়েটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্রয়ের হাসি হাসবেন। মেয়েটাও তার দিকে তাকিয়ে হাসবে, তার ফোকলা মাড়ি বেরিয়ে পড়বে। তা দেখে জেকে প্রাণখুলে হেসে উঠবেন]

জেকে : কী নাম তোমার?
মেয়ে : উর্মী।
জেকে : বাহ্‌! ভারী সুন্দর নাম।
মেয়ে : [একই ভঙ্গিতে] কী নাম তোমার?
জেকে : [বিস্মিত] জামশেদ। আমার নাম জামশেদ।
মেয়ে : [একই ভঙ্গিতে] ভারী পচা নাম।
জেকে : আরে এ মেয়ে বলে কি! ভেরি স্ট্রেঞ্জ!
মেয়ে : ভেরি স্ট্রেঞ্জ!

[জেকে বেশে জোরে হেসে উঠবেন। হাসতে হাসতেই লক্ষ্য করবেন, মেয়েটার হাতে একটা বল। বলটা একটু আগেদেখেছেন বলে মনে করতে পারবেন না। তিনি একটু চিন্তিত হবেন। মেয়েটা বলটা নিয়ে খেলতে থাকবে, তিনি বলটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সম্মোহিতের মতো হয়ে যাবেন। আস্তে আস্তে তার মুখ থেকে হাসি মুছে যাবে, তিনি কিছুটা চিন্তিত ও ভীত বোধ করতে থাকবেন। তার বুকে হঠাৎ চিনচিনে ব্যথা করতে থাকবে। মেয়েটা একইভাবে বল নিয়ে খেলছে, তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। তিনি সে দৃষ্টি সহ্য করতে পারছেন না, আবার চোখ ফিরিয়ে নিতেও পারছেন না। তার কানে বিভিন্ন রকমের কোলাহল অস্পষ্ট থেকে ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে, যেন এক ধরণের হ্যালুসিনেশন। তিনি বুকের কাছটা খামচে ধরে একপাশে কাত হয়ে পড়বেন। তার কানে সারাদিনের ব্যস্ততা, গাড়ির হর্ণ, অনেক মানুষের চিৎকার, গ্রামের একদল ছেলেমেয়ের দাড়িয়া-বান্ধা বা ফুটবল খেলার সময়কার চিৎকার-কোলাহল, পরক্ষণেই আবার টাইপ-রাইটারের বা কম্পিউটারের কী বোর্ডের খটাখট শব্দ... ইত্যাদি নানা ধরণের স্পষ্ট-অস্পষ্ট আওয়াজ ধ্বণি-প্রতিধ্বণি সৃষ্টি করবে। তিনি হাঁ করে দম নিতে নিতে হাসফাস করতে থাকবেন। ধীরে ধীরে বেঞ্চে শরীর এলিয়ে দিতেই বাচ্চাটা ম্যাজিকের মতো মিলিয়ে যাবে। ফ্রেম ডিজলভ্‌ড হয়ে পরের দৃশ্যে চলে যাবে]


দৃশ্য: নয় / দিন
বাসের ভেতর

[জেকে বসে আছেন একটা চলন্ত বাসের সিটে। জানালার কাঁচে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে গেছিলেন, গাইড তার ঘুম ভাঙ্গাচ্ছে। তিনি চোখ মেলে নিজেকে বাসের ভেতর দেখে ভীষণ অবাক হবেন। গাইডের প্রশ্ন তার কাছে আস্তে আস্তে স্পষ্ট হবে]

গাইড : স্যার কোথায় নামবেন বললেন না?
জেকে : আমি কোথায়?
গাইড : লে বাবা, ঘুমের চোটে দুনিয়া আন্ধার! ... আমরা স্যার নবীনগরের কাছে। আপনি কোথায় নামবেন?
জেকে : তোমার বাস থামবে কোথায়?
গাইড : টেকনিক্যাল মোড়ে। তারপরে টাউন সার্ভিস যাবে মতিঝিল পর্যন্ত। আপনি কতদূর যাবেন?
জেকে : অ্যাঁ? হ্যাঁ হ্যাঁ মতিঝিল পর্যন্ত যাবো।
গাইড : তাহলে বাস থেকে নেমে কাউন্টারে বসবেন, ওইখান থেকে টাউন সার্ভিসের বাস...
জেকে : না ঠিক আছে, আমাকে নিতে গাড়ি আসবে।
গাইড : তাইলে তো ভালই।

দৃশ্য: দশ / দিন
বাসস্ট্যান্ড

[জেকে বাস থেকে নেমে তার মোবাইল বের করে ডায়াল করবেন। কানে ধরে থাকবেন, কিন্তু কোনও ডায়াল টোন শোনা যাবে না। বারবার তিনি চেষ্টা করতে থাকবেন, নেটওয়ার্ক প্রবলেম-এর যান্ত্রিক শব্দ শোনা যাবে। তিনি বিরক্ত হয়ে একটা ট্যাক্সি ডেকে তাতে উঠে বসবেন, ট্যাক্সি চলতে শুরু করবে]

দৃশ্য: এগারো / দিন
মতিঝিল

[জেকে একটা বহুতল ভবনের সামনে ট্যাক্সি থেকে নামবেন, তার চোখে মুখে অবসাদ। তিনি নিজের অফিস বিল্ডিংটা নিচে থেকে ওপর পর্যন্ত একবার তাকিয়ে দেখবেন, তারপর লিফটের দিকে এগিয়ে যাবেন]

দৃশ্য: বারো / দিন
লিফটের সামনে

[জেকে লিফট থেকে নেমে তার অফিসের দিকে চলে যাবেন]


দৃশ্য: তেরো / দিন
অফিসের হলরুম

[প্রথম দৃশের অফিসে তিনি প্রবেশ করেছেন, স্বভাবসুলভ হেঁটে চলেছেন নিজের চেম্বারের দিকে। কেউ তাকে লক্ষ্য করছে না বা সালাম দিচ্ছে না, তার উপসি'তি যেন কেউ টেরই পায়নি। তিনি থমকে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা লক্ষ্য করবেন, তারপর সোজা চেম্বারের কাছে চলে যেতেই লিয়ানা তার সামনে এসে দাঁড়াবেন]

লিয়ানা : এক্সকিউজ মি স্যার, আপনি কি কাউকে খুঁজছেন?
জেকে : হোয়াট ননসেন্স! আমি কাউকে খুঁজবো কেন?
লিয়ানা : মানে আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি কাউকে খুঁজছেন। হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ স্যার?
জেকে : হোয়াট ক্যান ইউ ডু ফর মি? নাইস জোক! হোয়াট হ্যাপেন্ড টু ইউ অল? আপনারা কি আমাকে চিনতে পারছেন না?
লিয়ানা : কী আশ্চর্য! আপনাকে আগে দেখেছি বলে তো মনে হচ্ছে না। স্যার ডোন্ট টেক ইট বদারেশন, আপনাকে কি আমাদের চেনার কথা?
জেকে : হাউ ডেয়ার ইউ স্পিক সো! আমার সঙ্গে এই রসিকতার মানে কী?
লিয়ানা : স্যার কোথাও নিশ্চয়ই একটা ভুল হচ্ছে। আমি মোটেই আপনার সাথে রসিকতা করছি না। আপনি কি স্যারের সাথে দেখা করতে এসেছেন? স্যার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া কারো সাথে দেখা করেন না।
জেকে : ওহ্‌ স্টপ ইট! জাস্ট শাট আপ!!

[অন্যান্য টেবিল থেকে সবাই এদিকে এসে গোল হয়ে দাঁড়াবে, জেকে অসহায় বোধ করবেন]

জেকে : সমস্যাটা কী? আপনারা এরকম আচরণ করছেন কেন? আপনারা কি আমাকে চিনতে পারছেন না?
জনৈক : সমস্যাটা কী, লিয়ানা? কে এই লোক?
জেকে : কে এই লোক মানে? সাদেক সাহেব, আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি জেকে, জামশেদ খান, আপনাদের এমডি।
সাদেক : আপনি জেকে, জামশেদ খান; বেশ ভালো। তা বুঝলাম আপনি জামশেদ খান ওরফে জেকে সাহেব। আপনি আমাদের এমডি- এটাতো বুঝলাম না।

[জেকে প্রচন্ড আক্রোশে সাদেক সাহেবের কলার চেপে ধরবেন। সবাই হতভম্ব হয়ে যাবে। সাদেক অগ্নিদৃষ্টিতে জেকের দিকে তাকিয়ে থাকবে, তারপর আস্তে আস্তে হাত উঠিয়ে জেকের হাতদুটো চেপে ধরবে, তারপর কলার থেকে ঝটকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিবেন]

সাদেক : হাতদুটো পকেটে রাখুন মিস্টার! আপনার মুখ যা দাবী করছে, হাত বলছে তার উল্টো কথা। নিজেকে ইসলাম গ্রুপের এমডি দাবী করছেন, অথচ আচরণ করছেন গুণ্ডা-মাস্তানদের মতো!

[জেকে নার্ভাস বোধ করবেন, ধপ করে বসে পড়বেন পাশের একটা চেয়ারে। কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াবেন]

জেকে : ওকে, ওকে... আই অ্যাম স্যরি! বাট লেট মি থিংক এগেইন। আজ ফার্স্ট এপ্রিল নাকি? আপনারা আমার সাথে রসিকতা করছেন নাতো?
লিয়ানা : দেখুন, আপনি যদি আমাদের এমডি হন, তো আজ ফার্স্ট এপ্রিল হতেও পারে; আর আমরা সবাই আমাদের স্বঘোষিত এমডি’র সাথে রসিকতা করছি এটাও সত্যি হতে পারে!

[জেকে ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে যাবেন, তখন হঠাৎ এমডি’র চেম্বারের দরজায় তার দৃষ্টি যাবে। সেখানে লেখা- Noor-Ul Islam, Chairman, Islam Group। জেকে লেখাটা বিড়বিড় করে পড়বেন, তারপর স্বগতোক্তির মতো বলতে থাকবেন]

জেকে : নুরুল ইসলাম তো আমার শ্বশুরের নাম! তিনি তো...
লিয়ানা : ইয়েস মিস্টার, কী যেন?.. ও হ্যাঁ, জেকে। তো মিস্টার জেকে, নুরুল ইসলাম সাহেব আমাদের, মানে ইসলাম গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং আমাদের জানা মতে জামশেদ খান বা জেকে নামে তাঁর কোন জামাই নাই। তাঁর একটাই মেয়ে, যিনি তাঁর স্বামীর সাথে কানাডায় থাকেন। সেই ভদ্রলোক জন্মসূত্রে কানাডিয়ান।
জেকে : তার মানে?
সাদেক : মানে সোজা। ইউ হ্যাভ নো বিজনেস হিয়ার এনিমোর। দরজা কোন দিকে আশা করি সেটাও ভুলে বসেন নি?
জেকে : [কিছুক্ষণ নিরব অর্থহীন দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকিয়ে] আমি ইসলাম সাহেব, আই মিন মি. চেয়ারম্যান-এর সাথে একবার দেখা করতে পারি?
লিয়ানা : জ্বি না, পারেন না। তিনি অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া কারো সাথে দেখা করেন না। তাছাড়া তিনি এখন অফিসে নেইও। আপনি কি তাহলে এবার...

[জেকে মাথা নিচু করে অসহায় ভঙ্গিতে বেরিয়ে যাবেন, যেতে যেতে নিজের মনেই গজগজ করতে থাকবেন- সব ষড়যন্ত্র! আমি দেখে নেবো সবাইকে। এত বড় অপমান? পেছন থেকে সবাই বিভিন্ন আপত্তিকর মন্তব্য করতে থাকবে, নিজেদের রসিকতায় নিজেরাই হেসে উঠবে হো হো করে]


দৃশ্য: চৌদ্দ / দিন
বাড়ির গেট

[পূর্বে দেখানো জেকে’র বাড়ির গেট-এ ট্যাক্সি দাঁড়াবে, তিনি ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে গেট দিয়ে ঢুকতে যাবেন, দারোয়ান এসে বাধা দিবে]

দারোয়ান : স্যার কই যাইবেন?
জেকে : [অবাক হয়ে দেখবেন, চিনতে পারবেন না] তুমি কে? হু আর ইউ এন্ড হোয়াট্‌স ইয়োর বিজনেস হিয়ার?
দারোয়ান : আমি স্যার ফিরোজ। এই বাড়িতে চাকরি করি স্যার, এই বাড়ির দারোয়ান। কোনও বিজনেস করি না। গেরামে থাকতে অবশ্য বিজনেস করতাম, পান-বিড়ির বিজনেস...
জেকে : তোমাকে আগে দেখেছি বলে তো মনে হচ্ছে না। কতদিন আছো এই বাড়িতে?
দারোয়ান : তা ধরেন স্যার চাইর-পাঁচ বছর তো হইবোই। আমিও আপনেরে কোনদিন দেখি নাই স্যার। আপনি কি স্যারের কেউ হন?
জেকে : হোয়াট ননসেন্স!
দারোয়ান : স্যারে তো বিশ্রাম করতেছেন। এখন তিনি নিচে আসবেন না, তারে ডাকাও যাবে না। আপনের দরকারটা কী, আমারে বলেন, আমি ইন্টারকমে স্যারের সাথে কথা বলায়ে দিতাছি।
জেকে : কী তখন থেকে স্যার স্যার করছো। স্যারটা আবার কে? তোমার স্যার তো আমি।
দারোয়ান : [হেসে ফেলবে] এইটা তো স্যার ঠিকই। কোট টাই পরা যে কোন মানুষই হইল আমরার কাছে স্যার। তয় তেনার কথা আলাদা। তিনি হইলেন আমার অন্নদাতা। এই বাড়ির মালিক, আমারও মালিক।
জেকে : কী! ওহ্‌ শীট। এখানেও সেই একই ব্যাপার! হচ্ছেটা কী আমার সাথে!

[জেকে ভেতরে ঢুকতে যাবেন, দারোয়ান তাকে বাধা দিতে থাকবে, তিনি বাধা অস্বীকার করে ভেতরে ঢুকে যাবেন। দারোয়ান তার পেছনে পেছনে ঢুকবে]

দৃশ্য: পনেরো/ বাড়ির সামনে
দিন

[জেকে ভেতরে যেতে চাচ্ছেন, দারোয়ান কিছুতেই তা দিবে না। এই নিয়ে হৈচৈ শুরু হবে, কোলাহল শুনে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবেন এক ভদ্রলোক]

ভদ্রলোক : কী ব্যাপার, সমস্যা কী, ফিরোজ?
দারোয়ান : স্যার এই লোকে কইতেছে এইটা বলে তার নিজের বাড়ি। আমার মনে কয় মাথায় সমস্যা।
ভদ্রলোক : চুপ করো! তুমি তোমার কাজে যাও, আমি দেখছি।
জেকে : না না, এখানে দেখাদেখির তো কিছু নেই। আমি গত আট বছর ধরে এই বাড়িতে বাস করছি। আজ সকালেও এই বাড়ি থেকে আমি বেরিয়েছি।
ভদ্রলোক : আমি ঠিক বুঝলাম না আপনার কথা। আপনি আট বছর এ বাড়িতে বাস করছেন কীভাবে? আজ সকালে এ বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন মানে? আমি তখন কোথায় ছিলাম? ...এটা আমার বাড়ি। আমার নিজের তৈরি বাড়ি। চৌদ্দ বছর আমি এ বাড়িতে বাস করছি। আমি নিজে চৌদ্দ বছর আগে প্লট কিনে বাড়ি বানিয়েছি। আপনি কী বলছেন এসব?
জেকে : হতে পারে, আপনি যে নিজে এ বাড়ি বানিয়েছেন, আমি অবিশ্বাস করছিনা। তারপর বিক্রি করেছেন... ইনফ্যাক্ট এমনটাই হয়েছে... আমি তো আট বছর আগে বাড়িটা কিনেছি... আমার ঠিকঠাক মনে পড়ছেনা এখন, পারহ্যাপস আপনার কাছ থেকেই কিনেছি...
ভদ্রলোক : আই অ্যাম স্যরি, মিস্টার...
জেকে : জেকে, জামশেদ খান।
ভদ্রলোক : ওকে মিস্টার জামশেদ খান। আই অ্যাম স্যরি টু সে, এ রকম কিছু আদৌ ঘটেনি। তা যদি ঘটতোই, আমার এখানে থাকার তবে যৌক্তিকতা কী?
জেকে : প্লিজ, আপনি বুঝতে চেষ্টা করুন। এটা আমার বাড়ি, নো ডাউট এটা আমার বাড়ি। আমি এ বাড়ির প্রতিটি ঘর দরজা জানালা বারান্দা বেলকনি, অল এভরিথিং চিনি, সবকিছু... আট বছর ধরে চিনি।
ভদ্রলোক : আর এই এলাকার প্রতিটি মানুষ আমাকে চেনে, চৌদ্দ বছর ধরে চেনে। ... যা হোক, আমার লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে। উড ইউ লাইক টু জয়েন মি অর ডিপার্ট? ...ফিরোজ, এভাবে আর কখনো গেট খোলা রাখবে না

[ভদ্রলোক জেকে’র উপস্থিতি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ঘুরে চলে যাবেন। জেকে কিছুক্ষণ ঘৃণার চোখে তাকিয়ে থেকে বেরিয়ে যাবেন]


দৃশ্য: ষোল/ দিন
পার্ক বা নির্জন কোন রাস্তা

[জেকে বসে আছেন, তার বসে থাকার ভঙ্গিটা ভীষণ অসহায় ধরণের। হঠাৎ দেখা যাবে জেকের মেয়ে অরিত্রি অন্য এক ভদ্রলোকের হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে। জেকে চিৎকার করে ডাকতে থাকবেন, কিন্তু অরিত্রি গ্রাহ্য করবে না। বোঝা যাবে, এই নামের সাথে সে পরিচিত নয়। জেকে মোটামুটি দৌড়ে মেয়ের কাছাকাছি হবার চেষ্টা করবেন, ততোক্ষণে তারা গাড়িতে উঠে গেছে। গাড়ি চলা শুরু হতেই জেকে গাড়ির কাছে চলে আসবেন, হাত নেড়ে অরিত্রির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করবেন। ড্রাইভিং সিটে বসা ভদ্রলোক সেটা লক্ষ্য করে অরিত্রিকে দেখাবেন। অরিত্রি জানলার কাঁচ নামিয়ে জেকের দিকে তাকিয়ে বলবে- "আপনি কি আমাকে কিছু বলছেন?" জেকে ভীষণ শক্‌ড হবেন, কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে মাথা নেড়ে না বলবেন। তার সামনে দিয়ে গাড়ি চলে যাবে, তিনি হাত নেড়ে বিদায় জানাবেন। তারপর ফিরে যাবেন আগের জায়গায়]


দৃশ্য: সতের / দিন
পার্ক বা নির্জন কোন রাস্তা

[আগের দৃশ্যের কন্টিনিউয়েশন। জেকে মাথা নিচু করে বসে আছেন। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর আবার মাথা তুলে পাশে তাকাতেই দেখবেন তার ঠিক পাশে তারই একজন ডুপ্লিকেট বসে আছে। সে জেকে’র দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসবে। আমরা এই দ্বিতীয় জেকে'র নাম দিতে পারি জেকে২]

জেকে২ : হাই ফ্রেন্ড, কী অবস্থা? একদম ল্যাজেগোবরে তো? হা হা হা
জেকে : তুমি কে?
জেকে২ : আমি কে- সেটা তোমার না জানলেও চলবে। হোয়াট ইজ ইম্পর্টেন্ট নাও, ইজ টু নো দাইসেল্ফ। তুমি বরং নিজেকে প্রশ্ন করো, তুমি কে?
জেকে : ঠিকই বলেছো। আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না, আমি কে! আমার অফিস, আমার বাড়ি, আমার পরিচিত সকল কনসার্ন আমাকে চিনতে অস্বীকার করছে।
জেকে২ : কী সর্বনাশ! এত বড় ব্যবসায়ী, এত কোটি কোটি টাকার মালিক, মহা পরাক্রমশালী জামশেদ খান ওরফে জেকে আজ পথের ফকির?
জেকে : ফকির তবু আমার চেয়ে ভালো অবস্থায় থাকে। তাদের অন্তত আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে পড়তে হয় না!
জেকে২ : বাহ্‌ ভালো বলেছো তো! আ বেগার মে সিং বিফোর আ পিক-পকেট! হা হা হা
জেকে : কে তুমি? হাউ ডেয়ার ইউ পিঞ্চ মি! কী চাও তুমি আমার কাছে?
জেকে২ : হায়রে কপাল! বড়লোকদের এই এক সমস্যা। হাতি যখন গর্তে পড়ে, তখনও সেখান থেকে বাদশাহী চালেই উঠে আসতে চায়। এবং এই জন্যেই পারেনা। ...তোমার কাছে কী চাইবো আমি? কী আছে দেবার মতো তোমার?
জেকে : ইউ আর রাইট! আই’ভ নট আ সিঙ্গেল পেনি বাট আ বিগ অ্যামাউন্ট টু পে!
জেকে২ : এইজন্যেই জ্ঞানী লোকেরা সব সময় বলেন, ইট ইজ বেটার টু বি সামবডি র‌্যাদার দ্যান টু হ্যাভ মেনি থিংস!
জেকে : ইউ আর স্ক্র্যাচিং মি এগেইন! প্লিজ লেট মি থিংক, আমাকে একটু ভাবতে দাও!
জেকে২ : দ্যাটস ফাইন! ভাবো... ভাবো। সঠিকভাবে ভাবলে নিশ্চয়ই একটা সমাধানে আসতে পারবে। ভাবতে থাকো। এই ফাঁকে আমি বরং একটু ঝিমিয়ে নিই...
জেকে : এক্স মিনিস্টার জাহিদ সাহেব আমার বিশেষ বন্ধু। আগামীকাল তাঁর ছেলের বিয়ে। আমি সেখানে ভিভিআইপি গেস্ট।
জেকে২ : ধ্যাত্তেরি! এই তোমার ভাবনার নমুনা? এই বুদ্ধি দিয়ে তুমি এত টাকা বানালে কী করে? এক্স মিনিস্টারের তোমাকে চেনার গরজটা কোথায়? যাও না, যাও, দারোয়ান দিয়ে বের করে দিবেন, বুঝলে? যেমন দিয়েছে তোমার অফিস এবং বাড়ি। ...ট্রাই টু রিয়ালাইজ, ইউ আর নো মোর দ্য এমডি অব ইসলাম গ্রুপ। তোমার এই পরিচয়টা সম্পূর্ণরূপে ভুলতে না পারলে এই গাড্ডা থেকে বেরুতে পারবেনা বলে রাখলাম।
জেকে : কোথাও একটা ষড়যন্ত্র চলছে। গভীর কোন চক্রান্ত।
জেকে২ : রিয়েলি? আচ্ছা মেনে নিলাম এটা একটা ষড়যন্ত্র, তোমার ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব কেড়ে নিয়ে অনেকেই হয়তো লাভবান হবে; কিন্তু তোমার মেয়ে? তোমার আপন সন্তান?
জেকে : সেটাই তো ভাবছি।
জেকে২ : এমন কি হতে পারে না, সে আসলে তোমার মেয়েই নয়!
জেকে : হতে পারে...
জেকে২ : সুতরাং এই জেকে সাহেবের কোটটা গা থেকে খুলে ফ্যালো। নয়তো সারাজীবন এই গাছতলাতে বসেই কেটে যাবে। পেছনে তাকাও পেছনে...!
জেকে : ইউ আর রাইট। পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, আমার কাছেই মনে হচ্ছে জেকে একটা কাল্পনিক চরিত্র! কিন্তু আমার অস্তিত্ব তো মিথ্যে নয়। লোকে তো আমাকে দেখতে পাচ্ছে, কথা বলছে! এমনকি আমার ক্ষিদেও পাচ্ছে! তারমানে আমি জলজ্যান্ত একটা মানুষ- তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
জেকে২ : রাইট। তুমি জলজ্যান্ত একটা মানুষ...
জেকে : অর্থাৎ কোনও এককালে আমার জন্ম হয়েছিলো মানুষ রূপেই...
জেকে২ : জন্ম যদি হয়ে থাকে, তবে সেই জন্ম পরিচয়ও থাকবে নিশ্চয়ই...?
জেকে : ঠিক বলেছো। আমাকে এমন কোথাও যেতে হবে... এমন কেউ নিশ্চয়ই আছে, যার পক্ষে আমাকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়।
জেকে২ : দ্যাটস ফাইন। ইউ’র বিকামিং র‌্যাশনাল। তোমার উৎসের দিকে যাও। আগে তো নিজের আইডেন্টিটি স্টাবলিশ করো, তারপর অন্য কিছু।
জেকে : সেটা করতে গেলে আমার বাবার কাছে যেতে হবে। একমাত্র বাবাই পারবেন আমাকে চিনতে...। হ্যাঁ, ঠিক তাই করতে হবে...
জেকে২ : ব্যস! এই না হলে জেকে? এই তো মাথা খুলছে! গো অ্যাহেড অ্যান্ড শুট! কাম অন হারি হারি...!
জেকে : কিন্তু বাবার সঙ্গে যোগাযোগটা ঠিক স্বাভাবিক নেই। ভাইদের সাথে সম্পত্তিগত বিরোধ, আট-নয় বছর ধরে কোন যোগাযোগই তো রাখা হয়নি... এতদিন পর...
জেকে২ : কুসন্তান যদ্দপি হয়, কুপিতা কখনো নয়!

[জেকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবেন, প্রতিবিম্ব মিলিয়ে যাবে। জেকে কিছুটা অবাক হবেন, তবে দ্রুত সামলে নিয়ে দৃঢ়প্রত্যয়ী ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াবেন]

দৃশ্য: আঠারো / দিন
বাসের ভিতর

[জেকে বসে আছেন বাসের ভিতর, জানলা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে, সবুজ গাছ-গাছালি ঘেরা গ্রামীণ দৃশ্য। স্ক্রিনে জেকের ছবি ঝাপসা হয়ে আসবে, তার ওপর দিয়ে ফার্স্ট-কাট শটে কিছু ফ্লাশব্যাক দেখা যাবে। একদল গ্রামীণ ছেলেমেয়ে দল বেঁধে নানান রকম খেলাধুলায় ব্যস্ত, গ্রামের কিছু সাধারণ দৃশ্য এসবের ওপর দিয়ে জেকের বাস্তব ছবিটা আবার স্বাভাবিক হয়ে আসবে]

দৃশ্য: ঊনিশ / দিন
গ্রামের বাড়ি

[দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ, জেকে দরজার কড়া নাড়ছেন। বেশ কয়েকবার কড়া নাড়ার পর দরজা খুলে একজন শীর্ণকায় বৃদ্ধ বেরিয়ে আসবেন]

জেকে : স্লামালিকুম।
বৃদ্ধ : ওয়ালাইকুম সালাম। আপনি কারে চান?
জেকে : [অবাক] বাবা, আপনি কী বলছেন? আপনি কি আমাকে চিনতে পারেন নি? আমার নাম জামশেদ।
বৃদ্ধ : আপনি কার কাছে এসছেন?
জেকে : বাবা, আমি জামশেদ, আপনার বড় ছেলে। আপনি আমাকে...
বৃদ্ধ : [নিরব, ভাষাহীণ চোখে তাকিয়ে থাকবেন]
জেকে : আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না বাবা? আমি জামশেদ খান, আপনার বড় ছেলে জামশেদ খান।
বৃদ্ধ : কী বলতেছেন! জামশেদ তো মইরা গেছে, নয় বচ্ছর বয়সে।
জেকে : [হতভম্ব] কী! কী বলছেন আপনি?
বৃদ্ধ : সাপের কামড়ে মরছে। সে তো ধরেন তিরিশ-চল্লিশ বচ্ছর আগেকার কথা

[জেকে কিছুক্ষণ ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে থাকবেন, তার সামনে দাঁড়ানো বৃদ্ধের চেহারা অস্পষ্ট হয়ে যাবে, পৃথিবী কেঁপে উঠবে। তিনি টলতে টলতে পড়ে যাবেন এবং জ্ঞান হারাবেন]

দৃশ্য: বিশ / দিন
ট্যুরিস্ট পার্ক

[দৃশ্য পাঁচ-এর শেষ থেকে শুরু হবে। জেকে পার্কের বেঞ্চিতে বেকায়দা ভঙ্গিতে শুয়ে আছেন। মেয়ে এবং স্ত্রী তাকে ধাক্কা দিয়ে ওঠানোর চেষ্টা করছেন, পাশে দাঁড়িয়ে আছে লিয়ানা। তিনি ঘোর লাগা চোখে সবার দিকে তাকাবেন, অজান্তেই তার হাত চলে যাবে পায়ের কাছে। প্যান্ট গুটিয়ে মোজা সরিয়ে তিনি একটা কালো দাগ বের করবেন]

আসমা : কী ব্যাপার তুমি এরকম মড়ার মতো ঘুমাচ্ছো যে? বেড়াতে এসে যদি ঘুমিয়েই কাটাবে, তো আসার দরকার কী ছিলো?
জেকে : আমার পায়ের এই দাগটা তুমি খেয়াল করেছো কখনো, আসমা? ন’ বছর বয়সে একবার গোখরো সাপ কামড়েছিলো আমাকে। তিন দিন অচেতন থাকার পর কোন রকমে বেঁচে যাই। যদি না বাঁচতাম?
আসমা : কী সব অলক্ষুণে কথা বলো!
অরিত্রি : বাবা মনে হয় বুড়ো হয়ে যাচ্ছে, তাই না মা?
আসমা : তুই থাম। ওঠো তো, ওঠো। চলো খাবে।
জেকে : আসমা তোমার মনে আছে, তোমার বাবা আমাকে সেই প্রথম পরিচয়েই বলেছিলেন- ইট ইজ বেটার টু বি সামবডি, র‌্যাদার দ্যান টু হ্যাভ মেনি থিংস! কথাটা আজ আমি নতুন করে উপলব্ধি করলাম।
আসমা : ব্যাপারটা কী, বুঝিয়ে বলবে তো? এরকম হেঁয়ালী করছো কেন?
জেকে : কী অদ্ভুত একটা ব্যাপার আসমা, আমি তোমাকে ঠিক বোঝাতে পারবো না। ... এই যে লিয়ানা, ধরো এই মুহূর্ত হতে আমি জেকে তোমার এমডি না, আমি হয়তো তোমার চেনা-জানা রক্ত-মাংসের কোন চরিত্রই না। আই’ম নেভার বি সিন, নেভার বি নোন অ্যান্ড নেভার বি লিভড্‌ ইন! কেমন হবে ব্যাপারটা?
লিয়ানা : আই’ম স্যরি স্যার, ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। আপনি যদি আর একটু হিন্টস দিতেন...
অরিত্রি : ফর গডস্‌ সেক, তোমরা এখানে নতুন করে অফিস খুলে বসো না। বাবা ইউ আর চিটিং! তুমি আমাদের পুরো ডে-আউটটাই বোর করে দিচ্ছো...
জেকে : না না, তুই বুঝতে পারছিস না ব্যাপারটা, ইটস্‌ আ ভেরি ইন্টারেস্টিং এক্সপেরিয়েন্স... মানে আমি আছি, আমি নিজে নিজেকে ফিল করতে পারছি, বাট আমার চেনা পৃথিবীর কোন মানুষ আমাকে চিনতে পারছেনা। মানে বুঝলে আসমা, ব্যাপারটা অনেকটা... ধরো আমার কোন ফ্যামেলি ফটোগ্রাফ, তুমি আছো, আমি আছি, অরিত্রি আছে, তোমার বা আমার বাবা মা আছেন, আরো ধরো অনেকে... এর মধ্য থেকে কোন ভাবে আমার ছবিটা মুছে ফেলা হলো, তোমাদের সবাইকে বোঝানো হলো, এই মানুষটা কেউ না, একে তোমরা কেউ চিনো না। কেমন হবে?
অরিত্রি : কেমন আবার হবে?
জেকে : কেমন হবে মানে? ধর আমি তো তোদের সবাইকে চিনি, কিন্তু তোরা কেউ আমাকে চিনিস না। ওই যে গানটার মতো, নেভার বি সিন, নেভার বি নোন অ্যান্ড নেভার বি লিভড্‌ ইন!
আসমা : জাস্ট স্টপ ইট। খাবার রেডি, চলো খাবে।
জেকে : না না আসমা তুমি বুঝতে পারছো না... লেট মি এক্সপ্লেইন...
আসমা : নো, আর কোন কথা নয়, এক্ষুনি খেতে চলো সবাই। ইটস অ্যান অর্ডার।

[সবাই একসাথে উঠে পড়বে, জেকে হতাশ হয়ে তাদের অনুসরণ করবেন]


দৃশ্য: একুশ / দিন
গাড়ির ভেতর

[পার্কের গেটের কাছে ছোটখাটো একটা জ্যাম, যে জন্যে গাড়ি বের হতে পারছে না। হঠাৎ জেকে লক্ষ্য করবেন, সেই ছোট্ট মেয়েটি গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে, তার হাতে ধরা আছে সেই বলটা। আগের মতোই জেকে’র দিকে তাকিয়ে হাসছে মেয়েটা। জেকে প্রথমে চমকে গেলেও পরে সামলে নেবেন। ততোক্ষণে গাড়ি চলতে শুরু করেছে। জেকে জানলার বাইরে হাত নেড়ে বাচ্চাটাকে বিদায় জানাবেন, মুখে বলবেন- থ্যাঙ্ক ইউ! আসমা এবং অন্যরা অবাক হয়ে তাকাবেন জেকে’র দিকে, কারণ তারা বাইরে কাউকে দেখতে পাবেন না। জেকে তাদের বিষ্মিত দৃষ্টি উপেক্ষা করে ড্রাইভারকে গান বাজাতে বলবেন। ড্রাইভার গান বাজালে গাড়িটা বেরিয়ে যাবে]



দৃশ্য: বাইশ / দিন
পার্ক

[সেই ছোট্ট মেয়েটি অর্থাৎ উর্মীর পিভি থেকে গাড়িটার চলে যাওয়া দেখা যাবে, উর্মী সেদিকে তাকিয়ে থাকবে। তারপর সে মুখ ফিরিয়ে তাকালে দেখা যাবে, তার মুখে মৃদু হাসি লেগে আছে। তার হাসিটা পরিণত মানুষের মতো, যেন সে সবজান্তা- এরকম একটা ভাব। কাট শটে এক ভদ্রলোককে পেছন থেকে দেখা যাবে, তিনি মোবাইলে কথা বলছেন। হঠাৎ পায়ের কাছে কাপড় ধরে একটা ছোট বাচ্চা টান দিতেই তিনি ফিরে তাকাবেন, তাঁর পিভি থেকে উর্মীকে দেখা যাবে। তিনি মৃদু হেসে তার সাথে কথা বলবেন]

লোক : কী নাম তোমার?
উর্মী : উর্মী
লোক : বাহ্‌, সুন্দর নাম তো!
উর্মী : কী নাম তোমার?
লোক : আমার নাম? আমার নাম...

সমাপ্ত

শনিবার, ৭ নভেম্বর, ২০০৯

যখন বেলা শেষের ছায়ায়...

লোকটা অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছে। ব্যাপারটা আমাদের মধ্যে সবচে’ আগে ধরতে পারলো রবিন। রবিন বরাবরই একটু বেশি চালু। সে কারণেই আমাদের রেখে আমেরিকা চলে যেতে পারছে। যেতে পারছে কথাটার আগে ‘চলে’ শব্দটা বসালাম এ জন্যে যে, রবিন সেখানে বেড়াতে যাচ্ছে না, ডিভি জিতে পাকাপাকিভাবে থাকতে যাচ্ছে। আর আমরা, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সবাই ভীঁড় করে এয়ারপোর্টে এসেছি তাকে বিদায় জানাতে। বৃটিশ এয়ারওয়েজের যে বিমানে তার চেপে বসার কথা, সেটার কলকব্জায় সম্ভবত কোন গোলমাল ঘটেছে। উড়তে দেরি হবে। রবিনের বাবা-মা তাতে মহা খুশি। আরও কিছু সময় ছেলেকে বেশি পাওয়া যাচ্ছে কাছে। আত্মীয়-স্বজনরাও খুশি। রবিন কতটা খুশি তা অবশ্য তার চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে না, সে বরাবর তার মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত, অভিব্যক্তি প্রকাশের তার সময় কই! মাঝখান থেকে আমি পড়ে গেলাম মাইনকা চিপায়। সাড়ে চারটার ফ্লাইট যদি চার ঘন্টা লেট করে, তাহলে হলো গিয়ে সাড়ে আট। তারপর এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে হতে যাবে আরো অন্তত আধাঘন্টা। মানে দাঁড়ালো নয়টা। এখান থেকে গাবতলী যেতে কতক্ষণ লাগবে, তা একমাত্র বিধাতা জানেন। সাড়ে দশটার মধ্যে পৌঁছুতে যদি না পারি? বাস মিস করে রাতে থেকে যাওয়া তো দূরে থাকুক, আরেকবার টিকিট করাও কি সম্ভব? কেন যে শালার আগাম টিকিট করতে গেলাম! বুকিং দিয়ে রাখলেই তো হতো।
কিছু করার নেই তাই কথা বলা। কথা বলে সময় কাটানো। শাহেদ বললো, ‘দোস্ত, তোমার কপাল ভালো, শুরুতেই ক্যালিফোর্নিয়া’র মতো শহরে থাকতে পারতেছো। ডিভি জিতে যারা আমেরিকা যায়, তাদেরকে বলে ফাস্টে টেক্সাস, ক্যানসাস এইসব বিরান জাগায় পাঠায়ে দেয়’।
আমার ভুরু কুঁচকে গেল। সবখানে এরকম পণ্ডিত পণ্ডিত ভাব নেবার তো দরকার নাই। শাহেদের পণ্ডিতির একটা সমুচিত জবাব দেয়া খুবই জরুরি বিবেচনায় আমি প্রশ্ন করলাম, ‘টেক্সাস, ক্যানসাস এইগুলা
বিরান জাগা তোরে কে কইলো?’
‘কেউ কয় নাই, এমনিই কইলাম।’
‘এমনি এমনিই একটা কথা কয়ে ফেললি?’
‘কইলে তোর অসুবিধা কি? তাছাড়া আমি ইংলিশ ছবিতে দেখ্ছি। তুই দেখিস নাই? ওয়েস্টার্ন গল্পে পড়িস নাই?’
‘ছবিতে দেখলে, গল্পে পড়লেই সবকিছু জেনে ফেললি? ছবিতে সিনেমায় সবকিছু সত্যি থাকে নাকি?’
শাহেদ তেড়ে ফুঁড়ে উঠে কিছু একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিলো। শাহেদ আর আমার মধ্যে কেবল একটা বিষয়েই মিল, তা হলো- আমরা দু’জনেই তর্কে ভীষণ পারঙ্গম। এবং আমরা সেটা যদ্দূর সম্ভব এনজয় করি। সুতরাং অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবার আগেই কাজল প্রসঙ্গ পাল্টালো, ‘তোর ভাগ্যটা আসলেই ভালো। শুরু থেকেই তোর নামটা ইংরেজী ধরণের। নয়ত বিদেশীরা তো আবার বাংলা নামগুলা উচ্চারণই করতে পারে না। কেন পড়িস নাই, হুমায়ূন আহমেদ'কে উচ্চারণ করে হিউমাউন আহামাড। আমরা সবাই হেসে উঠলাম, শাহেদ ছাড়া। হুমায়ূন আহমেদ কি বাংলা শব্দ? - শাহেদের প্রশ্ন করবার ধরণটাই বলে দিচ্ছে, একটু আগে আমার সাথে তর্কটা জমাতে না পারার একটা আক্ষেপ এর মধ্যে লুকানো আছে। সুতরাং সবাই আবারও হেসে উঠলো।
রবিনের আব্বা সোবহান চাচা, ছেলেকে একধার থেকে বুঝিয়ে যাচ্ছেন, আমেরিকায় থেকেও কী উপায়ে সে তার বাঙালীত্বকে, বিশেষত মুসলিমত্বকে অক্ষুন্ন রাখতে পারবে। সর্বোপরি এটা কখনই ভুললে চলবে না যে, ছোট তিন ভাই বোনকে নিয়ে বুড়ো বাবা-মা দেশে একেবারে বেসাহারা হয়ে থাকবেন, কোনমতেই ডলার পাঠাতে যেন দেরি না হয়। আকবর চাচা রবিনদের নিকটতম প্রতিবেশী, ফেয়ারওয়েল টিমের তিনি সবচে’ উজ্জ্বল নক্ষত্র। এমন একটা বিষয়ও নাই, যাতে তার জ্ঞানে কিঞ্চিত ঘাটতি আবিস্কার করা যেতে পারে। রবিনের বিমান প্রথম গিয়ে নামবে নিউইয়র্কে, তারপর সেখান থেকে তাকে যেতে হবে ক্যালিফোর্নিয়ায়। নিউইয়র্ক থেকে ক্যালিফোর্নিয়ার প্লেনটা কীভাবে ঠিকঠাক মতো খুঁজে বের করতে হবে, কোনো কারণে সেটা মিস্ হয়ে গেলে কী ব্যবস্থা নেয়া যাবে, সে দেশের পুলিশ কতখানি সহযোগিতা-পরায়ণ, বিমানে ছাড়াও কীভাবে বাসে চড়ে যাওয়া যাবে, বাসের সিট আমাদের দেশের বাসের তুলনায় কতটা পুরু, কত আরামদায়ক, রাস্তা কতটা সমান... এইসব এমন মুন্সীয়ানায় ব্যাখ্যা করে যাচ্ছেন, শুনে মনে হওয়া স্বাভাবিক, নিকট অতীতে তিনি এই দুই শহরের মাঝে তাঁতের মাক্কুর মতো আপ-ডাউন করেছেন। অথচ বিমানে চড়া তো দূরে থাকুক, সবাই জানে, দিনাজপুর থেকে ঢাকা ছাড়িয়ে চট্টগ্রাম-সিলেট যাওয়ার অভিজ্ঞতাও তার নেই।
যেহেতু আমি দিনাজপুর ফিরবার বাসটা মিস্ হয়ে যাবে কিনা- এই আশংকায় অতিশয় উদ্বিগ্ন, সুতরাং শাহেদও এতক্ষণ বিমর্ষ বোধ করছিলো। তার তর্ক করার সঙ্গী নেই! ফলে সে যে এবার আকবর চাচাকে তার কাউন্টার-পার্ট হিসেবে নিতে চাইবে, তাতে আর দোষের কী? এত উদ্বেগের মধ্যেও তাদের অযথা তর্ক দেখে আমার বরং হাসিই পাচ্ছিলো। ঠিক এই সময় রবিন লক্ষ্য করলো, একটা মানুষ আমাদের লক্ষ্য করছে, এবং সেটা অনেকক্ষণ ধরে। সে নাকি দীর্ঘ সময় ধরে একই জায়গায় বসে আছে এবং ঘুরে ফিরে আমাদেরকেই লক্ষ্য করে যাচ্ছে। ব্যাপারটা কী? আমরা আমাদের অনুমান ক্ষমতাকে নিমেষেই চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেলাম। ছিনতাইকারী নয়তো? 'এয়ারপোর্টে ফিল্মী কায়দায় ছিনতাই, দুবাই ফেরত অথবা সৌদিগামী যাত্রীর সর্বস্ব লুট...' এ জাতীয় খবর আজকাল প্রায়ই কাগজে আসে। এই লোক সেই ধরণের কেউ নয়তো? খুব কায়দা করে আমিও দেখলাম লোকটাকে। আকাশী রঙের স্ট্রাইপ শার্ট, কালো প্যান্ট। শার্টের হাতা কব্জির একটু ওপর পর্যন্ত গুটিয়ে রাখা। ডান কব্জিতে কালো ঘড়ি, ফর্সা হাতে সুন্দর লাগছে। চোখে চশমা থাকলে আরো ভালো লাগতো মনে হয়, কিন্তু নেই। ঠোটের নিচে ছোট্ট দাড়ি আছে, বেশ আধুনিক কেতার। দেখে আর যা’ই হোক, ছিনতাইকারী বলে মনে হয় না। অবশ্য এমনও হতে পারে এয়ারপোর্টের মতো ভদ্র এলাকার ছিনতাইকারীরা দেখতে এরকম ভদ্রলোকই হয়। ...আমরা এইরকম আরো কিছুক্ষণ আলোচনা করে, আরো নতুন কিছু আবিস্কারের চেষ্টা করে একসময় হাল ছেড়ে দিলাম। আবারও যে যার মতো গল্পে মশগুল হয়ে গেলাম। শাহেদ আর আমি নতুন করে তর্ক করবার উপলক্ষ খুঁজতে লাগলাম, রবিনের ছোট ভাই-বোনগুলো একটার পর একটা আবদার মনে করিয়ে দিতে থাকলো, রবিনের আম্মা, যিনি কিনা সুযোগ পেলেই কান্নাকাটি করে মন হালকা করছেন, তিনি আবারও মন হালকা করবার সুযোগ খুঁজতে লাগলেন, সোবহান চাচা উপদেশের আড়ালে তাঁর দাবী-দাওয়াসমুহ মুহুর্মুহু স্মরণ করিয়ে দিতে থাকলেন আর আকবর চাচা তাঁর বিশেষজ্ঞ মতামত পূর্ণোদ্যমে পেশ করতে থাকলেন। একটা মানুষ যে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে এবং আমাদেরকে লক্ষ্য করছে, এটা আমরা কেউই মনে
রাখবার প্রয়োজন বোধ করলাম না।
আকবর চাচার কান্ডজ্ঞান বরাবরই ঘাটতির দিকে। বাবা-মা’র সামনেই তিনি রবিনকে উপদেশ দিচ্ছেন,
‘একটা কাথা সবসময় খেয়াল করি থাকিবু বাবা। আমরিকাত দুইটা জিনিস হইলো ফিরি। এক নম্বর- মোদ, আর দুই নম্বর হইলো বেটি ছোয়া। দোনোটাই কিন্তুক ডেনজোরাস্। ধইছেন কি মইছেন! ধলা চামড়ার মাগি দেখি পাগেলা হই যান না বারে। ঐ দ্যাশের তামাল্লার এইডোস ধইছে, এইটা খেয়াল রাখিবা হোবে। এইবার যা হোউক, টপ্পাস করি ডাক পইছে, চলি যাছেন, যান। কিন্তুক ছয় মাসের মইধে দ্যাশত ফিরি বেহা করি বউ নি যাইয়ো। তখন আর চিন্তা ভাবনা থাকিবে নাহায়। আর যেহেতু শীতের দ্যাশ, শরীল গরম রাখিবা তনে মোদ খাবা হোবে, কম কম করি খাবেন। ঐল্লা দ্যাশত অল্প করি মোদ খাওয়াটাও ফ্যাশন। কিন্তুক নেশা করিবা তনে মোদ ধইছেন তো মইছেন!’
এইসব কথা শুনে খালাম্মা নতুন করে মন হালকা করবার সুযোগ পেয়ে গেলেন, আর আমার পেয়ে গেল বাথরুম। আমি কাউকে কিছু না বলে একপাশে সরে আসলাম এবং একসময় নারী ও পুরুষের ছবি আঁকা পৃথক বাথরুমগুলো খুঁজে বের করে ফেললাম। বাথরুমের দরোজায় লেখা- রেস্টরুম। কী আশ্চর্য, রেস্ট নিবে লোকে বেডরুমে নয়ত ড্রয়িংরুমে, বাথরুম কী করে রেস্ট নেবার স্থান হয়?... এ জাতীয় হাস্যকর বিষয় নিয়ে উল্টোপাল্টা ভাবছি, হঠাত ঠিক পাশ থেকে ‘কেমন আছেন’ শুনে একদম চমকে গেলাম। তাকিয়ে দেখি, সেই ভদ্রলোক। ভদ্রলোকের ভদ্রতা এরকম হয়? আরেকটু হলেই তো...। আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, লোকটা তার আগেই হড়বড় করে একগাদা কথা বলে ফেললো,
‘ফ্লাইট যতটা লেট হবার কথা ছিলো, ততটা হবে না। আর বড় জোর ঘন্টা খানেক। অবশ্য কনফার্ম হতে আরো মিনিট দশেক লাগবে, তারপরই অফিসিয়াল ঘোষনা আসবে।’
আমি ভীষণ অবাক হলাম,
‘আপনি জানলেন কী করে? তাছাড়া, আমরা যে ঐ ফ্লাইটেরই অপেক্ষাতে আছি, সেটাই বা কে বললো?’
‘প্রথমটা জানলাম অফিসিয়াল সূত্রে। আমার বন্ধু ইমিগ্রেশনে আছে। তাছাড়া আমি তো প্রায়ই এয়ারপোর্টে এসে বসে থাকি। অনেকের সাথেই বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। সুতরাং এটুকু খবর বের করা কোন ব্যাপারই না। আর দ্বিতীয়টা বলেছেন আপনিই।’
‘আমি?’ আমি আকাশ থেকে পড়লাম।
‘নিশ্চয়ই। তবে আমাকে নয়, আপনার বন্ধু শাহেদকে।’
‘আমার বন্ধুর নাম...’
‘সেটাও আপনার কথা থেকেই জেনেছি। বাস মিস্ করবার টেনশনে আপনি এতটাই উদ্বিগ্ন ছিলেন, আমাকে খেয়ালই করেন নি। আমি আপনাদের ঠিক পেছনেই বসে ছিলাম। আপনার নামটা অবশ্য জানি না, কারণ আপনার বন্ধু সেটা উচ্চারণ করেন নি।’
‘কামাল।’ আমি অন্যমনস্ক হয়ে নামটা বলে ফেললাম।
‘সাজ্জাদ’
‘জ্বি?’
‘আমার নাম।’ সাজ্জাদ হাসলো। সহজ সরল নির্মল হাসি। ‘বাই দ্য ওয়ে, আপনার বাস মিস করার টেনশন তো কমিয়ে দিলাম, বলুন কী খাওয়াবেন?’
এমনভাবে বলছে যেন সে নিজেই প্লেনটা সারিয়ে এসেছে। আমি কিছু একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিলাম, সাজ্জাদ এবার জোরে হেসে উঠলো,
‘ডোন্ট টেক ইট সিরিয়াসলি, জাস্ট কিডিং, হা হা হা...। চলুন, কোথাও গিয়ে বসি।’
আমি ব্যাপক সিদ্ধান্তহীনতায় পড়লাম। একটু আগে এই লোকটার ছিনতাইকারী হবার পেছনে আমরা যথেষ্ট যুক্তি দেখতে পেয়েছি। লোকটা নিজেও বললো, প্রায়ই নাকি এয়ারপোর্টে আসে, এসে বসে থাকে। কেন? মক্কেলের খোঁজে?... কিন্তু এর সাথে না গিয়েই বা করবো কী? সেই তো ঘুরে ফিরে একই কেত্তন, আকবর চাচার হামবড়া লেকচার, খালাম্মার ইনিয়ে বিনিয়ে কান্না, সোবহান চাচার নির্লজ্জ দাবী-দাওয়া, আমার আর শাহেদের অনর্থক তর্ক... সব মিলিয়ে উদ্ভট একটা অবস্থা। ইতিমধ্যেই রবিনের অন্য সব আত্মীয়রাও আসতে শুরু করেছে এবং কোন এক বিচিত্র কারণে তাদের প্রায় কেউই আমাদের তিন বন্ধুর বিদায় দিতে আসাটাকে সহজভাবে নিতে পারছে না। সুতরাং দলের কাছ থেকে দূরে থাকাটাই বরং ভালো।
তাছাড়া এ যদি ছিনতাইকারী হয়ও, তো আমার ভয়ের কী? আমার কাছে আছেই কী যে ছিনতাই করবে? ফেরত যাবার ভাড়াটাই জুটাতে পারছি না! তাও তো কপাল যে ফ্লাইট যতটা আশঙ্কা করেছিলাম, ততটা লেট করবে না। নইলে যে কী হত! আশ্চর্য ব্যাপার, রবিনের ফ্লাইট যতই কাছিয়ে আসছে, ততই আমার মনে হতে থাকছে, বিদায়টা কি দিনাজপুরে থেকেই দেয়া যেত না? আবেগের বসে এতটা না করলেও পারতাম!
সাজ্জাদ লোকটা কি মনের কথা বুঝতে পারে? আমি যা ভাবছিলাম, সে ঠিক সেই প্রশ্নটাই করে বসলো কী করে? আমি স্মার্ট হবার চেষ্টা করলাম,
‘দেখুন, রবিন আমার সবচে’ প্রিয় বন্ধু। সে আমেরিকায় বেড়াতে যাচ্ছে না, চিরতরে চলে যাচ্ছে। আর কবে দেখা হবে, কে জানে। সে চলে যাচ্ছে, আমি তাকে বিদায় দেব না?’
‘কেন নয়, নিশ্চয়ই দেবেন। আমার প্রশ্ন আসলে এটা নয়। আমি জানতে চাচ্ছিলাম, বিদায়টা কি দিনাজপুরে থেকেই দেয়া যেত না? দিনাজপুর রেল স্টেশনে কি বাস টার্মিনালে, কিংবা ধরুন আপনার নয়ত রবিন সাহেবের বাসাতেই?’
‘আমার বন্ধু আমেরিকা চলে যাচ্ছে, আর আমি তাকে বিদায় জানাতে ঢাকা পর্যন্ত আসবো না?’
‘আসবেন বৈকি, এসেই তো গেছেন। কিন্তু সেটা কতটা যৌক্তিক, তা কি ভেবে দেখেছেন? ...তুমি চলে যাচ্ছো, আর দেখা হবে না -এটা কি ঘরে বসেই মেনে নেয়া যেত না? তবু আমরা আমাদের সীমিত সঞ্চয় ব্যয় করে পেছন পেছন ছুটে যাই, যদ্দূর যেতে পারি আরকি। তারপর একসময় ডান হাতের কব্জিটা ডানে বামে হেলিয়ে দুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফিরে যাই। ...বিদায়ীর সঙ্গী হবার এই যে অভিনয়, কতটা দরকার এর?’
‘আপনি এটাকে অভিনয় বলছেন কেন? আবেগের কি কোনই মূল্য নেই!’
‘নিশ্চয়ই আছে। প্রশ্নটা আবেগ নিয়ে নয়, আবেগ প্রকাশের ধরণ নিয়ে। আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি, আপনি আপনার বন্ধুর সাথে ঢাকা পর্যন্ত এলেন, বাকিটুকু যাচ্ছেন না কেন?’
‘কী অদ্ভুত কথা। রবিনের কাছে আমেরিকা যাবার টিকিট আছে, ভিসা আছে। আমার তো পাসপোর্টই নাই, আমি কী করে যাবো?’
‘অর্থাত বাকিটা যাবার সামর্থ থাকলে যেতেন?’
‘তা কেন? রবিন যাচ্ছে তার নিজের কাজে, সে সেখানে থাকতে যাচ্ছে। আমি তার সাথে গিয়ে কী করবো?’
‘স্ট্রেঞ্জ! আচ্ছা ধরুন রবিনের ফ্লাইট আজ রাত দশটার আগে ছাড়বে না। আপনি কী করবেন? টিকেট ক্যানসেল করে থেকে যাবেন?’
আমি এবার সত্যিকার বেকায়দায় পড়লাম।
‘দেখুন, আপনি তো জেনেই গেছেন, আমার পক্ষে থেকে যাওয়াটা সম্ভব নয়, আমি সে রকম প্রিপারেশন নিয়ে আসিনি। ...কিন্তু সবার ক্ষেত্রে তো তা নয়। যেমন ধরেন কাজল, সে তো থেকে যেতে পারে। ইন ফ্যাক্ট সে থাকবেও। দুই দিন পরে যাবে।’
‘কিন্তু রবিন তো আজই চলে যাচ্ছে, তাহলে কাজল কেন আরো দু’দিন পরে যাবে? ...অর্থাত, সে এসেছিলো নিজের কাজে, এই সুযোগে বন্ধুকে সি-অফ করলো, তাই তো? দ্যাটস্ ইন্টেলিজেন্ট!’
‘তার মানে বলতে চাচ্ছেন আমার আসাটা বোকামী হয়েছে?’
‘আমি কিছু বলতে না চাইলেও, সত্যি কিন্তু এটাই!’
আমি নিদারুণ অপ্রস্তুত হলাম। এবং যেহেতু আমার ব্যক্তিত্বের মধ্যে বোকা বোকা ধরণটা বেশ প্রবলভাবেই বর্তমান, সুতরাং অপ্রস্তুত ভাবটা গোপন করতে পারলাম না। সাজ্জাদ সেটা বুঝতে পারলো। তাই কথা ঘোরানোর জন্য বললো,
‘আপনাকে শুরুর দিকে বলেছিলাম, আমি প্রায়ই এয়ারপোর্টে আসি। কেন আসি, তা কি জানেন?’
আমার মুখে প্রায় এসে গেছিলো, ‘মক্কেলের খোঁজে!’ শেষ মুহূর্তে সামলে নিলাম। সাজ্জাদ নিজে থেকেই বললো,
‘মানুষ দেখতে। প্রতিদিন নানান মানুষ নানান দেশ থেকে আসছে, যাচ্ছে। তাদের বিদায় দিতে, কিংবা ঘরে ফিরিয়ে নিতে আসছে কত মানুষ। কেউ আসছে প্রাণের টানে, কেউ কর্তব্যবোধ থেকে, কেউ অযথাই... কেন? কেন এত ব্যাকুলতা! কী তাদের সম্পর্ক? কিসের এত ব্যাগ্রতা? ...আমি বসে বসে দেখি আর অনুভব-আবিস্কারের চেষ্টা করি, যাত্রী আর তার সঙ্গীদের মধ্যে সম্পর্কটা কী? সেটা কতটা গভীর? ...নাকি শুধুই ফর্মালিটি!’
আমি কিছুতেই এই অদ্ভুত মানুষটাকে মেলাতে পারছি না। মানুষের বিদায় দৃশ্য থেকে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক আবিস্কার করে এর লাভটা কী? সাজ্জাদ বরাবরের মতোই বুঝে ফেললো, আমি কী ভাবছি।
‘আপনি হয়তো ভাবছেন এই অদ্ভুত ধরনের স্টাডি আমি কেন করি? ...কে জানে কেন। খেয়াল বলতে পারেন, মানুষের নানান রকম খেয়াল থাকে না?... বাদ দিন এসব। আপনাকে একটা গল্প শোনাই। অবশ্য ইফ ইউ ডোন্ট ফিল বোরড্।’
‘না না, তা কেন? বেশ তো সময় কাটছে। আপনি বলুন।’
‘আমার স্কুল জীবনটা কেটেছে গাইবান্ধা জেলার একটা গ্রামাঞ্চলে, মহিমাগঞ্জ নামের একটা জায়গায়। সেখানে একটা চিনিকল আছে, আমার বাবা সেই চিনিকলে চাকরি করতেন। আমাদের একটা কুকুর ছিলো। গল্পটা সেই কুকুরকে নিয়েই...’
‘কুকুর একটা ছেলেবেলায় আমিও পুষতাম। তা আপনার কুকুরের নাম কী ছিলো? কোন জাতের?’
‘দেশি কুকুর। বাবা এক সাথে দুটো বাচ্চা কুড়িয়ে এনেছিলেন। লালটার নাম লালু, আর কালোটা কালু হতে গিয়ে হয়ে গেল ভুলু। সে সময় লালুভুলু নামে একটা ছবি খুব হিট করেছিলো। যাই হোক, লালুটা একদিন কাউকে কিছু না বলে উধাও হয়ে গেল। কিন্তু ভুলু যেমন ছিলো প্রভুভক্ত, তেমনি বিশ্বস্ত। আমাদের জিএম সাহেব একবার তাকে নিয়ে গেলেন পুষবার জন্য। সেই রাতেই সে বাড়িতে এসে হাজির। গলায় একটা ছেঁড়া দড়ি। ব্যাপার কী? ব্যাপার গুরুতর। সিকিউরিটি গার্ডদের দুজনকে, জিএম সাহেবের ছেলেকে এমনকি স্বয়ং তাকেও ভুলু আঁচড়ে কামড়ে একাকার করেছে। দড়িটা তার গলায় বাঁধা গেলেও অন্য প্রান্ত সে কিছুতেই খোঁটায় বাঁধতে দেয়নি।
সাজ্জাদ দম নেবার জন্য থামতেই আমি দ্রুত চোখ বুলিয়ে দেখে নিলাম, রবিন তার লাগেজ টানা হেঁচড়া করছে। ইতিমধ্যে দেশের আনাচে কানাচে তাদের যত আত্মীয়-স্বজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো, সবাই মনে হয় এসে গেছে। আমি একটা মানুষ দূরে আছি, বা আমাকে দেখা যাচ্ছে না -এটা নিয়ে কেউই মনে হয় ভাবিত নয়। আমার অন্যমনস্কতা সাজ্জাদের চোখ এড়ালো না। সে আবার শুরু করলো,
‘ভুলুর বীরত্বের কাহিনী থাক, আসল গল্পে আসি। আমরা যখন অন্য চিনিকলে ট্রান্সফার হয়ে গেলাম, তখন ভুলুকেও সাথে নিতে চেয়েছিলাম। বাবা দিলেন না। নতুন জায়গায় হয়তো সে অ্যাডজাস্ট করতে পারবে না। আসলে, 'ফুটানী দেখ, কুকুর বয়ে নিয়ে এসেছে'- প্রতিবেশীদের এই জাতীয় তীর্যক মন্তব্যকেই বাবার ভয় ছিলো বেশি। সুতরাং আমরা ভুলুকে পাশের বাড়ির খোকনদের হতে তুলে দিয়ে রওনা হলাম। বন্ধুরা দল বেঁধে বিদায় দিতে এসেছিলো, আমাদের বিদায় দিতে গিয়ে তারাও খুব কাঁদছিলো, যদিও সবাই জানতো, আমাদের কান্নাটা তাদের চেয়ে বরং ভুলুর জন্যই বেশি ছিলো।
‘ট্রেন ছেড়ে দেবার পর আমরা ভুলুকে দেখতে পেলাম। ভুলু ছুটছে ট্রেনের পাশে পাশে। ভুলু তার সমস্ত বিশ্বস্ততা, প্রভুভক্তি, অন্ধ আবেগ আর এই নিদারুণ অকৃতজ্ঞ, অতি সাধারণ, তুচ্ছ মানুষ ক’টার জন্য তার অসাধারণ, অসম্ভব ভালোবাসা নিয়ে ছুটছে। আমরা চিত্কার করে ভুলুকে ফেরাতে চাইলাম, ভুলু ফিরে যা। ভুলু তুই ভুল করিস না, ফিরে যা। ট্রেনের প্রবল শব্দে আমাদের চিত্কার চাপা পড়ে গেল, ভুলু কিছুই শুনতে পেল না। শুনতে পেলেও মানতে পারলো না। সে ছুটতেই থাকলো।...
‘ভুলু জানতো না, যন্ত্র বড় জোরে ছোটে। আর যে মানুষরা তার ভেতরে গিয়ে চড়ে বসে, তারাও যন্ত্র হয়ে যায়, সীমাহীন যান্ত্রিকতাকে ভালোবেসে যন্ত্রজীবনই বরণ করে নেয়! ...এই ভাবনাও তার মনে জাগেনি, দৌড়ের শেষ প্রান্তে গিয়ে সে তার প্রভুর দেখা পাবে কিনা। একবারের জন্যেও সে ভাবেনি, আমরা তাকে যদি সানন্দে বরণই করবো, তবে ফেলে গেলাম কেন? তাই যদ্দূর দেখতে পেয়েছি, ভুলু ছুটছিলো...।’
রবিন মনে হয় এতক্ষণে তার কাগজপত্র ঠিকঠাক করে নেবার জন্য ডাক পেয়েছে। সে বারবার এদিক ওদিকে তাকাচ্ছে। হয়ত মনে মনে আমাকেই খুঁজছে, কিংবা অন্য কাউকে, অন্য কিছু। আমি সাজ্জাদকে প্রশ্ন করলাম,
‘তারপর? ভুলুর আর কোন খোঁজ পেয়েছিলেন?’
সাজ্জাদ খুব হতাশ, ফ্যাকাশে গলায় উত্তর দিলো,
‘হ্যাঁ, পেয়েছিলাম। বগুড়া থেকে ফেরার পথে খোকনের আব্বা রওশন চাচা তাকে দেখতে পেয়েছিলেন, রেল লাইনের পাশে। যতক্ষণ শরীরে বল ছিলো, ভুলু ছোটা থামায়নি। বোকা ভুলুটা এক নাগাড়ে ছুটে গিয়েছিলো প্রায় পঁচিশ মাইল। তারপর এক সময় ক্ষুধা-তৃষ্ণায়-ক্লাণ্তিতে বসে পড়ে, শুয়ে পড়ে চিরতরে। ...রওশন চাচা বলেছিলেন, শেষ শোয়াটাও সে শুয়েছিলো আমরা যেদিকে গিয়েছি, সেই দিকেই মুখ করে...।’
আমি দেখলাম রবিন তার লটবহর নিয়ে 'প্যাসেঞ্জার্স অনলি' লেখা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরে ঢোকার জন্য, কিংবা আমেরিকা নামক টাকাপয়সার দেশের উদ্দেশ্যে পা বাড়ানোর জন্য অপেক্ষা করছে। রবিনের সকল পর্যায়ের সমস্ত আত্মীয়-স্বজন তাকে ঘিরে আছে। যেকোনও সময় সে চলে যাবে ধরা ছোঁয়ার বাইরে- এই পরিস্থিতিতে যেটা খুবই স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়া যায়, রবিন আরো একটু বেশি মনযোগ দেবে তার স্বজন-বন্ধু-পরিজনদের প্রতি, এমনটাই সবাই আশা করে আছে। কিন্তু রবিনের মনযোগ অন্য দিকে। সে তার কানের সাথে লেপ্টে থাকা মোবাইলের প্রতি এতটাই মনযোগী, যেন যন্ত্রটায় সে কেবল কথাই শুনছে না, বক্তাকে চোখের সামনে দেখতেও পাচ্ছে। এই সময় আরো একবার খড়খড় শব্দে লাউড স্পিকারে কিছু একটা বলা হতেই রবিন খুব ব্যস্ততার সাথে গেটের ভেতরে ঢোকার তোড়জোড় করতে গেল আর অমনি খালাম্মা, মানে রবিনের মা তার ওপর প্রায় হামলে পড়লো। আমারও চোখ ভিজে গেল আবেগপূর্ণ দৃশ্যটি দেখে। আর ঠিক তখনই একটা বিষ্ময়কর ব্যাপার ঘটলো। রবিন প্রায় রূঢ়ভাবে, একরকম ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো তার গায়ের সাথে লেপ্টে থাকা মায়ের শরীরটাকে!
আমি হতবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম রবিন কিছু একটা বলছে তার মা’কে, যেটা শুনে খালাম্মাসহ উপস্থিত অন্য প্রায় সকলেই যথেষ্ট পরিমাণ বিব্রত হচ্ছেন, তা এতদূর থেকেও বোঝা যায়। কাজল আর শাহেদ এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে বার বার, বুঝতে পারছি আমারই খোঁজ করছে তারা, আমার তবু উঠতে ইচ্ছা করলো না। আমার এমনকি সেদিকে আর তাকাতেও ইচ্ছা করলো না। আমার বন্ধু রবিন চিরতরে চলে যাচ্ছে, আমি আমার সীমিত সঞ্চয় ব্যয় করে তাকে বিদায় দিতে এসেছি এবং এখন অন্তিম মুহূর্তে বসে আছি, কিছুক্ষণ আগে পরিচিত হওয়া সাজ্জাদের পাশে, ঘন্টাখানেক আগেও আমার এবং আমাদের অনুমানে যার পরিচয় ছিলো একজন ধুরন্ধর ছিনতাইকারী হিসেবে। যে বন্ধুর সাথে আর কোনদিনই হয়তো দেখা হবে না, সেই রবিনের বিদায়-দৃশ্য উপেক্ষা করে আমি বসে থাকলাম সাজ্জাদের গভীর দুঃখে ঝুলে পড়া কাঁধের দিকে তাকিয়ে। আর ঠিক তখনই অমোঘ নিয়তির মতো ধ্বনিত হলো সাজ্জাদের কণ্ঠ,
‘তো কামাল সাহেব, এবার আপনি কী করবেন?’
আমি তার দিকে অবাক হয়ে তাকালাম। আমার বিষ্মিত দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সাজ্জাদ বলে চললো,
‘আপনি এখন কী করবেন, কামাল সাহেব?... ওই যে দেখছেন, আপনার বন্ধু রবিন, ডলারের দেশে পৌঁছুনোর জন্যে কেমন উদ্গ্রীব! আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সূত্র কাজ শুরু করে দিয়েছে। যে সময় আপনাদের কাছ থেকে পালাই পালাই করছে, সেই সময়টাই রবিনের আর কাটতে চাইছেনা। কী করবেন, কামাল সাহেব? এগিয়ে যাবেন, বন্ধুকে শেষ বিদায় দিতে? আপনার বন্ধু তো মহান টাকা-পয়সার দেশের আকর্ষণে ধরিত্রী মায়ের কোল ছাড়ছেন, গর্ভধারিণীকেও ইতিমধ্যেই বিরক্তি বলে ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন। রবিন তো দেশের মাটি ছাড়ার আগেই মা-মাটির টানকে ভুলতে পেরেছেন, আপনি কেন এখনও দ্বিধা কাটাতে পারছেন না? '...আমার কুকুর ভুলু, মানুষের সাথে থেকে থেকে আনুগত্য, বিশ্বস্ততা আর প্রভুভক্তি শিখেছিলো; বিষয়বুদ্ধি, স্বার্থজ্ঞান আর রূঢ় বাস্তবতা শিখতে পারে নি। পশুবত আচরণ পশুরাও ততটা পারেনা, যত দ্রুত শিখে যায় মানুষ! কী করবেন? ভুলুর মতো হত্যে দিয়ে পড়ে থাকবেন বন্ধুর গমণপথের দিকে...?’
কথা শেষ করে আচমকা উঠে দাঁড়ালো সাজ্জাদ। এক ঘন্টারও বেশি সময় কথা বলার পরও সাজ্জাদকে আমার খুব অচেনা মনে হলো। যেন পরিচয়ের আগেও সে এতটা অচেনা ছিলো না। আমি দেখলাম সাজ্জাদ হেঁটে চলে যাচ্ছে ‘বহির্গমন’ লেখা রয়েছে এমন দরজাগুলোর দিকে। ঘাড় ফিরিয়ে আমি দেখলাম রবিন এতক্ষণে সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে, কাঁচ ঘেরা ঘরের ভেতরে তার ধূষর স্যুটের আভাস। আর সে ঘরের প্রবেশ পথের সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন রবিনের মা, ছেলে-মেয়েরা মায়ের আহাজারী সামলাতে ব্যস্ত, আর যারা এখনও দাঁড়িয়ে আছে, তারাও কমবেশি উদ্বিগ্ন।
হঠাত করেই আমার কেমন দমবন্ধ হয়ে আসতে চাইলো। সেন্ট্রাল এসি'র প্রায় কাঁপতে থাকা শীতের মধ্যেও আমি ঘেমে উঠলাম। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না আমার কী করা উচিত। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বোকার মতো হাঁটতে থাকলাম। কোথায়, কোনদিকে- কে জানে!