সোমবার, ২৩ আগস্ট, ২০১০

আয়নাঘর

এবারই প্রথম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছিলাম ইন্টারনেট পকেটে নিয়ে। ইন্টারনেট সাথে থাকার সবচে বড় সুবিধা হলো, কোথায় যাচ্ছি, কী করছি সেটা ইচ্ছেমতন জানানো যায় অন্যদেরকে। যেমন আমি যে আমার এস্ এর বন্ধুদের সাথে নিয়ে এখন রাবি’তে অবস্থান করছি- এটা আমার ঢাকাস্থ বিশ্ববিদ্যালয়-বন্ধুদের প্রায় সকলেই জেনেছিল, অন্তত যারা আমার সাথে ফেসবুকে যুক্ত আছে। সুতরাং ক্যাম্পাসে বসে দেয়া বিভিন্ন স্ট্যাটাস আপডেটগুলোতে বন্ধুদের নানান কমেন্ট আসতে থাকলো সারাক্ষণই। তাদের মধ্যে দুটো কমেন্ট আমাকে বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছে বলেই এই লেখার অবতারনা (একটি নিয়েই এ যাত্রা কথা বলবো; অন্যটা তোলা থাক, পরে কখনও নামানো যাবে)। বলে রাখা ভালো, আমি খুব একটা নস্টালজিক নই। স্মৃতিমোহ আমাকে আবিষ্ট করে খুব কমই, কেননা আমি বর্তমানের মানুষ। আমি অতীত নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজী না, ঠিক তেমনি ভবিষ্যতের পরোয়াও করিনা একদমই। আমার কাছে বর্তমানটাই আসল, কারণ এটাই সবচে’ ক্ষণস্থায়ী। যে পল-অনুপল একে পাওয়া যায়, তার পুরোটুকু চেটেপুটে খেতে হবে, যেমনটা সুমন চেটেপুটে খান (আমাদেরও খেতে শেখান) “বিসমিল্লাহ্’র পাগলা সানাই”! এবং এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আমি ভালোবাসি নিজেকে পেপারওয়েট-এর সাথে তুলনা করতে।

কিন্তু আমি আবেগতাড়িত হলাম, যখন শফিক আমার স্ট্যাটাসে কমেন্ট করে জানতে চাইলো, আবুর ক্যান্টিন কি আগের মতো আছে? আবু ভাই কেমন আছেন খোঁজ নিস। আমি খোঁজ নিইনি। আমি ও তল্লাটেই যাইনি। আমার একবারও ইচ্ছে করেনি। আমার খুব কাছের কোনও ব্যক্তি মারা গেলে আমি চেষ্টা করি সেখানে ছুটে যেতে, মৃতের শেষকৃত্যে যোগ দিতে, কিন্তু সন্তর্পণে চেষ্টা করি, মৃতব্যক্তির শবদর্শন হতে বিরত থাকতে। ওই যে বললাম, আমি বর্তমানের মানুষ! আমি জানি, আবুর ক্যান্টিন আগের মতো নেই। হয়ই একেবারেই নেই। সেই শঙ্কা থেকেই দূরে থেকেছি আবু চত্বর থেকে। শঙ্কা এজন্যে যে, আমি স্মৃতিতাড়িত হই না তার কারণ হয়তো বা, আমি ভয় পাই স্মৃতিতাড়িত হতে। আমি খুবই সাধারণ, নিরীহ গোছের মানুষ। তাই যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হবে জেনেই বেলা থাকতে থাকতে নিজ গণ্ডির ভেতরে ঢুকে কষে খিল্ এঁটে দেই।

যদি ধরে নিই এই লেখাটি এস্ (ACE) এর বর্তমান প্রজন্ম পড়ছে বসে, তাহলে হয়ত আমি তাদের সীমাহীন কৌতুহলে কুঁচকে যাওয়া ভ্রুগুলো দেখতে পাচ্ছি। তাদের তো জানার কথা না, আবুর ক্যান্টিনের ইতিহাস। হয়তো আবুর ক্যান্টিন নামক একটা কিছু ছিল এই ক্যাম্পাসে সেটাই অনেকের কাছে অবাক করার মতো বিষয়। তাদেরকে কেউ কি বলেছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের “হ্যান্ড টু মাউথ” সংস্কৃতিকর্মীদের পরমাত্মীয় জ্ঞান করে দিনের পর দিন প্রতিপালণ করেছেন এই আবু ভাই? আমি বাজি রেখে বলতে পারি, রাবি ছেড়ে আসা সংস্কৃতিকর্মীদের মাঝে একজনও পাওয়া যাবে না, যাকে অন্তত একবেলার আহারের জন্য হলেও আবু ভাইয়ের উপর নির্ভর করতে হয়নি, অনেকের বাকী’র খাতা হয়তো আজও বন্ধ হয়নি, আবু ভাই নিতান্তই ছোটভাই (নাকি সন্তান?) জ্ঞান করে সে খাতা ছিঁড়ে ফেলেছেন, মনের খাতাতেও দিয়ে রাখেননি কোনও বিব্রতকর আঁচড়!

যাই হোক, আবুর ক্যান্টিনের গল্প বলি। আমি আবুর ক্যান্টিনে প্রথম গেছিলাম আমার সহপাঠী ইনিড-এর সাথে (সম্ভবত)। ইনিড তীর্থক নাটক-এ যোগ দেয়, আমাকেও এই দলে সে টেনে নেয়। সেটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আমার প্রথম পা রাখা। আমি তীর্থকে সব মিলিয়ে আট কি নয় মাসের বেশি থাকিনি। বলা ভালো, থাকতে পারিনি। ... আচ্ছা, তীর্থক প্রসংগ থাক, আবুর ক্যান্টিনের কথা বলি। ইনিড যেহেতু গ্রুপ করতো, দিনের বেলায় ক্লাসের ফাঁকের খুচরো মুহূর্তগুলোও সে চাইতো তার গ্রুপমেটদের সাথেই কাটাতে। পরে জেনেছিলাম, দলের সামাজিকীকরণ ত্বরান্বিত করার জন্য এই বিষয়টা দলই ঢুকিয়ে দেয় কর্মীদের ভেতরে। এইখানেই আমার আপত্তি ছিল। প্রত্যেক বিকেলে তুই গ্রুপে যাবি, এমনকি গ্রুপ শেষে হল গেট পর্যন্ত গ্রুপমেটরাই তোকে পৌঁছে দেবে- এতদূর মেনে নেয়া যায়, তাই বলে দিনের বেলা ক্লাসের ফাঁকেও আমরা একসাথে আড্ডা দিতে পারবো না? ইনিড হাসিমুখে বলতো, তাহলে চল্ আবুর ক্যান্টিনে। ... সে’ই আসা, আসতেই থাকা... এবং ক্রমশ আঁটকে যাওয়া।

আবুর ক্যান্টিনে কী হতো? কিছুই হতো না। আড্ডাবাজি হতো, দুপুরে খাওয়া হতো, তর্ক হতো, গান হতো, ঝগড়া-বিবাদ, বন্ধুত্ব, দল ও দলাদলি... সবই হতো, তবু বললাম কিছুই হতো না। কারণ এখানে কোনও আনুষ্ঠানিকতা ছিলো না। অথচ আমার মনে পড়ে না, ক্যাম্পাসে থাকাকালীন আবুর ক্যান্টিন খোলা ছিলো অথচ আমি একবারও সেখানে যাইনি- এমন কোনও দিন আদৌ ছিল কিনা। আবু ভাই মহা রসিক লোক। বাবার বয়সী বলে আমি প্রথম দিন 'আবু চাচা' সম্বোধন করেছিলাম, তাই শুনে বড়ভাইদের কী হাসাহাসি! আমি কোনও রকমে সামলে নিয়ে বললাম, আরে মানুষটা বুড়ো হচ্ছে, এখন তো অন্তত বাবার কাতারে তাকে স্থান দেয়া হোক। আবু ভাই তেড়ে আসলেন, ‘মামুর বাড়ি আব্দার পায়্যাছো নাখি? আইজক্যা বাপের কাতারে রাইখব্যা, আর কাইলক্যা আইস্যা বাপের হোটেলের ফিরি (ফ্রি) ভাত খুইজব্যা নাখি? ওইসব ধুনফুন বাদ, এই খর্চান্ত দুপুরে আমি খাতায় আঁচড় ক্যাটতে প্যারবো নাখো!’ খর্চান্ত দুপুর... খাতায় আঁচড় কাটা... বিষয় কী? বিষয়টা হলো, আবু ভাই একদা স্বননের কতিপয় কর্মীকে বলেছিলেন তাঁর ক্যান্টিনের প্রসার বাড়াতে কিছু পোস্টার যেন তারা লিখে দেয়। আমাদের সাহিত্যিক অগ্রজরা পোস্টার লিখলেন – “এই খরচান্ত দুপুরে মাত্র ১৩ (তের) টাকায় একমাত্র আবুর ক্যান্টিনেই আহার মিলবে!” এই ঘটনার ক’দিন পর সেই পোস্টার লেখকদেরই কোন একজন যখন লাঞ্চ শেষ করে উঠে যেতে যেতে বিল প্রসংগে 'আবু ভাই, খাতায় একটু আঁচড় কেটে দিন' বলে চলে যাচ্ছিলেন, তখন আবু ভাই তারই কথা তাকে শুনিয়ে দিলেন, ‘এই খর্চান্ত দুপুরে আমি খাতায় আঁচড় ক্যাটতে প্যারবো নাখো’!

যাই হোক, আবুর ক্যান্টিন ছিলো এমন একটা প্লাটফর্ম, যেখানে উভয় জোটের সকল দলের সদস্য-কর্মীদের দেখা হতো একসাথে (একমাত্র এই স্থানটিতেই হতো। অন্যখানে কেন নয়, তা পরে বলছি)। ক্যাম্পাসের প্রচলিত কিছু গান ছিলো (দু’একটা এখনও থেকে থাকবে)। নানান জেলার নানান ছাত্রছাত্রীদের কণ্ঠ-বাহনে চড়ে সেগুলো এখানে এসে পৌছেছিলো, তারপর এখানকার পৈতৃক সম্পত্তিতে পরিণত হয়। শ্রাবণে বসন্ত মিশুক রে, ছেঁড়া পলিথিনের মতো বোঁচকা হইয়া উড়ি, গ্যান্ডারী পিষাইয়া লোহার কলে থেকে নিয়ে অধুনা 'মনপুরা' ছবির কারণে মেগাহিট লেবেল লেগে যাওয়া নিধুয়া পাথারে নেমেছি বন্ধুরে... এই সবই রাবি ক্যাম্পাসের, আরো বিশেষায়িত করে বললে, আবুর ক্যান্টিনের গান। এই গানগুলো গাওয়ার জন্য আবার আমাদের গোটা তিনেক দল ছিলো, কেউ একজন গান ধরলে তার দলের ভেতর থেকে তাকে সাপোর্ট দেয়া হতো, গানটা শেষ হওয়ামাত্র অন্য দল থেকে আরেকটা গান ধরে পাল্টা জবাব দেয়া হতো। দলগুলোর নাম শুনলেই বোঝা যেত আমরা কতটা ‘তারছিঁড়া’ গোছের ছিলাম- সবচে’ প্রসিদ্ধ দল: ‘ঝ্যাঙ পার্টি’। তার পরে পরেই ‘হুক্কু পার্টি’ আর তারস্বরে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়ায় সংগ্রামরত ‘প্যাঁ পুঁ পার্টি’। মজার ব্যাপার হলো কেউই বরাবর একই দলের সদস্য থাকতো না। ধরা যাক কাল হুক্কু পার্টিতে ছিলেন যে সালেক ভাই, আজ তিনি এসেই ডাক ধরলেন, ‘ঝ্যাং পার্টি আছে-এ-এ-এ?’ সাথে সাথে তিন চারজন ধুয়া ধরলো, ‘আছে-এ-এ-এ’। ব্যাস, তৈরি হয়ে গেল সেদিনের ঝ্যাং পার্টি। বলাই বাহুল্য, সালেক ভাইয়ের সমান ক্যালিবারের কেউ সেই ধুয়ার দলে যাবে না, তারা তখন হুক্কু পার্টি গড়ার জন্য সদস্য খুঁজতে থাকবে। আর কুড়িয়ে বুড়িয়ে যা বাঁচলো, তা নিয়ে প্যাঁ পুঁ পার্টির আর্তনাদ চলবে কোনও রকমে। লক্ষ্যনীয় যে, যেহেতু আবুর ক্যান্টিনের আড্ডা দিনের বেলায় ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে জমতো, তাই শেয়ার বাজারের উত্থান-পতনের মতোই দলগুলোতে ভালো গাইয়েদেরও জোয়ার-ভাটা সৃষ্টি হতো। ...

আমার তখনও মনে হতো, এখনও মনে হয়, আমি যেমন করে আমার ডিপার্টমেন্ট-এর চেয়ে গ্রুপের কাছে শিখেছি বেশি, তেমনি করে গ্রুপের চেয়েও অনেক বেশি শিখেছি আবুর ক্যান্টিনের কাছে। ক্যাম্পাসের প্রথম বছরগুলোতে অনেকদিন আমার নিজের কোনও বিছানা ছিলো না, ঘর দূরে থাকুক। আমি ঘুমাতাম অন্যের সাথে বিছানা-বালিস ভাগাভাগি করে। কোনও রকমে রাতটা পার করতে পারলে আর আমাকে পায় কে? ডিপার্টমেন্টে আসলাম, ক্লাস একটা দুটো করলাম কি করলাম না, চলে গেলাম আবুর ক্যান্টিনে। এত এত বন্ধু-সহযোদ্ধা-সতীর্থ-অগ্রজ... এদের সাথে আড্ডায় গানে গল্পে সারাটা দিন কাটিয়ে দিয়ে বিকেলে গ্রুপ। গ্রুপ শেষ করে আবার আবুর ক্যান্টিনের সামনের পানির ট্যাংকির নিচে গানের আসর... কে বলে আমার ঘর নেই? কে বলে আমি অনাথ! সংস্কৃতিচর্চার সাথে নাড়ির বাঁধন জুড়ে গেছিলো আমার সেই আবুর ক্যান্টিনের প্রথম দিন থেকেই।

আমরা (আমি আর অরণি’র শোভন ভাই) আবুর ক্যান্টিনে বসেই... ঠিক আবুর ক্যান্টিনেও না, ক্যান্টিনের বাইরে কতগুলো বড় বড় গাছ ছিল তখন (দু’একটা এখনও থেকে থাকবে), যার গোঁড়া ছিলো ঢিবির উপরে, কেউ বলতো আবুর ঢিবি কেউ বলতো ভোঁতেল (ভুয়া+আঁতেল) চূড়া, কেননা এই ঢিবিগুলোতে বসে আঁতেলগণ (!) ভুয়া আড্ডা ছাড়া কার্যকর কোনও বিষয়ের অবতারণা করতে পারেননি কখনও; আমরা নাম দিয়েছিলাম মাউন্ট আবু বা আবু পর্বতমালা। তো সেই মাউন্ট আবু'র চূড়ায় বসে আমরা ঠিক করলাম আমরা একটা কর্মশালা করবো, গণসঙ্গীত বিষয়ে। এম সাবীহ্ পাপান, যিনি তাঁর সমগ্র জীবনব্যাপি গণসঙ্গীত চর্চার সাথে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন এবং সম্পর্কে আমার আপন মামা, তিনি আসবেন প্রশিক্ষক হিসেবে, আর অংশগ্রহণ করবে জোট-দল নির্বিশেষে সকল সংস্কৃতিকর্মী, এমনকি যারা কোন দলের সাথে নেই, সেই ইন্ডিভিজ্যুয়ালরাও স্বাগতম। বলে রাখি, এখন যেমন উদীচী-সমকাল একই জোটে গলায় গলায় ভাব করে কাজ করে যাচ্ছে, তখন এটা ছিলো কল্পনাতীত। দুটো আলাদা জোট ছিলো, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক জোট’ (যা কিনা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম কোনও সাংস্কৃতিক জোট) এবং ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট’ নামে। বলাই বাহুল্য, দুই জোটেরই নেতৃত্বে ছিলেন কতিপয় গুণধর সংস্কৃতিসেবী শিক্ষক, যাদের অন্তর্কলহের বলি ছিলাম আমরা (পরবর্তীতে রাবি জোটভূক্ত দলগুলোই প্রথম সিদ্ধান্ত নেয়, তারা শিক্ষকদের বাইরে রেখে দল ও জোট গঠন করবে, যার ধারাবাহিকতায় আজকের সম্পূর্ণরূপে ছাত্রদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত "রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট)। এমনও নজির আছে, একই হলের দুই রুমমেট বন্ধু যারা হলের ভেতরে হরিহর আত্মা, রাকসু ভবনের কাছাকাছি আসলেই তারা কেউ কাউকে চিনতেও চেষ্টা করে না! বাই চান্স যদি কোনওভাবে জোট নেতাদের কানে এই তথ্য চলে যায় যে, তার জোটের কোনও কর্মী ভিন্নজোটের কারো সাথে এমনকি কথা বলছে, অবধারিতভাবে তাকে এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে, প্রয়োজনে শাস্তিমূলক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েও যেতে হতে পারে! ... তো সেই হীরক রাজার দেশে আমরা পরিকল্পনা করলাম, আমাদের কর্মশালা হবে জোট নিরপেক্ষ। আমি রাবি জোটভূক্ত সংগঠনের আর শোভন ভাই সম্মিলিত সা.জোটের প্রতিনিধি হওয়ায় বিষয়টার বাস্তবায়নের ক্ষীণতম সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিলো, যে সম্ভাবনাটুকুকে প্রাণপণ পরিচর্জায় আমরা সফল করি। উভয় জোট একীভূত হবার আগে একত্রে সেটা ছিল প্রথম এবং শেষ কর্মযজ্ঞ। আমার মনে আছে, জুবেরী ভবনের টিচার্স ক্লাবে আমন্ত্রণ জানাতে গিয়ে এস এম আবু বকর স্যারের কাছে কী হেনস্থা হতে হয়েছিল। তিনি বাজী রেখে বলেছিলেন, আমরা ১০ জন কর্মীও পাবো না। বাজীতে হারলে কী করা হবে, সেটা বলেননি বলে অবশ্য সে যাত্রা তিনি বেঁচে গেছিলেন, কেননা আমরা কর্মশালা করেছিলাম মোট ৫৬ জন অংশগ্রহণকারীর সমন্বয়ে, আর কর্মশালার প্রযোজনায় শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা মঞ্চে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলাম মোট ৪০ জন। উন্মুক্ত মঞ্চে দেড় ঘন্টারও বেশি সময়ব্যাপি অত্যন্ত চৌকষ সেই অনুষ্ঠানটিকে বিবেচনা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগে আয়োজিত এ যাবতকালের সর্ববৃহৎ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

এই সুযোগে স্মরণ করছি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রবীণ শিক্ষক ও সাবেক ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার প্রয়াত অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুস স্যারের অবদান। আমাদের এই কর্মযজ্ঞে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও সংস্কৃতিসেবী শিক্ষক যুক্ত হতে চাননি। অনেকে এমনকি ‘গণসঙ্গীত আবার শেখার কী আছে? পথে-ঘাটের গান শিখে কী হবে!’ এমন বিদ্রুপাত্মক কথা বলতেও দ্বিধা করেননি। অথচ ভুক্তভোগীরা জানেন, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অন্তত একজন শিক্ষকেরও সমর্থনবিহীন কোনও আয়োজন সে যুগে ছিল অসম্ভব। ইউনুস স্যার শোভন ভাইয়ের বাবা ছিলেন, তবে সেটা কারণ ছিল না। তিনি শোভন ভাইয়ের কাছে শিক্ষকদের অসহযোগিতার বিষয়টি শুনে আমাকে দেখা করতে বলেছিলেন, কারণ আমি ছিলাম কর্মশালার আহ্বায়ক। আমাকে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমাদের কর্মশালার পৃষ্ঠপোষকতার জন্য কী কী যোগ্যতা থাকা দরকার? আমি সংস্কৃতিকর্মী না হলেও সংস্কৃতিসেবী, নইলে আমার ছেলেমেয়েদের তাগাদা দিয়ে দিয়ে গান-বাজনা শেখাতাম না। তাছাড়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আমি অন্যতম সংগঠক ও মুক্তিযোদ্ধা। তোমার যদি মনে হয়, এই যোগ্যতা যথেষ্ট তবে আমার কাছে যেকোনও সহযোগিতার জন্য আসতে পারো’। আমি এতটা বিমোহিত, এতটা কৃতজ্ঞ আর এত বেশি ধন্য কখনও বোধ করিনি। স্যার কেবল আমাদের কর্মশালা উদ্বোধনই করেননি, সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরকে নিজে থেকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি এই কর্মশালার প্রধান পৃষ্ঠপোষক, ফলে আয়োজনে আমাদের আর বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হয়নি। কর্মশালার অংশগ্রহণকারীদের কাছে এখনও থেকে থাকবে তাঁর মহামূল্যবান স্বাক্ষর সম্বলিত সনদপত্র।

আমাদের এ যুগের ছেলেমেয়েরা ক্লাস-পরীক্ষা-ইনকোর্স-টিউটরিয়ালের চাপে এতটাই কুঁজো হয়ে যাচ্ছে, ক’দিন পরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফিজিওথেরাপিস্ট নিয়োগ দিতে হবে প্রতি ডিপার্টমেন্টে, বাধ্যতামূলকভাবে। আর পড়াশোনা-ক্যারিয়ার ভাবনা যেভাবে তাদের নাকে-মুখে এঁটে যাচ্ছে, তাতে করে তারা এখনও অক্সিজেন মাস্ক ছাড়াই স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিচ্ছে কী করে, সেটাই একটা রহস্য। হায় কপাল, তোরা জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা কয়লা খাদের শ্রমিকের মতো খাটছিস ক’দিন পরে কলুর বলদ হবি বলে? এ জীবনের মূল্য তবে কী! আগে একাডেমিক বিল্ডিংগুলোর আশপাশের আড্ডায় ক্লাসের ফাঁকে যাদের দেখা যেত, তারা ছিলো একাডেমিক গুডিবয়, তাদের দিয়ে থিয়েটার হবেনা, এটা আমরা শুনে ও বলে এসেছি। এখন দেখি থিয়েটারগুলোই হাঁচড়ে-পাছড়ে কোনও রকমে একাডেমিক বিল্ডিংগুলোকে আঁকড়ে ধরে টিকে থাকার লড়াই করে যাচ্ছে। ফলাফল, ক্যাম্পাসে নতুন নাট্যকার জন্ম নিচ্ছে না, নতুন নির্দেশক নেই বললেই চলে, নতুন কর্মীও আসছে না সেই ডেডিকেশন নিয়ে। এখন এমনকি এমনও কানে আসে, দলে নতুন কর্মী ঘুরঘুর করে এই জন্যে যে, এই দলের ক’জন বড়ভাই ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় কাজ করে, তাই এটা হলো তাদের কাছে 'তারকা জগতে'র গেটওয়ে!

এর বিরূপ প্রভাব এতটাই পড়ছে দলগুলোর উপর তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং বৃহত্তর অর্থে পুরো দেশের সংস্কৃতিচর্চার উপর যে, ক্রমেই আমরা আরও বেশি মেধাশূণ্য হয়ে পড়ছি। দেশ স্বাধীন হবার পর পর চলচ্চিত্র বিষয়ের প্রতিটি আড্ডায় অবধারিতভাবে একটা প্রসংগ আসতো বলে বড়দের কাছে শুনেছি, আরেকজন জহির রায়হান কেন জন্ম নিচ্ছেনা, কেন আরেকটা জীবন থেকে নেয়া বানানো যাচ্ছে না ইত্যাদি। আজকাল এই আলাপ কেউ তুলতে গেলে সবাই মার মার করে তাকে থামিয়ে দেয়, কারণ আমরা জেনে গেছি, ও আর কোনওদিন হবার নয়। যতই বিজ্ঞাপনের ভাষায় বলা হোক তৈরি হচ্ছে মেধাবী বাংলাদেশ, আসল চিত্রটা উল্টো। যে প্রজন্ম শুদ্ধ উচ্চারণে মাতৃভাষাটাই বলতে জানে না, তাদের কাছে কতটা মেধা আশা করা যায়? টিভি দেখে আর ইন্টারনেট হাঁতড়ে আর যাই হোক, ক্রিয়েটিভ হওয়া যায় না। মানুষের সাথে না মিশলে, খোলা মনে অকপটে নিজের ভাবনা প্রকাশ করতে না পারলে ক্রিয়েটিভিটি বেরুবে কী করে?

দেখার চোখ থাকা যেমন জরুরী, সেই চোখটাকে নিজের ভেতরে আবিস্কার করাটাও জরুরী। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমি যদি কোনওদিন আবুর ক্যান্টিনের আড্ডায় না বসতাম, আমার মধ্যকার জড়তাগুলোকে আমি কোনওভাবেই জয় করতে পারতাম না। আমার নিজের সামর্থ সম্পর্কেই আমার জানা হতো না, আত্মবিশ্বাস ব্যাপারটাই আমার কাছে কল্পনা বলে মনে হতো, আমি চ্যালেঞ্জ কাকে বলে তা হয়তো বই পড়ে জানার চেষ্টা করতাম। নিজের ভেতরটা দেখার জন্য একটা আয়নাই যথেষ্ট নয়। কারণ প্রতিটা মানুষের মধ্যে অনেকগুলো অ্যাঙ্গেল থাকে, সেই প্রতিটা অ্যাঙ্গেল দেখার জন্য আলাদা আলাদা আয়না চাই। সেই সব নানান অ্যাঙ্গেলের আয়নার সমাহার বলতেই ছিল আমাদের আবুর ক্যান্টিন, আমাদের আয়নাঘর।

২টি মন্তব্য:

  1. apnr lekhar style niye notun kore kichu bolchi na dada...khub sorol kore puraton ar notun kichu chitro prokash korecn...office e boshe porlam lekhata...ami notunder doley...ba bolte gele apnader porer projonmo...abur canteen er golpoi shunechei..mithu vai rana vai ba tanvir vai er mukh thekei beshir vag shuna...ekhn abur canteen manik er dokan er pashe chole esche library er pashe..ar puro campus er kothao addar poribesh ba upay nei...ekhn jara porche tader e ba dosh dei ki kroe...75% class na korle exam deya jay na..tarupor puro campus e cultural activities jhoro hawai prodiper moto nivu nivu kore jolche...je du ekta 'nami' 'dami' group ache tara shilpo chorchar rajnoytik bohiprokashei beshi agrohi..se dikey jachhi na...sob miliye poristhiti khub najuk..uttoron prottasha korchi...bangla font install na thakay kosto holo portey..tar jonno dukkho prokash korchi..ar erokom lekha prottashito dada...one beshi onuprerona dey lekha gulu..valo thakben..

    উত্তরমুছুন
  2. Vaia apner blog ti amr vlo laga ca.
    Amra kicu X-Notredamin mila akta site launch korta jasci. Apni o amader satha join korta paren.

    Bangla magazine

    উত্তরমুছুন