রবিবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

গল্ফ

ক্রিকেট বিশ্বকাপ আসন্ন। আমরা এবার প্রথমবারের মতো স্বাগতিক। চারিদিকে হট্টগোল। আক্ষরিক অর্থেই হৈহৈ কান্ড রৈরৈ ব্যাপার। এই হুলুস্থুলের মধ্যে ক্রিকেট ছেড়ে গল্ফ নিয়ে আলোচনা করা আর মিলাদ মাহফিলে বসে থাকা অবস্থায় চাইনিজ মোবাইলের (এক্সট্রা লাউড!) রিংটোনে “ও টুনির মা তোমার টুনি কথা শুনে না...” বেজে ওঠা সমান কথা। না করেও পারছি না। আমার কলিগ ইউসুফ ভাই একটু আগে কী প্রসংগে যেন গল্ফের কথা পাড়তেই আমি বললাম, এই খেলাটার আমি কিছুই বুঝি না। সিদ্দিকুর রহমান সম্প্রতি খুবই ভালো খেলছেন এটা জেনে গর্ব হয় অনেক, কিন্তু কেন বা কীভাবে তিনি ভালো খেলছেন, সেটা বুঝতে পারি না বলে বিব্রতও হতে হয়। অবশ্য বিব্রত হবারই বা কী আছে? ৯৭ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন হয়ে কিংবা ৯৯ ও ০৭ বিশ্বকাপে পাকিস্তান ও ভারতকে হারিয়ে গোটা দেশ যখন আনন্দে উদ্বেল, প্রতিবারই আমার মা সমান উত্সাহে চিত্কার করেছেন খেলাটার বিন্দু-বিসর্গ না বুঝেই! তাঁর যুক্তি খুবই স্পষ্ট- বাংলাদেশের ছেলেরা জিতেছে, বাংলাদেশ জিতেছে, খুশি হবার জন্য এটাই যথেষ্ট, কীভাবে জিতলো তাতে কী আসে যায়? ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে জেতার জন্য আমরা আনন্দ করিনি? সেই যুদ্ধটা আমরা কে কতটা বুঝতাম!

তো, এইসব কারণেই দূর্বোধ্য খেলা গল্ফটাকে বোঝার জন্য খুব একটা তাগিদ’ও অনুভব করিনি তেমন। কিন্তু ইউসুফ ভাই নিজে যেহেতু খেলাটা বোঝেন, শিখেছেন কষ্ট করে, হয়তো মোটামুটি ভালো খেলতেও পারেন, সুতরাং তিনি আগ্রহী শিক্ষকের মতো নিয়মকানুনগুলো শেখানোর চেষ্টায় লেগে গেলেন। আমার “বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম” খুব একটা অগ্রসর হতে পারলো না, কেননা সাকিব তাকে ধরে নিয়ে গেল ধূমপানের সঙ্গী করে (সিগারেট ছেড়ে দেবার পরও আমি সিগারেটের কুফল থেকে বাঁচতে পারছি না... কী মুশকিল!)। সে যেটুকু যা বুঝলাম, তা থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগের একটা স্মৃতি ধাঁই করে ফিরে এলো হঠাৎ।

আমি তখন ক্লাস থ্রি কি ফোরে পড়ি। আমাদের বাসা থেকে খুব কাছের দোকানটা প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। যেতে হতো এ পাড়া দিয়ে, ও পাড়া ঘুরে কলোনীর গেট পেরিয়ে, শেষ কিছুটা অংশ বড় রাস্তা দিয়ে। প্রায়ই টুকটাক সদাইপাতির জন্য আমাকে দোকানে যেতে হতো, বলাই বাহুল্য পায়ে হেঁটে। আমি এই এক কিলো হাঁটবার কষ্টটাকে গায়ে মাখতাম না, বরং ব্যাপারটা এনজয় করতাম। সে কারণেই বোধ হয়, একেকবার আপ-ডাউন করতে আমার লেগে যেত দেড় থেকে দু’ঘন্টা! এমনও হয়েছে, চুলায় ডাল বসিয়ে আম্মুর খেয়াল হয়েছে লবণ নেই, আমি যথারীতি লবণ কিনতে দোকানের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে, মাঝপথে পাঁচ ওভার ক্রিকেট খেলে, আউট হয়ে এবং সেই আউটটা বৈধ ছিল, নাকি আম্পায়ার “পার্শিয়াল্টি” করেছে তা নিয়ে বিস্তর ঝগড়া বিবাদ করে, শেষমেষ দোকানে গিয়ে পকেটে হাত দিয়ে পয়সাটা মাঠেই কোথাও পড়ে গেছে আবিস্কার করে, আবারও প্রায় হাফ কিলো (এবার দ্রুত পায়ে) হেঁটে বাবার অফিসে গিয়ে তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে লবণ কিনে বাসায় পৌছে দেখি সবার দুপুরের খাওয়া শেষ!

তো, তেমনি’ই একদিন দোকানে যাচ্ছিলাম কিছু একটা কিনতে। রাস্তায় কনডেন্সড মিল্কের একটা খালি কৌটা পড়ে থাকতে দেখে পা দিয়ে সেটাকে লাথি মারতে শুরু করলাম। আমার টার্গেট হলো রাস্তার একেকটা ভাঙ্গা গর্তে কৌটাটাকে নিয়ে ফেলতে হবে, এক গর্ত থেকে আরেক গর্তে নিয়ে ফেলতে একটার বেশি লাথি খরচ করা যাবে না। সম্ভব হলে এক লাথিতে দু’তিনটে গর্ত পার করতে হবে। টিনের তৈরি খালি কৌটা এবড়োখেবড়ো পাকা রাস্তার উপর দিয়ে ছ্যাঁচড়া খেতে খেতে তারস্বরে চিত্কার করে আপত্তি জানাচ্ছে, সেই আওয়াজে চারপাশ প্রকম্পিত! আমার তাতে আনন্দের সীমা নেই! কায়দা করে এমনভাবে লাথি মারছি, যেন মাটি থেকে অনেকটা উপরে উঠে যায়, যাতে করে ভূপাতিত হবার সময় শব্দ হয় বেশি। আমার টার্গেট হলো, দোকানগুলো যেখান থেকে শুরু হয়েছে, তার কাছাকাছি একটা বড় ম্যানহল। সেখানে ফেলতে পারলেই আমার “পার” কমপ্লিট।

লাস্ট হোলের প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছি, এমন সময় কিছু বুঝে ওঠার আগেই কানদুটো গরম হয়ে গেল, বাঁই করে মাথা ঘুরে পড়ে যাবার দশা। একটু পরে “চটাশ!” শব্দটা শুনলাম (ব্যাটা থাপ্পড়টা মেরেছিল শব্দের চেয়েও দ্রুত গতিতে!)। তাকিয়ে দেখি মাঝবয়সী এক লোক, রাগে দাঁত কিড়মিড় করে তেড়ে আসছে আমার দিকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আরেকবার চটাশ! সরে যাবারও সময় পেলাম না। তারপরই শুরু হলো তার খিস্তিখেউড়! “.... এর বাচ্চা, ...এর পুত... কানের পোকা মার‌্যা দিছে! এ ...র ব্যাটা, এড্যা কি তোর বাপের রাস্তা পাছু? ...র ভাই...”।

হে পৃথিবী দ্বিধা হও, নয়তো কেউ একজন লাথি মেরে আমাকেই ওই গর্তটাতে ফেলে দিয়ে হোল পূর্ণ করো! আশপাশের সমস্ত লোক দাঁত কেলিয়ে হাসছে আমার দূর্গতি দেখে, একটা ব্যক্তিও নেই আমার পক্ষে কথা বলার, নিদেনপক্ষে সহানুভূতি জানাবার...।

আজ হঠাৎ এই ঘটনা মনে পড়াতে নিজের মনেই হাসলাম। যে কাজটা করতে গিয়ে নাবালক বয়সে আমি ভরা বাজারে থাপ্পড় খেয়েছিলাম, অপমানের চূড়ান্ত হয়েছিলাম, সেই একই কাজ করে টাইগার উডস্, সিদ্দিকুর রহমান’রা বিশ্বব্যাপি সম্মানিতই শুধু নন, লাখো কোটি টাকার মালিকও বনে যাচ্ছেন!

আহারে, গল্ফটা যদি সময় মতো বুঝতাম! আফসোস!!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন