সোমবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

কপিটাচ্

আমার বন্ধু গিয়াস কিছু করে না।
শুরুতেই একটা ভুল বাক্য লিখে ফেললাম। একটা মানুষ চব্বিশ ঘন্টায় কিছুই করে না- এটা এক কথায় অসম্ভব একটা দাবী। আসলে আমি বলতে চেয়েছিলাম, তার কোনো পেশা নেই। না, এটাও ঠিক হলো না। জীবিকা নির্বাহের জন্য স্বীকৃত পেশা- চাকরি, ব্যবসা বা কৃষিকাজ অথবা অস্বীকৃত কাজ- চৌর্যবৃত্তি অথবা ভিক্ষাবৃত্তি – এর কোনওটাই সে করে না বটে, কিন্তু সে বেকার নয়। বেকার তো নয়ই, বরং অন্য অনেক সাকার (মানে কর্মজীবি আরকি)দের চেয়ে সে বেশি ব্যস্ত, তার আয় রোজগারও মাশা’ল্লাহ ভালো। চার হাজার টাকা দামী সিমকার্ডের যুগেও তার হতে দু’দুটো মোবাইল থাকতো। এখন সিমকার্ড ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায়, তথাপি তার মোবাইল ওই দু’টোই যদিও, তবে সেই প্রথম থেকে এখন পর্যন্ত সে একটা নীতি মেনে চলে। সে কখনও কারো কল রিসিভ করে না। যে’ই কল করুক, নির্বিকারভাবে কলটা কেটে দিয়ে কল ব্যাক করে। অনেক সময় হয়তো ইনকামিং নাম্বারটা আননোন থাকে, সেটা সে চেনার চেষ্টাও করে না। কেন এই বিলাসিতা জানতে চাইলে একদিন বলেছিল, 'আমার তো কোনো অফিস নেই। এই মোবাইল দুটোই আমার অফিস। আর অফিস খরচ তো সব সময় অফিস মালিকেরই চালানোর কথা, তাই না?' যাই হোক, গিয়াসের রোজগার যেমন অনেক ভালো, তার খরচের হাতও দিলখোলা। আমি যেহেতু এখন পর্যন্ত কমপ্লিট বেকার এবং ঠিক কবে নাগাদ এই বেকারত্ব দূর করা সম্ভব হবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই, সুতরাং আমার প্রায়ই গিয়াসের সাথে দেখা করতে হয়, টাকা ধার করতে হয়। বেকার বন্ধুদের টাকা ধার দেয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতিগুলোর একটা হচ্ছে, যে অংকের ধার চাওয়া হবে তার চেয়ে সামান্য বেশি টাকা দেয়া এবং অমায়িক হাসির সাথে জুড়ে দেয়া, 'আমার কাছে আবার ধার বলতে হবে কেন? দিস, চাকরি পেলে শোধ করে দিস, নয়তো কোনো চাপ রাখিস না। আমার ওপর তোর দাবী আছে না?...' বুদ্ধিমান বেকার বুঝে ফেলে, আর দাবী করা যাবে না। গিয়াস টাকা দেবার সময় এমন করে না। বরং এমনভাবে টাকাটা দেয়, যেন পুরনো ধার শোধ করছে কিংবা আমার হাত দিয়ে তার গ্রামের বাড়িতে বাবা-মা’র কাছে টাকাটা পাঠাচ্ছে।
গিয়াস কোথায় থাকে আমার জানা নেই, সে আমাকে কোনোদিন তার বাড়িতে নিয়ে যায়নি। যখনই তাকে ফোন করি, তা মাসে অন্তত দু’বার তো করতেই হয়... বাজার দর যে পরিমাণ বাড়ছে, অদূর ভবিষ্যতে তিন চারবারও করতে হতে পারে! শালার একটা গোল্ডলিফ সিগারেটের দামও ৪ টাকা! আর রিকশাওলারাও যা নবাব হয়েছে একেকটা- সেদিন মালিবাগ থেকে রামপুরার ভাড়া ত্রিশ টাকায় বহু কষ্টে রাজি করিয়ে রিকশায় বসে একটা গোল্ডলিফ ধরাতেই রিকশাওলা ম্যাচটা চাইলো। তারপর মুখের সামনে ফট করে একটা বেনসন ধরিয়ে ফেললো! ম্যাচটা ফেরত দিতে দিতে ধোঁয়া ছেড়ে বলে কিনা, লাইটস্‌-এর সাপ্লাই কইমা গেছে মামা, এই ইলাকায় নাইক্কা। হের লাইগাই রামপুরা যাইতে রাজি হইলাম। রামপুরায় এবেলেবেল
আমার তো মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়, রিকশাওলা রিকশায় প্যাডেলে পা চড়িয়ে বলে, রিকশা টাইনা জুত হয়না মামা, হের লাইগা লাইটস টানি। লাল বেনসনের ধক বেশি হয়া গেছে। হালার পুতেরা দাম বাড়াইতাছে আবার মালও দিতাছে দুই নাম্বার! ... তো এই পরিস্থিতিতে ইজ্জত সম্মান বজায়ে রাখার জন্যই গিয়াসকে ফোন দিতে হয়। আর ফোন করলেই দুটো কমন জায়গায় তাকে পাওয়া যায়। এক হল বেইলি রোডের মহিলা সমিতির গেটের কাছে, নয়তো শান্তিনগর চৌরাস্তায়। দিনরাত এই এলাকায় দাঁড়িয়ে বা বসে থেকে কী করে সে এত টাকা রোজগার করে, তা আমার অনেকবার জানতে ইচ্ছে হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন করিনি। আমার দরকার টাকা, সেটা তার কাছে চাইলে পাওয়া যায়। যা চাই তারচেয়ে বরং বেশিই পাওয়া যায়। কীভাবে পাওয়া যায়, তার উত্স সন্ধান করতে গিয়ে যদি আম ছালা দুটোই যায়? প্রাচীন প্রবাদে তো আর এমনি এমনিই লিখেনি- দুধ দেয়া গরুকে খোঁচাতে নেই, তাতে লাথি যেমন খেতে হয়, তেমনি দুধ খাওয়াও বন্ধ হয়ে যায়।
এমনি একদিন সন্ধ্যা নাগাদ গিয়াসকে ফোন করতেই সে কল ব্যাক করে ডাকলো, বেইলি রোডে আয়। আমি মহিলা সমিতির সামনে আসতেই সে আমাকে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে রওনা দিল সিদ্ধেশ্বরীর দিকে। যেতে যেতে আমি প্রশ্ন করলাম,
‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
‘আমি যাচ্ছি স্টুডিওতে, তুই যাচ্ছিস আমার সাথে’।
‘ফটো স্টুডিও?’
‘না, অডিও রেকর্ডিং স্টুডিও’।
‘তুই স্টুডিওতে কী করিস?’
‘ওখানেই তো আমার কাজ। ওটাই আমার পেশা’
‘মানে? তুই কি গান গাস, নাকি বাজাস?’
‘কোনোটাই না। আমি অ্যারেঞ্জ করি’।
‘যাক, এদ্দিনে জানলাম তুই তাহলে মিউজিক অ্যারেঞ্জার’।
‘আরে না ব্যাটা, মিউজিক অ্যারেঞ্জার অনেক বড় ব্যাপার। আমি অত বড় কিছু করি না...’
‘তাহলে? তোর কাজটা কী?’
'ধর তক্তা মার পেরেক বুঝিস?'
'তার মানে?'
‘চল, দেখবি’।
গলির পর গলি, তস্যগলি পার হয়ে এক জরাজীর্ণ বিল্ডিংয়ের সামনে গিয়ে আমরা থামলাম, বাইরে একটা সাইনবোর্ড ঝুলছে- সপ্তসুর সঙ্গীত নিকেতন। গিয়াস কলিং বেল না বাজিয়ে মোবাইল বের করে কল দিল। কলটা রিসিভ করা হলো না, তবে সদর দরজা খুলে গেল। বাইরের ঘরে মেঝেতে বসে কিবোর্ডে চলতি হিট হিন্দী গানের সুরে কিছু একটা বাজানোর চেষ্টা করছে মাঝ বয়সী এক লোক। এই লোককে শান্তিনগর চৌরাস্তায় প্রায়ই গিয়াসের সাথে সন্দেহজনক নিচু গলায় কথা বলতে শুনেছি। আমি ভাবতাম লোকটা বড়জোর কোনো মুদি দোকানদার কিংবা সদরঘাট টু গাজিপুর রুটের “সুপ্রভাত” বাসের ড্রাইভার হবে হয়তো। এখন দেখি ব্যাটা কিবোর্ড বাজাচ্ছে, সুরটা নকল হলেও বাজনার হাত ভালোই। গিয়াস তার দিকে সালামের ভঙ্গিতে হাত তুলেই আমাকে নিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরের একটা ঘরে ঢুকলো। ভেতরে ঢুকে দেখি সেটা একটা রেকডিং স্টুডিও। দেয়ালে চট দিয়ে গদির মতো করে মুড়ানো, এমনকি দরজার ভেতর দিকটাও তাই। মেঝেতে মোটা কার্পেট। একপাশে একটা বিশাল টেবিলে কম্পিউটার মনিটর, আরো নানান রকম যন্ত্রপাতিতে ঠাসা, যেন কোনো বিমানের ককপিট আর সামনে সাজানো কন্ট্রোল প্যানেলের সুইচ বোর্ড। ছোট বড় গোটা চারেক স্পিকারও আছে। একটা ছেলে সেই সুইচ বোর্ডের উপর উপুড় হয়ে কী যেন করছে। গিয়াস ঢুকতেই ছেলেটা দাঁত কেলিয়ে হাসলো। গিয়াস খুব একটা পাত্তা না দিয়ে কোনো এক সাজ্জাদ ভাইয়ের খোঁজ নিয়ে জানলো এখনও আসেনি। তাই শুনে মনে হল সে একটু বিরক্তও হল। যাই হোক, আমরা বাইরে বেরিয়ে আসলাম। বাইরে লোকাল বাসের ড্রাইভার কিংবা মুদি দোকানদার টাইপের মিউজিশিয়ান তখন মোবাইলে কার সাথে যেন কথা বলছে। এই সুযোগে আমি গিয়াসকে প্রশ্ন করলাম-
‘এই স্টুডিওর নাম কী?’
‘কপিটাচ্’
‘কী টাচ?’
‘কপিটাচ। কপি বুঝিস না? এখানে বেশিরভাগ কপি গান হয় বলে এটার নাম কপিটাচ। এরকম কপিটাচ ঢাকা শহরে অনেক আছে, সে কারণে এটার নাম সাজ্জাদের কপিটাচ’।
‘ও আচ্ছা’।
ততক্ষণে ঘরের তিন নম্বর সদস্যের ফোনালাপ শেষ হয়েছে। গিয়াস পরিচয় করিয়ে দিল-
‘দশরথ দা, এ হল আমার বন্ধু মন্টু। আর মন্টু, উনি হচ্ছেন দশরথ কর্মকার, মিউজিক ডিরেক্টর’।
আমার বিস্ময়ের সীমা রইলো না। যাকে আমি মুদি দোকানদার কিংবা লোকাল বাসের ড্রাইভার ভেবে বসে আছি, সে আসলে মিউজিক ডিরেক্টর! হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, সত্য সাহা, দেবু ভট্টাচার্য্য থেকে নিয়ে আরডি বর্মণ, বাপ্পী লাহিড়ী, এ আর রেহমান নামগুলো আমার মাথায় এসেই মিলিয়ে গেল। আমার বিবর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে দশরথ কর্মকারের কী মনে হল কে জানে, আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
‘কী নাম বললেন? মন্টু! নামের মধ্যে আর্ট নাই। এই নাম দিয়ে তো সিঙ্গার হইতে পারবেন না। নাম শুইনাই কেউ আর গান শুনতে চাইবো না...’
গিয়াস বাধা দিল,
‘আরে মিয়া, হে গান গায় আপনেরে কইলো কেডা?’
‘গান আবার কেডায় বা গায়... গান তো আমরা গাওয়ায়ে নেই... হে হে’
‘রাখেন মিয়া, সবাইরে মুরগা ভাবেন কেন?’
দশরথ বাবু যেমন, আমিও কিছুটা থতমত হয়ে গেলাম। চুপ থাকাটাই সমীচিন ভেবে কথা বললাম না, দশরথ বাবুও চুপ। গিয়াস পকেট থেকে একটা বাশপাতা খাম বের করলো, তার ভেতর থেকে কয়েকটা ছবি দশরথের কিবোর্ডের উপর ফেলে বললো-
‘সাত দিনের মধ্যে পুরা অ্যালবাম করা লাগবো, পারবেন তো? এই হইলো সিঙ্গার। বিদেশী পাট্টি, মাল ভালো দিবো। মাইয়া নিজেই প্রডিউসার’।
দশরথ ছবির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর নিজের মনেই বললেন,
‘ছবি দেইখা গানের গলা বুঝবো ক্যামনে? সাথে আনতে পারলেন না?’
'ফালতু কথা বাদ দেন মিয়া। গানের গলা বুঝার কাম কী? গান কি হে গাইবো, না আপনি গাওয়াইবেন? সুরে পড়লে বোনাস, না পড়লে আপনের যন্ত্রপাতি আছে না? অটো টিউনার মারবেন, কম্প্রেশার মারবেন... ব্যাস। আপনেরে টাকা দিতেছি ক্যান?
‘সেইটা ঠিক আছে, তাও... মানে...’
‘আবার মানে মুনে কী? হে গাইবো ট্যাকা দিয়া, আর আপনি পাইবেন ট্যাকা। কার দায়িত্ব বেশি?... ছবি দেখাইতে আনলাম, চেহারা সুরত ভালো, মিউজিক ভিডিও বানাইতে আলাদা কইরা মডেল পেমেন্ট দেওন লাগবো না। সাজ্জাদ ভাইরে কইলাম আমার টাইম নাই, লেট কইরেন না...’
‘যাকগা, বাদ দেন। মাইয়ার নামটা কী?
‘নাম দিয়া কী করবেন?’
‘আরে এত চ্যাতো ক্যান? প্রজেক্ট সেইভ করতে নাম লাগবো না?’
‘একটা নামে সেইভ করলেই তো হয়... বাদ দেন। মেয়ের নাম ব্যাস বাসন্তী ..’
‘কী কইলা? ব্যাস বাসন্তী! এইটা আবার ক্যামুন নাম রে বাবা!’
‘কেমুন নাম মানে? ওই মিয়া কেমুনের কী দেখলেন? ন্যাশ নাসরিন হইতে পারে, মাস মাসুম হইতে পারে, ব্যাস বাসন্তী হইলে অসুবিধা কী?’
দশরথ বাবু এই একের পর এক আক্রমণে মনে হয় ক্লান্ত। একটু ক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন-
‘ঠিক আছে, তাইলে সিঙ্গারের নাম ব্যাস বাসন্তী, আর মিউজিক ডিরেক্টর ড্যাশ দশরথ!’
আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না, বলে উঠলাম-
‘একটু বাদ পড়লো দাদা, সিঙ্গার ব্যাস বাসন্তী, মিউজিক ডিরেক্টর ড্যাশ দশরথ আর অ্যারেঞ্জার গ্যাস গিয়াস!’
গিয়াস চিত্কার করে উঠলো-
‘ওহ্ হোয়াট আ ক্যাচ!’
আমি গলা মেলালাম-
‘এই না হলে কপিটাচ!’

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন