মঙ্গলবার, ১০ নভেম্বর, ২০০৯

লালছবি [একটি "প্রায় লোমহর্ষক" নাটকের পাণ্ডুলিপি]

দৃশ্য : এক
সময় : দিন
স্থান : ঈষণের বাড়ি

[এলোমেলো অগোছালো একটা বাড়ি। বসার ঘর, শোবার ঘর, ডাইনিং স্পেস... পুরো বাড়িটা এতটাই অগোছালো যে কোন্‌টা কোন্‌ জায়গা আলাদা করে চেনার উপায় নেই। ক্যামেরা থাকবে ক্যামেরাম্যানের শোল্ডারে, একজন মানুষকে নানান কাজকর্ম করতে দেখা যাবে। শটগুলো দেখে ডিসকভারি/ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলের কোন ডক্যুমেন্টারী বলে মনে হতে পারে। ফ্রেমের ব্যক্তিটির নাম ঈষণ খান, বয়স আনুমানিক ৪৫ বছর। তার চেহারাটা কোনমতেই পরিস্কার বোঝা যাবে না, অন্তত শোল্ডারে ক্যামেরা থাকা অবস্থায় একদমই না। এখানে দ্বিতীয় চরিত্রের নাম শিমুল সরকার, সে হলো ক্যামেরাম্যান। দ্বিতীয় আরেকটা ক্যামেরা থেকে তার চেহারা ও অভিব্যক্তি দেখা যাবে। এর মধ্যে শিমুলের শটগুলোকে ভিউফাইন্ডারের ক্রস চিহ্ন ও REC লেখা সাইন দিয়ে আলাদা করা যেতে পারে। লাইট অস্পষ্ট, তবে ঈষণ খান নিজেই লাইট সেট করছে ঘরের বিভিন্ন অংশে- এমন দেখা যাবে। এসব কাজের ফাঁকেই তাকে নানান কথাবার্তা বলতে শোনা যাবে, সবই ক্যামেরাম্যানের সাথে কথোপকথন]

ঈষণ: তোমার হাউজটার নাম যেন কী?
শিমুল: পেপারওয়েট প্রোডাকশন্স। নামটা একটু উদ্ভট, না?
ঈষণ: নাম কখনো উদ্ভট হয় না। নাম তো নামই, তার আবার উদ্ভট কী?
শিমুল: তা ঠিক, তবু প্রথমবার শুনলে লোকে বলে- এটা আবার কেমন নাম?
ঈষণ: একটা দেশ আছে, নাম গুয়াতেমালা। বাঙালীদের কাছে সে নামটা কেবল উদ্ভটই না, অশালীনও, কী বলো?
শিমুল: (হাসি) অকাট্য যুক্তি!
ঈষণ: রাইট। যুক্তির কাছে নতি স্বীকার করাই সবচে’ যৌক্তিক। এনিওয়ে, তোমার নামটা এবার বলো।
শিমুল: আমার নাম তো আপনি জানেন। শিমুল সরকার।
ঈষণ: তারপরও জানতে চাইলাম, তারও যুক্তি আছে। তোমার নামটা রেকর্ড হয়ে থাকলো। কারণ তুমিও আমার ছবির একজন পারফর্মার
শিমুল: কিন্তু... আপনার সাথে আমার পারফর্মেন্সের ব্যাপারে কোন চুক্তি হয়নি।
ঈষণ: তোমার সাথে কোন ব্যাপারেই কোন চুক্তি হয়েছে বলে মনে পড়ছে না।
শিমুল: আমার সাথে না হোক, আমার হাউজের সাথে হয়েছে...
ঈষণ: শোনো, বাংলাদেশে এখন ঘরে ঘরে চ্যানেল, ঘরে ঘরে প্যানেল। মিডিয়ার সেই রমরমা দিন আর নাই। তোমরা লাখ লাখ টাকার যন্ত্রপাতি কিনে হাত গুটিয়ে বসে আছো। আঙুল চুষতে চুষতে তোমাদের আঙুলে এমন ঘা হয়েছে যে, চুক্তি করার জন্য কলম ধরবার সাধ্য নাই।
শিমুল: তাই বলে আপনি...
ঈষণ: তাই বলে কী?

[শিমুল ক্যামেরার রোল বন্ধ করে দিবে]

: রোল বন্ধ করলে কেন? ক্যামেরা রোল করো। তোমার সাথে তিনদিন বোথ শিফটের কন্ট্রাক্ট, তুমি এই তিনদিন তোমার কাজ করে যাবে। ডিরেক্টরের কথাই আইন- এই এথিক তোমার শিক্ষায় ছিলো না?

[শিমুল আবার ক্যামেরা ঘাড়ে নিয়ে রোল দিবে]

শিমুল: তার মানে আমাকে তিনদিন বোথ শিফট ক্যামেরা ঘাড়ে করে আপনার সাথে বকবক করতে হবে?
ঈষণ: তা বলিনি। আর ক্যামেরা সব সময় শোল্ডারে রাখারও যুক্তি নাই। তুমি ট্রাইপডে বসাতে পারো, চাইলে ডলিও নিতে পারো। জার্ক হলেও ক্ষতি নেই। আমার জার্ক কন্ট্রোলের নিজস্ব কায়দা জানা আছে।
শিমুল: আপনার ছবির গল্পটা কী? অন্য পারফর্মাররা কোথায়?
ঈষণ: আমার ছবির কোন গল্প নেই। ইউনিটটাও একদমই ছোট। পারফর্মার- প্রোডাকশন- টেকনিশিয়ান... সব মিলিয়ে মাত্র দুজন।
শিমুল: তারমানে আপনি আর আমি?
ঈষণ: ইয়েস। আর গল্প একেবারেই নেই, তাও বলা যায় না। একটা গল্প অবশ্য আছে। সেটা আমার জীবনের গল্প। সেই অর্থে ছবির নাম জীবন থেকে নেয়া রাখা যেতে পারে।
শিমুল: এই নামে একটা বিখ্যাত ছবি অলরেডি আছে। জহির রায়হানের...
ঈষণ: আই নো আই নো। কিন্তু সেটা ছিলো জীবনের সত্য হতে পারতো এমন গল্পের অভিনয়। আর আমারটা একশ’তে একশ’ভাগ সত্যি এবং এতে কোন অভিনয় নেই।
শিমুল: জানতে পারি কি, এই ছবি আপনি কোথায় চালাবেন বা বিক্রি করবেন?
ঈষণ: না। জানতে পারো না। জানতে চাইতেও পারো না। তুমি কোথায় ক্যামেরা অপারেটিং শিখেছো, কতটা শিখেছো, এর দ্বারা তোমার কী কী পারপাস সার্ভ হয় এসব আমি জানতে চাইনি, চাইতে পারিনা।
শিমুল: কিন্তু আর সব কিছু বাদ দিলেও ছবির কোয়ালিটি, কালার মোড, ডেপ্‌থ অব ফিল্ড, রেজোলেশন... এসব অ্যাডজাস্ট করার জন্যও তো ব্রডকাস্টিং মিডিয়াটা জানা দরকার।
ঈষণ: কাট্‌। রোল বন্ধ করো। কতক্ষণ রোল হয়েছে দেখে বলো তো।
শিমুল: পনের মিনিট একুশ সেকেন্ড দশ ফ্রেম।
ঈষণ: এতক্ষণ পর তোমার খেয়াল হলো ডেপ্‌থ অব ফিল্ড, রেজোলেশন এসব অ্যাডজাস্ট করার কথা?

[শিমুল একটু অপ্রতিভ হবে, ঈষণও বিরক্ত হবেন]

: প্যাক আপ! যাও গা। আজ আর কাজ করবো না, কাল সকালে আসো। সেম টাইম, সেম প্লেস।
শিমুল: আই’ম্‌ স্যরি। মানে আমি কি আপনাকে...
ঈষণ: নো নো নো। ইটস ওকে। আমি এমনিতেই প্যাক আপ করতাম। কারণ আমারও প্যাক আপের সময় হয়ে গেছে।

[ইঙ্গিতে ঘরের অগোছালো আসবাবপত্র দেখাবে]

শিমুল: মানে?
ঈষণ: এইসব যা কিছু দেখছো, এগুলো আমি বিক্রি করে দিয়েছি। বলতে পারো নিজেকে ছাড়া আর সব কিছু আমি বেচে দিয়েছি।
শিমুল: বলেন কি!
ঈষণ: এখনো বলিনি পুরোটা। কালকে বলবো। যাই হোক, তুমি কি ক্যামেরা রেখে যাবে?
শিমুল: জ্বী না। সেটা নিয়মে নাই। ক্যামেরা অবশ্যই হাউজে ফেরত দিতে হবে, প্রতিদিন।
ঈষণ: যদি আউটডোরে যাও? কয়েকদিনের জন্য...?
শিমুল: সেটা আলাদা ব্যাপার , কিন্তু...
ঈষণ: ভয় পাচ্ছো, আমার খাট- আলমারির সাথে তোমার ক্যামেরাও না বিক্রি করে দেই?
শিমুল: দিলেই বা বিশ্বাস কী?
ঈষণ: রাইট, ভেরি ইন্টেলিজেন্ট। কখনো কাউকে বিশ্বাস করতে নাই। দাও, ক্যাসেটটা বের করে দাও।

[শিমুল ক্যাসেট বের করে দিবে, তার পর ক্যামেরা ট্রাইপড নিয়ে চলে যাবে]

দৃশ্য : দুই
সময় : দিন
স্থান : ঈষণের বাড়ির সামনে

[বাড়ির সামনে একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে, তাতে ঈষণ খানের ঘরের সমস্ত ফার্নিচার তোলা হয়েছে। একজন লোক ঈষণ খানের হাতে বেশ কিছু টাকা দিবে, তারপর ট্রাকের কেবিনে চড়ে বসবে। ট্রাক ছেড়ে দিবে, ঈষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকবে। দ্বিতীয় ক্যামেরায় দেখা যাবে শিমুল পুরো দৃশ্যটা শোল্ডারে ক্যামেরা রেখে ধারণ করছে। বরাবর সে ঈষণের পেছনে থাকবে। ট্রাকটা চলে গেলে ঈষণ খান ঘরে ঢোকার সিঁড়ির দিকে পা বাড়াবে, ক্যামেরা তাকে ফলো করবে। সিঁড়ির বাঁক ঘোরার সময় ঈষণের চেহারা দেখা যেতে গিয়েও যাবে না। ক্যামেরা তাকে ফলো করে ঘরের ভেতর আসবে, সেখান থেকে একটা ব্যালকনিতে চলে আসবে। ঈষণ খান বাইরের উজ্জ্বল আলোকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে ক্যামেরার দিকে তাকাবেন, তার চেহারা কিছুই বোঝা যাবেনা]

ঈষণ: আমার নাম ঈষণ খান। আমি নিজেকে একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করি। যদিও অদ্যাবধি কোনো চলচ্চিত্র আমি নির্মাণ করিনি, তবু আমি সজ্ঞানে, সুস্থ মস্তিস্কে দাবী করছি, আমার চেয়ে মেধাবী, আমার চেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং আমার চেয়ে সাহসী ফিল্ম মেকার আর একজনও নেই, অন্তত বাংলাদেশে নেই। আমি কোন ফিল্ম বানাইনি কেন? মুড আসেনি। হ্যাঁ, স্বীকার করছি, গত পঁচিশটা বছর যে ছবিটা বানানোর জন্যে আমি প্রিপারেশন নিচ্ছি, তার গল্পটা একটু গোলমেলে, মেকিংটা আরো বেশি জটিল। ঠিক কীভাবে শুরু হয়ে কীভাবে কোথায় এটা শেষ হবে, কেউ বলতে পারবে না।
একটা ছবি বানানোর জন্য, তাও আবার প্রথম ছবিটাই বানানোর জন্য পঁচিশ বছর একটু বেশিই দীর্ঘ সময়, মেনে নিচ্ছি। কিন্তু যদি বলি, আমি জীবনে একটাই ছবি বানাবো- তাহলে...? যা’ই হোক, একটু আগে আমার জীবনের সমস্ত সম্পত্তির শেষ কিস্তি বিক্রি হয়ে গেল। আমার এখন সম্বল সব মিলিয়ে কুড়ি হাজার টাকা। আমার প্রথম ছবি বানানোর জন্য আমি এখন সম্পূর্ণ প্রস্তুত, কিন্তু আমার ছবির বাজেট বলতে মাত্র এই কুড়ি হাজার টাকা, দুইয়ের পরে চারটা শূণ্য। মাত্র চারটা। ...সাতটা না হোক, ছ’টা না হোক, নিদেনপক্ষে পাঁচটা হলেও চলতো, কিন্তু ... কী করবো, আর কিছু তো বেচার নেই, নিজেকে ছাড়া। আর নিজেকে বেচলে তো অনেক আগেই বেচতে পারতাম, তাহলে আর আজকে... যাই হোক, নো কমপ্লেইন। কুড়ি হাজারই সই।
আমার বয়স পঁয়তাল্লিশ, অর্থাৎ সামনে পড়ে আছে পুরো একটা জীবনের প্রায় সিকিভাগ। এই দুইয়ের পিঠের চার শূণ্য দিয়েই তার একটা গতি করতে এবং করে যেতে হবে। করে যেতে মানে দিনের পর দিন গতি করতে থাকা, নাকি কোন রকম একটা গতি করে রেখে চলে যাওয়া?
আমি কি চিন্তিত?

[তারা আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকে পড়বে, ঈষণের চেহারা এক ঝলক দেখা গেল কি গেল না, আবার অস্পষ্ট হয়ে যাবে। আলো অ্যাডজাস্ট হতেই দেখা যাবে ঈষণ ক্যামেরার দিকে উল্টো ঘুরে গেছে। ক্যামেরা ট্রাইপডে বসানো হবে]

ঈষণ: আমি মোটেই চিন্তিত নই, তবে মনে হচ্ছে আমার ক্যামেরাম্যান ভীষণ রকম চিন্তিত। ওয়েল ওয়েল ওয়েল।

[ঈষণ মাথা নিচু করে টাকা গুনতে গুনতে ঘুরে দাঁড়াবে, আবারও তার চেহারা দেখা যেতে গিয়েও যাবে না]

: এই নাও শিমুল, তোমার তিন দিনের পাওনা নয় হাজার যোগ আরো এক হাজার বোনাস। এবার নিশ্চিন্ত?
শিমুল: ওটা পরে দিলেও চলবে।
ঈষণ: নো নো, এই সিকোয়েন্সে তোমার কোনো ডায়লোগ নেই। তুমি আজ শুধুই ক্যামেরাম্যান। নাও, টাকাটা রাখো।

[শিমুল এগিয়ে গিয়ে টাকাটা নিবে। এবারও ঈষণের চেহারা দেখা যাবার একটা সম্ভাবনা তৈরি হবে, কিন্তু শেষ মুহূর্তে ঈষণ সাবধান হয়ে যাবেন। তিনি যে সুকৌশলে ক্যামেরাকে ফাঁকি দিচ্ছেন, নিজেকে আড়াল করছেন, এটা এতক্ষণে দর্শকদের কাছেও স্পষ্ট হয়ে যাবে]

শিমুল: কিন্তু আপনার ন’হাজার দেবার কথা ছিলো, বোনাস কেন দিচ্ছেন? তাছাড়া কাজও তো শেষ হয়নি।
ঈষণ: কাজ তো শেষ হবে। আজ না হোক, কাল হবে। দিয়ে দিলাম। খরচ হয়ে যেতে পারে না?
আর বোনাসের কথা বলছো? আমার সামর্থে থাকলে তোমাকে এক হাজার নয়, এক লাখ টাকা বোনাস দিতাম। আমার ছবি শুরু করতে যে পঁচিশ বছর দেরি হয়েছে, তার মধ্যে পাঁচ বছর দেরি হয়েছে তোমার জন্য। পাঁচ বছর আমি তোমারই মতোন একজন ক্যামেরাম্যান খুঁজছিলাম।
শিমুল: বলেন কি!
ঈষণ: এখনো বলিনি পুরোটা। বলবোও না। যাই হোক, রোল অফ করো। চলো বাইরে যাই। ট্রাইপড থাক। পুরো ছবিটা আঁধার শ্যাঁতশেঁতে হয়ে যাচ্ছে। কিছু আউটডোর শট নেয়া যাক। সেই ফাঁকে কিছু প্রপস-কস্টিউম কিনে ফেলা দরকার। মজার ব্যাপার কি খেয়াল করেছো, ছবি বানানোর এই প্রস্তুতিগুলোও আমার ছবির অংশ।

দৃশ্য : তিন
সময় : দিন
স্থান : আউটডোর

[ঈষণ খান ও শিমুল ঘর থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা নিবে। রিকশায় বসে শিমুল কোলের ওপর ক্যামেরাটা রাখবে, সেখান থেকে ঈষণ খানের শরীরের কিছু অংশ দেখা যাবে, কিন্তু মুখ দেখা যাবে না। কিছুক্ষণ পর ঈষণ নিজের কোলে ক্যামেরাটা নিয়ে আসবে, তখন শিমুলের মুখসহ শরীর দেখা যাবে, রাস্তাও দেখা যাবে। তারা দুজনে গল্প করতে করতে যাবে, কিন্তু তাদের কথা শোনা যাবে না। রিকশা একটা মার্কেটের সামনে এসে দাঁড়ালে তারা নেমে এসে ভাড়া মিটিয়ে রিকশা ছেড়ে দিবে। ক্যামেরা রোল করাই থাকবে, এই অবস্থায় তারা মার্কেটে ঢুকে পড়বে। তবে ক্যামেরাটা ধরার কায়দায় কেউ বুঝতে পারবে না যে, রোল চলছে। মার্কেটে ঢুকে ঈষণ কিছু কেনাকাটা করবে, বেশির ভাগই পোষাক-পরিচ্ছদ। সে যা কিছু কিনবে, সবই এক জোড়া করে। কাপড় কিনতে গিয়ে আবিস্কৃত হবে, ঈষণ ও শিমুল দুজনেরই শারীরিক গড়ন একই মাপের, শুধু বয়সের পার্থক্য। কেনাকাটা শেষ করে তারা একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে যাবে]

দৃশ্য : চার
সময় : দিন
স্থান : রেস্টুরেন্ট

[রেস্টুরেন্টে ঈষণ আর শিমুল বসবে মুখোমুখি। ক্যামেরাটা একটা চেয়ারের ওপর রাখা থাকবে, রোল বন্ধ অবস্থায়। খাবারের অর্ডার নিয়ে ওয়েটার চলে যেতেই হঠাৎ শিমুলের খেয়াল হবে, রোল বন্ধ করা আছে। সে ব্যস্ত হয়ে রোল চালু করতে যেতেই ঈষণ খান বাধা দিবে]

ঈষণ: দরকার নেই। রোল বন্ধই থাক। ক্ষুধার্ত মানুষের খাওয়ার দৃশ্যে তেমন কোন শিল্প নেই। এটা আমার ছবির মধ্যেও নেই। বাই দ্য ওয়ে, তুমি কি যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষুধার্ত?
শিমুল: এটা একটা অবান্তর প্রশ্ন। সেই সকাল থেকে তো একসাথেই কাজ করছি। আপনি যদি ক্ষুধার্ত হন তো আমি হব না কেন?
ঈষণ: তুমি ক্ষুধার্ত, তবে আমার মতো হয়তো নও। কারণ কাল বিকেলের পর থেকে আমি কিছুই খাইনি। তোমাকে বিদায় করে দিয়ে নিচে নেমে কয়েকটা ফোনকল করেছি, আর এককাপ চায়ে ভিজিয়ে একটা পাউরুটি খেয়েছি। আমার কাছে সব মিলিয়ে বিশটা টাকাই ছিলো।
শিমুল: বলেন কি!
ঈষণ: এখনো বলিনি পুরোটা। রিকশা ভাড়া তোমার কাছ থেকে নিলাম, খেয়াল করোনি? কারণ আমার কাছে আজ সকালে পাওয়া টাকার বাইরে কোন টাকা ছিলো না। লোকগুলো আজকে যদি কোন কারণে না আসতো, তাহলে আজ খাওয়াও হতো না, শুটিংও হতো না।
শিমুল: এই অবস্থা... আমাকে বলেন নি কেন?
ঈষণ: বলিনি, কারণ বলি না! বাদ দাও। তুমি ছবি দেখ?
শিমুল: দেখি। তবে দেশি ছবি দেখি না।
ঈষণ: দ্যাটস্‌ ফাইন। দেশি ছবিতে আসলে দেখার কিছু নেই। কমার্শিয়াল ছবি তো বলাই বাহুল্য, বিকল্প-স্বকল্প কী কী সব নাম দিয়ে এরা ট্রেন্ড তৈরি করার একটা পাঁয়তারা কষছে দিনের পর দিন। না হচ্ছে কমার্শিয়াল না হাচ্ছে আর্ট ... এসব বাদ দাও। কোন ধরণের ছবি বেশি দ্যাখো?
শিমুল: সব ধরণের। মানে হাতের কাছে যা পাই আরকি। অ্যাকশন, রোমান্টিক...
ঈষণ: হরর ফিল্ম দ্যাখো?
শিমুল: খুব কম। হিন্দী ফিল্মে হরর ছবিগুলোই সবচে’ পুওর।
ঈষণ: ওহ্‌ মাই গড, তুমি হিন্দী ছবির কথা বলছিলে! হতাশ করলে। যাই হোক, বাইরের ছবি দ্যাখো না? মানে এশিয়ার বাইরে...
শিমুল: হলিউডের কথা বলছেন?
ঈষণ: হ্যাঁ এবং না। হলিউডেই যে সবচে’ সেরা ছবিগুলো তৈরি হয়, তা নয়। আবার যেকোন দেশের যেকোন নির্মাতার স্বপ্ন থাকে, হলিউডে গিয়ে ছবি বানানোর। এনিওয়ে, নন-গ্রামাটিক্যাল ছবির প্রতি আগ্রহ আছে?
শিমুল: আমি ঠিক বুঝলাম না।
ঈষণ: স্নাফ মুভি দেখেছো কখনও?
শিমুল: দ্যাখা দূরে থাকুক নামও শুনিনি।
ঈষণ: সেটা দোষের না। তোমার লজ্জিত হবারও কিছু নেই। আমি বাজি রেখে বলতে পারি, এদেশে যারা নিজেদের ফিল্ম মেকার, ডিরেকটার, ছবিওয়ালা... ইত্যাদি ইত্যাদি ভাবে, তাদের অনেকেরই এই ধারার ছবি সম্পর্কে কোন আইডিয়া নেই। অথচ স্নাফ মুভি হলো বিশ্বের সবচেয়ে কম খরচে নির্মীত, কিন্তু সবচেয়ে ব্যবসাসফল ছবি। গড়পড়তা একেকটা স্নাফ মুভি দুই-তিন কোটি টাকায়ও বিক্রী হয়!
শিমুল: দুই-তিন কোটি!!
ঈষণ: গড়পড়তা। যত্ন নিয়ে বানাতে পারলে আরো বেশি দাম পাওয়া যায়।
শিমুল: এসব মুভি চলে কোথায়? নিশ্চয়ই সিনেমা হলে না?
ঈষণ: এগুলো আসলে সবার জন্যে নয়। স্নাফ মুভির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো বিভৎসতা। পাশবিক একটা ব্যাপার থাকা খুব জরুরী। বেশির ভাগ স্নাফ মুভিতেই নগ্নতা থাকে, ডাবল এক্স রেটেড করা থাকে, কিন্তু স্নাফ হবার জন্যে নগ্নতা- যৌনতা এসব একেবারেই আবশ্যক নয়। যা দরকার তা হলো- বিভৎসতা, হিংস্রতা...
শিমুল: লাইক হরর মুভি
ঈষণ: না, হরর ফিল্মে যা ঘটে তা কাল্পনিক। ভ্যাম্পায়ার বলে কোন চরিত্র আদৌ ছিলো না পৃথিবীতে। বাট স্নাফ মুভি ইজ রিয়েলিস্টিক। অ্যাবসলিউট রিয়েলিটি নিয়ে এই বস্তু তৈরি হয়। বিকৃত রুচির কিছু মানুষ আছে পৃথিবীতে, যাদের ঠিক কত টাকা আছে, তার হিসেব রাখার জন্যে গোটা একটা কোম্পানী খুলতে হয়। এই লোকেরাই হলো স্নাফ মুভির সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক, ক্রেতা, দর্শক-সমাজ... যাই বলো না কেন।
শিমুল: ইন্টারেস্টিং! কিন্তু আমরা এসব নিয়ে আলোচনা করছি কেন?
ঈষণ: কারণ, একটা স্নাফ মুভি- আমরাও বানাবো। অন্তত আমি তো বানাবোই। জানা প্রয়োজন, তুমি কি আমার সাথে থাকবে?
শিমুল: কিন্তু ... মানে বানানো তো যায়ই, কিন্তু বিক্রী করবেন কোথায়? আপনার কি কোন...
ঈষণ: বিক্রীর ব্যবস্থা না থাকলে কি বানানোর আইডিয়া মাথায় আসে? এই ব্যবস্থা করতেই তো পঁচিশটা বছর গেল। যাই হোক, তুমি আমার সাথে কাজ করবে? ভেবে বলো। ইউ উইল বি আ মিলিওনিয়ার! ক্যামেরার পিছনে তোমাকে থাকতে হবে না, ক্যামেরাই তোমার পিছে পিছে ঘুরবে... করবে কাজ আমার সাথে?
শিমুল: কবে বানাবেন? আই মিন কতদিন...
ঈষণ: আজকে! এখন। তুমি বললে এখনই কাজ শুরু করে দিই। আমার সব প্রিপারেশন নেয়া আছে। শুধু দরকার একজন ক্যামেরাম্যান, যে আমার কথা শুনবে, আমার ইশারা বুঝতে পারবে। এবং আমার প্রতি বিশ্বস্তও থাকবে। বুঝতেই পারছো কেন আমি...
শিমুল: আমি একটু ভেবে দেখি।
ঈষণ: দ্যাখো। ভেবে দ্যাখো। আমার কোন তাড়া নেই। কাল তো দেখা হচ্ছেই, কাল জানাও। চাইলে আরো সময় নাও। আমার অনেক তাড়া, আবার কোন তাড়া নেই।
শিমুল: সেটা বুঝতেই পারছি। পঁচিশ বছর যে ধৈর্য ধরে আছে, তার তাড়া থাকা এবং না থাকা দুটোই সমান সমান।
ঈষণ: তুমি ভিষণ ইন্টেলিজেন্ট। এই জন্যেই তোমাকে দরকার। উই ইউল বি আ টিম। পারহ্যাপস্‌ দ্য বেস্ট পসিবল কম্বিনেশন| আজ চলে যাও। এখান থেকেই প্যাক আপ। কাল সকাল দশটায়। আমার বাসায়।

[তারা রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আসবে, শিমুল একটা রিক্‌শা বা সিএনজি ডেকে তাতে উঠে বসবে, রিকশা চলতে শুরু করতেই পেছন থেকে ঈষণ কথা বলে উঠবে। তার গলার আওয়াজ একটু রহস্যময় শোনাবে। এই দিনদুপুরেই যেন শিমুল একটু কেঁপে উঠবে]

: একটা কথা শিমুল।

[শিমুল রিক্‌শা থামাবে, নেমে আসতে যেতে ঈষণ ইশারায় বসে থাকতে বলবে। তারপর তার হাত ধরে খুব রহস্যময়, প্রায় ফিসফিস করে, কিন্তু বেশ আন্তরিক সুরে কথা বলবে]

: আমার সম্পর্কে তোমার ধারণা কী? আমরা তো একসাথে কাজ করলাম প্রায় দুদিন। ইভেন তুমি এখন আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানো, বিশেষত আমার পছন্দ-অপছন্দ, পরিকল্পনা... কী মনে হয়? কেমন মানুষ আমি? কেমন বুঝছো আমাকে?
শিমুল: এখনই বলবো?
ঈষণ: না, এখন বাসায় যাও। ঠান্ডা মাথায় ভাবো, কাল শুনবো। তবে হ্যাঁ, সত্য কথা শুনতে চাই। কথা দিচ্ছি, সত্যিটা যাই হোক না কেন, তোমার সাথে আমি কাজ করবো। যাও, বেস্ট অব লাক।

[শিমুলকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঈষণ চলে যাবে উল্টোদিকে ঘুরে হাটতে হাটতে। তার হাতে সদ্য কেনা কাপড়ের এক সেট প্যাকেট। আরেক সেট শিমুলের হাতে। শিমুল কিছুক্ষণ তার চলে যাওয়া দেখে যে মুহূর্তে রিকশাকে যেতে বলবে, ঠিক তখনই ঈষণ তার দিকে ফিরে বলবে-]

ঈষণ: কালকের কস্টিউম তোমার হাতে। এগুলোই পরে এসো।

দৃশ্য : পাঁচ
সময় : দিন
স্থান : ঈষণের বাড়ি

এই প্রথম ঈষণ খানকে ক্যামেরার পেছনে দেখা যাবে। একটা জোন লাইট করা হয়েছে, একটা চেয়ারে বসে আছে শিমুল। তার পোষাক-পরিচ্ছদ ঈষণ খানের অনুরূপ। ক্যামেরা ট্রাইপডের উপর বসানো, হাইট আপ করা, শিমুলের মাথার ওপর ইঞ্চিপাঁচেক হেড রুম রাখা হয়েছে, তার পায়ের সামনে ফুট দুয়েক জায়গা ফ্রেমের ভেতরে থেকে গেছে। ক্যামেরার মিনি এলসিডিতে ফ্ল্যাট লাইটে শিমুলকে দেখা যাচ্ছে, মোটামুটি অ্যাটেনশান অবস্থায় বসে আছে। লাইট কন্ট্রাস্ট আর ফোকাস অ্যাডজাস্ট হতেই ঈষণ রোল দিবে। তারপর নিজেই কথা বলতে থাকবে।

ঈষণ: রোলিং, ফাইভ ফোর থ্রি টু ওয়ান জিরো অ্যাকশন। বলো।
শিমুল: কী বলবো?
ঈষণ: তোমাকে কালকে একটা প্রশ্ন করেছিলাম, সে প্রসঙ্গে বলো।
শিমুল: কোন প্রসঙ্গে?
ঈষণ: ওহ্‌ হো! ভুলে গেছো, না ভুলে যাওয়ার ভান করছো? আমার সম্পর্কে তোমার ধারণা কী? আমার সম্পর্কে মূল্যায়ণটা কেমন জানতে চাচ্ছি।
শিমুল: প্রশ্নটা ইচ্ছে করেই আপনার মুখ দিয়ে উচ্চারণ করিয়ে নিলাম। কেন, তার ব্যাখ্যা আশা করি দরকার নেই। যাই হোক, আপনি কি সত্যি উত্তর চান?
ঈষণ: নিশ্চয়ই চাই। টোটাল আনসেন্সর্ড!
শিমুল: আমি কি কেবল অ্যাজ এ ডিরেক্টর আপনাকে মূল্যায়ণ করবো, নাকি...
ঈষণ: ঈষণ খান-কে মূল্যায়ণ করো। হোয়াট এভার হি ইজ, ডেস্ক্রাইব দ্য টোটালিটি।
শিমুল: এক কথায় আপনাকে মূল্যায়ণ করা যায়- আপনি একজন ব্যর্থ মানুষ।

[ঈষণ খানের চেহারায় হালকা হাসির আভাস এসেই মিলিয়ে যাবে। তাকে মনযোগ দিয়ে ভিউফাইন্ডারে তাকিয়ে থাকতে দেখা যাবে, যদিও শটে কোনপ্রকার মুভমেন্ট থাকবে না। শিমুলের কথা শুনতে শুনতে একসময় ঈষণ ক্যামেরা ছেড়ে দিয়ে পেছনে হাঁটাহাঁটি করতে থাকবে, তার অভিব্যক্তি বদলে যেতে থাকবে। হাঁটতে হাঁটতে শেষ দিকে সে শিমুলের চেয়ারের পেছনে চলে আসবে, শিমুল সেটা খেয়াল করবে না। তার কথা বলার মধ্যে এক ধরণের জেদ লক্ষ্য করা যাবে, যেন সে এই দু’দিনের সার্বিক অভিজ্ঞতায় যার পর নাই বিরক্ত, সুযোগ পেয়ে সমস্ত বিরক্তি সে একবারে উগরে দিচ্ছে]

: একজন ব্যর্থ মানুষের সব রকম বৈশিষ্ট্য আপনার মধ্যে আছে। ব্যর্থ লোকেরা অস্থির হয়, ধৈর্য্য কম হয় তাদের। আপনারও তাই। না, আপনি কথায় কথায় অস্থির হন না, কিন্তু আপনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, বা নিলেও হুট করে নেন। সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন নি বিধায় আপনার প্রথম ছবি শুরু করতে পঁচিশ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে- এটা সিদ্ধান্তহীনতা বা অস্থিরতার সবচে’ বড় উদাহরণ। আর প্রথম দিন হুট করে যে প্যাক আপ করে দিলেন, সেটা প্রমাণ করে আপনার মধ্যে কোন প্রফেশনালিজ্‌ম নেই। আপনি যে একজন দাম্ভিক লোক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যেটুকুই শ্যুট করা হয়েছে, সেটা দেখলেই... আদৌ যদি তা দেখার সুযোগ কেউ পেয়ে থাকে- তো সে নিশ্চিতভাবেই বুঝতে পারবে, আপনি একজন দাম্ভিক এবং অহঙ্কারী। জানিনা কীভাবে আপনি এই মাধ্যমে এসেছেন, হয়তো কোনভাবে কোনদিন ভালো কিছু করেওছিলেন, সেখান থেকেই আপনার ধারণা হয়ে গেছে, আপনি এই দেশের তথা এই ব্রহ্মাণ্ডের শ্রেষ্ঠ নির্মাতা। আর সেই দম্ভই আপনাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। একজন হতাশাগ্রস্থ, ভেঙ্গে পড়া মানুষ বলতে আপনাকেই বোঝায়। আপনি যে পঁচিশ বছরের গল্প শোনাচ্ছেন, তার কোন ভিত্তি নেই। আমি এই দুদিন ভালো মতো খোঁজ নিয়েছি, ‘ঈষণ খান’ নামে কোন নির্মাতাকে আমাদের মিডিয়া চিনে না। কোন মাধ্যমের কেউই আপনাকে চিনে না, আপনার প্রতি আগ্রহী নয়। একটা লোক পঁচিশ বছর ধরে ছবি বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে, অথচ তাকে কেউ চিনে না- আমাদের দেশের মিডিয়াটা খুব ছোট, এই গল্প এখানে কেউ বিশ্বাস করবে না। তাছাড়া আপনার চলচ্চিত্র নির্মাণের কোন বাস্তব জ্ঞান আদৌ আছে কিনা, তাতেও আমার সন্দেহ আছে। এই দু’দিনে প্রায় আড়াই ঘন্টা শুটিং হয়েছে, আপনি একবারও ক্যামেরায় লুক থ্রু করেননি, মনিটর নেননি, লাইট অ্যারেঞ্জ করেন নি, এমনকি ক্যামেরার কালার ব্যালান্সও করেন নি। পঁচিশ বছর ধরে যে ছবি বানাবেন বলে তৈরি হচ্ছেন, তার কোনো স্ক্রিপ্ট নেই, কাহিনী নেই, পারফর্মার নেই... আপনি আসলে কী করছেন তা আপনি নিজেও জানেন না। কোত্থেকে কে আপনাকে এই ফিল্ম বানানোর বুদ্ধি দিয়েছিলো... আমার ধারণা কুবুদ্ধি, সেটাই আপনাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। কারণ আপনি না পারেন এর বাইরে ভাবতে, না পারেন এর ভেতরে থাকতে। আপনি একটা ব্যর্থতার মহাকাব্য ছাড়া আর কিছু নন, আর আপনার সাথে কাজ করতে গিয়ে আমারও এটা পণ্ডশ্রম ছাড়া আর কি? আপনি আসলে...
ঈষণ : হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি ব্যর্থ। আমি ধ্বংস, আমি একটা বাতিল ইতিহাস, ব্যর্থতার মহাকাব্য। কিন্তু তুমি একবারও বলতে পারবে না, আমি প্রতিভাবান নই। আমার মধ্যে ক্রিয়েটিভিটি নেই- এই কথা তুমি বলতে পারবেনা।
শিমুল: যে ক্রিয়েটিভিটি প্রকাশ হতে পারে না, তার দ্বারা আপনাকে মূল্যায়ণ করা যায় কী করে?
ঈষণ: হ্যাঁ স্বীকার করছি, আমার ক্রিয়েটিভিটি আমি প্রকাশ করতে পারিনি, বিকোশিত হয়নি। তার জন্যে আমি একা দায়ী নই। দায়ী পুরো সিস্টেম। আমাদের দেশে সিস্টেম না থাকাটাই একটা সিস্টেম। আমি কেন ছবি বানাতে পারিনি তা আমি যেমন জানি, তুমিও তা অনুমান করতে পারো। আমি নতুন করে অজুহাত দিবো না। কিন্তু আমি স্পষ্টভাবে দাবী করছি, দেশে সিনেমার নামে যা তৈরি হচ্ছে, তা একটা সিনেম্যাটিক তেলেসমাতি ছাড়া আর কিছু না, কিচ্ছু না। আমি এইসব ছবি বানাবো না, সারাজীবন ছবিই বানাবো না, তবু এই ছবি বানাবো না। ... কিন্তু আমি কী করবো? আমি তো ছবি বানানো ছাড়া আর কিছু জানি না। আমার অগাধ টাকা নেই, বিশাল কোনো কিছুই নেই, বিশাল একটা স্বপ্ন ছাড়া। কিন্তু শিমুল, তুমি অস্বীকার করতে পারো সুনীলের সেই কবিতা? আর সব মরে, স্বপ্ন মরেনা... অমরত্বের অন্য নাম হয় ...? আমি পারিনি। কিছুই আমি পারিনি, গড়তে কিছু পারিনি, জুড়তেও পারিনি। একটু একটু করে তিল তিল করে নিজেকে তৈরি করেছি- ছবি বানাবো। টাকা নেই। প্রডিউসার আমার কাহিনী শুনবে না, তার নিজের গল্প বানাতে হবে। তার জীবনের সত্য কাহিনী, যেটা সদ্য মুক্তি পাওয়া হিন্দী ছবির কাট টু কাট নকল! বার বার একই কাহিনী, একই ঘটনা। শেষমেষ ঠিক করলাম নিজেই বানাবো ছবি। কিন্তু বার বার সিডিউল পড়ে, বারবার পিছিয়ে যায়। নতুন নায়িকা পেলে সবাই ধেই ধেই করে নাচতে থাকে, কে কার আগে তাকে বিছানায় তুলবে। নতুন ডিরেক্টারকে বিপদে ফেলাও মনে হয় তেমননি একটা রীতি। তাই শেষ হয়ে গেল জমানো টাকা।
...এইটা আমার শেষ চেষ্টা ছিলো। এবার অনেক ভেবেচিন্তে এমন একটা কাহিনী লিখলাম, যাতে পারফর্মারই কেবলমাত্র দুজন নয়, বরং সর্বসাকুল্যে সে দুজনই প্রোডাকশন ইউনিট। আমার সেই স্ক্রিপ্ট নাটক শুরুর তিনদিন আগে হারিয়ে গেল! আমি কি হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিবো? বেচতে বেচতে সবই তো বেচে ফেলেছি, এবার আত্মহত্যা ছাড়া আর তো কোন পথ খোলা নেই!
ভেবেছিলাম, কাজ করতে করতে কাহিনীটা নতুন করে সাজিয়ে নিবো, হলনা। মাথাই ঠান্ডা রাখতে পারছিনা, কাহিনী।

[হঠাৎ ঈষণ হিস্টিরিয়া রোগীর মতো করতে থাকবে, চেয়ারের পেছন থেকে সামনে চলে আসবে। তার পিঠ দেখা যাবে, সে ক্যামেরার দিকে পেছন দিয়ে শিমুলের মুখোমুখি মাটিতে হাঁটু দিয়ে বসে পড়বে, তার হাত পকেটে ভরা]

: কিন্তু না, এবার আর পরাজয় নয়, এবার আমি জিতবো। এই মুখ আমি কাউকে দেখাবো না। আমি শেষ হয়ে যাবো, তবু হেরে যাবো না।

[আচমকা ঈষণ পকেট থেকে হাত বের করবে, তার হাতে লাল রঙের কাঁচের শিশি। শিমুলকে কিছু বুঝতে না দিয়ে সে বোতলের ঢাকনা খুলে ভেতরের তরলটা মুখে ঢেলে দিবে, মুহূর্তে তার চেহারা বদলে যাবে। সে দুহাতে মুখ ঢেঁকে চিৎকার দিয়ে উঠবে, বোঝা যাবে তরল অ্যাসিডে নিজের মুখ সে ঝলসে দিয়েছে। ঘটনার আকস্মিকতায় শিমুল বিষ্ময়ে বিমুঢ় হয়ে যাবে, কী করবে ভেবে না পেয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াবে, তার সামনে ঈষণ মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছে। ঈষণ অস্ফুটে ‘পানি’ বলে আর্তনাদ করতেই শিমুল ছুটে যাবে পানির খোঁজে। এদিকে ঈষণ সহ্য করতে পারছিনা বলতে বলতে পকেট থেকে একটা রিভলবার বের করে নিজের নাক বরাবর তাক করে ট্রিগার টেনে দিবে। গুলির আওয়াজে মাঝপথেই থমকে দাঁড়াবে শিমুল। আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে দেখবে, ঈষণ খানের নিথর দেহ পড়ে আছে ক্যামেরার সামনে। এতক্ষণে তার খেয়াল হবে, ক্যামেরা চলছে। সে ছুটে গিয়ে রোল বন্ধ করতেই খুব স্বাভাবিকভাবে উঠে বসবে ঈষণ খান। শিমুল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে]

ঈষণ: কেমন লাগলো আমার অভিনয়?
শিমুল: মানে... পিস্তলের গুলি...
ঈষণ: খেলনা পিস্তল। আসলের মতো দেখতে, তেমনি বাঁজখাই আওয়াজ। যে ব্যাটারা বানায়, তাদের মাথা আছে, যাহোক।
শিমুল: কিন্তু এসবের কী মানে... আমি ঠিক
ঈষণ: ভয় পেয়েছো? হা হা হা... দেখলে তো, ডিরেক্টর হিসেবে না হোক, অ্যাক্টর হিসেবে আমার প্রতিভা তোমাকে স্কীকার করতে হবেই হা হা হা... হ্যাট্‌স অফ টু মি! এন্ড চিয়ার আপ বয়, উই হ্যাভ ডান ইট!
শিমুল: মানে? আমরা কী করেছি? কিছুই তো বুঝতে পারছি না...
ঈষণ: পারবে পারবে। সব বুঝতে পারবে। আগে এই খানে বসো। ঠান্ডা হয়ে বসো। তারপর পুরো ব্যাপারটা চিন্তা করো, সব বুঝতে পারবে।

[শিমুল আবার আগের চেয়ারটাতে গিয়ে বসবে, ততক্ষণে ঈষণ উঠে নিজের মুখের ময়লাগুলো পরিস্কার করছে। সেই অবস্থাতেই দুজনে কথা বলবে।]

শিমুল:দাঁড়ান দাঁড়ান, আমাকে একটু বুঝে উঠতে দিন! ...আপনি একটা স্নাফ মুভি বানাবেন বলেছিলেন
ঈষণ: যেখানে একটা বিভৎসতা থাকবে, নিষ্ঠুরতা থাকবে
শিমুল: আর সেই বিভৎসতা আপনি সৃষ্টি করলেন নিজেকে নিজেই হত্যা করে।
ঈষণ: হ্যাঁ, কারণ হত্যা দৃশ্য ছাড়া স্নার্ফ মুভি করা যায় না।
শিমুল: দর্শক জানবে একজন অহঙ্কারী, দাম্ভিক, সম্বলহীন, নি:স্ব...
ঈষণ: কিন্তু দারুণ প্রতিভাবন চলচ্চিত্র নির্মাতা নিজের ব্যর্থতা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করলো।
শিমুল: আর এদিকে নিজের মৃত্যুদৃশ্য বিক্রী করে ঈষণ খান কামিয়ে নিলো দুই-তিন কোটি...
ঈষণ: উঁহুঁ, দুই মিলিয়ন
শিমুল: মিলিয়ন? আপনি তো বলেছিলেন কোটি। এখন বলছেন বিশ লাখ...
ঈষণ:ইয়েস, বিশ লাখ। বিশ লাখ ডলার! দুই-তিন কোটি টাকার চেয়ে বিশ লাখ ডলার মাপে একটু বড়। হা হা হা

[কথা বলতে বলতেই কোন এক ফাঁকে ঈষণ খান ক্যামেরা থেকে ক্যাসেটটা বের করে নিবে, এবং নতুন একটা ক্যাসেট ভরে রোল করবে, সেটা শিমুল একদমই খেয়াল করবে না]

শিমুল: বিশ লাখ...! মানে প্রায় চৌদ্দ কোটি! ওহ মাই গড। এই এতটুকু একটা কাজের দাম... কিন্তু-
ঈষণ: কিন্তু কী?
শিমুল: আমার একটা খটকা লাগছে। এত টাকা দিয়ে তারা একটা ক্যাসেট কিনবে কেবল একটা মৃত্যুদৃশ্যের অভিনয় দেখতে?
ঈষণ: আগেই তো বলেছি, এরা বিকৃত রুচির...
শিমুল: তাতে কোন সন্দেহ নেই, সেটা নিয়ে প্রশ্নও নেই। কিন্তু কথা হচ্ছে, একটা ডামি দেখে ... আই মিন অভিনয় দেখে এত টাকা কেন তারা দিবে? পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি সিনেমায় মৃত্যুদৃশ্যের অভিনয় থাকে, সেসব দেখেই তারা তাহলে সন্তুষ্ট নয় কেন?
ঈষণ: আমি আগেই অনুমান করেছিলাম, তুমি বুদ্ধিমান। আর বুদ্ধিমানদের সাথে কাজ করতে আমি পছন্দ করি। যদিও একজন বোকা লোকের চেয়ে পার্টনার বুদ্ধিমান হলে যেকোন এফোর্ড প্রায় তিনগুন বেশি দিতে হয়, তারপরও পছন্দ করি। কারণ বুদ্ধিমান লোক আমার অনেক কাজ সহজ করে দেয়।
শিমুল: কীভাবে?
ঈষণ: এভাবে!

[আচমকা সে শিমুলের পেছন থেকে তার গলায় একটা স্টিলের সরু তার পেঁচিয়ে দিবে, সাধারণত শ্বাসরোধ করে হত্যার কাজেই এই অস্ত্রটা ব্যবহার করা হয়। শিমুল কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারটা তার গলায় শক্তভাবে বসে যাবে। ক্যামেরার ভিউ থেকে শিমুলের মুখে মৃত্যুভীতি দেখা যাবে, আর দেখা যাবে ঈষণ খানের দুটো হাত। অন্য ক্যামেরায় ঈষণ খানের মুখটা ক্লোজ ফ্রেমে দেখা যাবে, সেই মুখে হত্যাকারীর নারকীয় অভিব্যক্তি। পৈশাচিক বিভৎসতায় ঈষণ একটু একটু করে হাতের চাপ বাড়াচ্ছে, আর সেই সাথে ভয়ানক একটা স্বরে কথাও বলে চলেছে। আর এদিকে শিমুল একটু একটু করে মৃত্যুটাকে দূরে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করছে, কিন্তু যতই সে চেষ্টা করছে, ততই আরো বেশি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ঈষণ খানের কথা শেষ হওয়া মাত্রই সে মরে যাবে এবং ফ্রেম ডার্ক হয়ে এন্ড টাইটেল উঠতে থাকবে]

ঈষণ: তোমার অনুমান সঠিক। যারা একটা মৃত্যুদৃশ্য দেখার জন্য দুই মিলিয়ন ডলার খরচ করে, তারা আসলে সিনেমা দেখতে চায় না, তারা দেখতে চায় বাস্তব। তারা বাস্তবিকই হত্যাকন্ডটি ঘটাতে চায়। সেজন্যেই এতগুলো টাকা তারা খরচ করে। আমি পাঁচ বছর তোমার অপেক্ষায় ছিলাম, সে তোমাকে খুন করবো বলে। তোমাকেই খুঁজছিলাম কারণ তোমার সাথে আমার আকার আকৃতি পোষাকের মাপ, এমনকি গায়ের রঙ, ব্লাড গ্রুপ পর্যন্ত মিলে যায়। এতগুলো ম্যাচিং দরকার ছিলো, কারণ তোমার ডেডবডিটাকে সনাক্ত করা হবে ঈষণ খান হিসেবে। একটু আগে যে টেপের রোল তুমি বন্ধ করেছো, সেই টেপ চলে যাবে পুলিশের কাছে, তারপর তাদের হাত ঘুরে মিডিয়ার কাছে। সবাই জানবে, ফ্রাস্ট্রেটেড ফিল্ম ডিরেক্টর ঈষণ খান দেনার দায়ে দেউলিয়া হয়ে আর নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে না পারার লজ্জায় আত্মহত্যা করেছে। আর এই ঘটনার একমাত্র স্বাক্ষী ক্যামেরাম্যান শিমুল পুলিশী হয়রানীর ভয়ে পলাতক। অন্যদিকে ঈষণ খানের চেহারা যেহেতু কারো কাছে চেনা নয়, তোমার ক্যামেরাতেও সেই মুখ দেখা যায়নি একবারো, সুতরাং ঈষণ খান অন্য কোন নাম নিয়ে নিশ্চিন্ত মনে বসবাস করবে সকলের সামনে। কেননা, ঘটনার একমাত্র স্বাক্ষী শিমুলই তো মৃত! আর এই মৃত্যুদৃশ্যের সাথে আগের টেপের পুরো অংশটা জুড়ে দিয়ে যে ছবিটা তৈরি হবে, তাতে এই লোমহর্ষক স্নাফ মুভিটির বাজারদর কোন মতেই দুই মিলিয়ন ডলারের কম হতে পারে কি? হা হা হা... কার এত বড় সাহস, ঈষণ খানের মেধা যোগ্যতা আর প্রতিভা নিয়ে প্রশ্ন তোলে?



সমাপ্ত

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন