মঙ্গলবার, ১০ নভেম্বর, ২০০৯

হঠা‍‍ৎ যদি

দৃশ্য: এক / সকাল
অফিসের হলরুম

[মি. জামশেদ খান হলরুমের ভেতর দিয়ে জনা দশেক কর্মচারীর সালাম গ্রহণ করতে করতে নিজের চেম্বারের দরজা অতিক্রম করবেন। ফাইল হাতে পিএস লিয়ানা তাকে অনুসরণ করলে দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। বন্ধ দরজার ওপর নেমপ্লেট দেখা যাবে- Jamshed Khan, MD, Islam Grouop

দৃশ্য: দুই / কন্টিনিউড
জেকের চেম্বার

[জেকে তার চেয়ারে বসতে বসতে লিয়ানা'র দিকে হাত বাড়িয়ে দিবেন, লিয়ানা তার হাতে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক ধরিয়ে দিবে। চেয়ারে বসে সেটা খুলতেই ফোন বেজে উঠবে। তিনি বিরক্ত চোখে একবার ফোনটা দেখবেন, তারপর তীব্র দৃষ্টিতে তাকাবেন লিয়ানা’র দিকে। লিয়ানার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যাবে]

জেকে : কী ব্যাপার? এটা বাজছে কেন?
লিয়ানা : স্যার এটা ডিরেক্ট কল। যিনি কল করেছেন তিনি আপনার এক্সটেন্‌শন নাম্বার জানেন।
জেকে : সেটা আমার প্রশ্ন ছিলো না। আমি অফিসে আসার পর অ্যাট লিস্ট থার্টি মিনিটস্‌ কোন ফোন রিসিভ করিনা- এটা আপনার জানা থাকা উচিৎ।
লিয়ানা : স্যার উনি যদি সরাসরি কল করেন তো...
জেকে : হাউ ডেয়ার ইউ ক্রস মি! আমার সাথে আর্গুমেন্টে যাবার আগে আপনার ভেবে দেখা উচিৎ, অন্য কোন অপশন আপনার হাতে ছিলো কিনা। ইউ শুড হ্যাভ ডিসকানেক্টেড দ্য ফোন।
লিয়ানা : স্যরি স্যার

[সে ফোনটা সত্যি সত্যিই ডিসকানেক্ট করে দিবে]

জেকে : কফি।
লিয়ানা : রেডি আছে স্যার।... স্যার, একটু আগে এক্স-মিনিস্টার জাহিদ চৌধুরী সাহেব একটা কার্ড পাঠিয়েছেন, এখনই দেখবেন?
জেকে : এক্স-মিনিস্টার সাহেবের কার্ড ক্যান ওয়েট, নট মাই কফি। দিনের প্রথম কফি টাইমলি না খেলে আমার মেজাজ ঠিক থাকে না। আর আমার মেজাজ চটে গেলে এক্স কেন, অ্যাকটিং মিনিস্টারও ঝামেলায় পড়বেন, ইউ নো দ্যাট।
লিয়ানা : স্যরি স্যার। এক্ষুণি দিচ্ছি।

[লিয়ানা কফির মগ টেবিলে রাখবে]

জেকে : ইউনিকর্ন-এর ফাইলটা এনেছেন? মতিউর সাহেবকে বলুন লাস্ট শিপমেন্টের ডিটেইল নিয়ে ঠিক দশটায় বোর্ড রুমে বসতে। সোবহান সাহেব চিটাগাং অফিসের প্রবলেম নিয়ে একটা ডিটেইল রিপোর্ট করবেন। লাঞ্চের আগেই আমি তার সাথে বসতে চাই। সাদেকের কাছে আমার প্রশ্ন- আমাদের চৌদ্দটা গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট বাতিল হলো কী কারণে? অল এভরিথিং ক্লিয়ার?... ওকে। ...হার্ভেস্টারের ব্যাপারটা কী? মেইল এসেছে?
লিয়ানা : ভেন্যু নিয়ে সমস্যা, স্যার। ওরা রিকোয়েস্ট করেছে, আপনি যেন বার্লিনের পরিবর্তে লিসবন প্রেফার করেন।
জেকে : মিটিং কি স্যাটার্ডে’তে? আই অ্যাম স্কেজ্যুলড ফর প্যারিস অন থার্সডে, ইজ ইট? ওকে, দেন আমি প্যারিসের পরিবর্তে বার্লিন লিসবন কোনটাই প্রেফার করছি না। হাওয়েভার, তারা যদি ভেনু চেঞ্জের প্রস্তাব করে, তো আমাদেরও করবার রাইট আছে, কি বলেন? প্রোপজ প্যারিস ওর ক্যানসেল দ্য ডিল।
লিয়ানা : স্যার...!
জেকে : আই রিপিট, ক্যানসেল দ্য ডিল। কার্ডটা খুলেছেন?
লিয়ানা : কোন কার্ড, স্যার? ও আচ্ছা, না স্যার। আপনার যদি ব্যক্তিগত হয়ে থাকে...
জেকে : আমার ব্যক্তিগত হয়ে থাকলে আমার ব্যক্তিগত ঠিকানায় আসতো। অফিসে এসেছে মানেই ওটা অফিশিয়াল পারপাসে এসেছে। খুলুন, খুলে দেখে বলুন, ব্যাপারটা কী।

[লিয়ানা খাম খুলে দেখবে, তারপর জেকের দিকে বাড়িয়ে দেবে]

লিয়ানা : জাহিদ সাহেবের বড় ছেলের বিয়ে, আগামী শুক্রবার, স্যার। ইউ আর কর্ডিয়ালি ইনভাইটেড উইথ ফ্রেন্ডস এন্ড ফ্যামিলি।
জেকে : [খানিকক্ষণ ভেবে নিয়ে] ফোনটা অ্যাকটিভ করুন।

[লিয়ানা ফোন অ্যাকটিভ করতেই সেটায় রিং বাজতে থাকবে, লিয়ানা এবং জেকে দুজনেই ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকবে। জেকে লিয়ানা’র দিকে তাকাতেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে। জেকে ফোনের স্পিকার অন করবেন]

অপরপ্রান্ত : ব্যাপার কী রে ভাই, রিং হতে হতে কেটে গেল, তারপর তখন থেকে ট্রাই করছি...
জেকে : স্যরি স্যার, লাইনটা আমিই ডেড করেছিলাম। আপনি ফোন করেছিলেন তা তো বুঝতে পারিনি। এনিওয়ে, আপনার কার্ড পেলাম।
অপরপ্রান্ত : আরে রাখেন আপনার কার্ড। আপনার সাথে কি কার্ড চালাচালির সম্পর্ক নাকি? আমার উচিৎ ছিলো নিজে গিয়ে বলে আসা...
জেকে : সেইটা না করেই তো আমারে মেরে ফেললেন রে ভাই! এখন আমি যদি না যাই তো আপনি ভাববেন আমি মাইন্ড করেছি। এদিকে ঘটনা তো অন্যরকম। আই হ্যাভ টু লেফট ফর প্যারিস অন থার্সডে!
অপরপ্রান্ত : এইটা আপনি কী বললেন? অবশ্য দোষটা আমারই, আপনার সাথে পরামর্শ না করেই ডেট ঠিক করেছি...
জেকে : আরে না না, কী বলেন স্যার... আমার জন্যে...
অপরপ্রান্ত : ফার্স্ট কার্ডটাই আপনারে পাঠায়েছি, বাকিগুলি এখনও বিলি করা শুরু হয় নাই। আমি বরং ডেট পিছায়ে দেই...

[লিয়ানা একটা ফাইল হাতে নিয়ে প্রবেশ করবেন]

জেকে : স্যার, আমারে আর লজ্জা দিয়েন না, প্লিজ। আপনি আমার জন্যে ছেলের বিয়ে পিছায়ে দিতে পারেন, আর আমি সামান্য একটা ট্যুর পিছায়ে নিতে পারবো না? ডোন্ট ওরি, প্যারিস ক্যান ওয়েট।
অপরপ্রান্ত : সো নাইস অব ইউ, জেকে সাহেব, মনে বড় বল পেলাম।

[সৌজন্যমূলক কথা বলে লাইন কেটে দিবেন]

লিয়ানা : মেইল কি সেন্ড করবো, স্যার?
জেকে : সেন্ড করবেন মানে? এখনো করেন নি?
লিয়ানা : এখনও করিনি স্যার।
জেকে : হোয়াই? এতক্ষণে তো রিপ্লাই চলে আসার কথা ছিলো
লিয়ানা : স্যার আমি ভাবলাম, ...মানে আপনি ফোনে যে রকম বললেন...
জেকে : ওহ্‌ গড, আপনি আমার নির্দেশ ফলো না করে ফলো করছেন আমার টেলি কনভারসেশন? হোয়াট ননসেন্স!
লিয়ানা : মানে স্যার ঠিক তা নয়.. মানে... আমি ভাবলাম আপনি জাহিদ স্যারের প্রোগ্রামে অ্যাটেইন করবেন বললেন, সুতরাং
জেকে : মিস লিয়ানা, আপনি এই অফিসে পুরো ছয় বছর চাকরি করছেন। আমার কাছে কোন কাজটার প্রায়োরিটি কতখানি, সেটা আপনার জানা থাকা উচিৎ!
লিয়ানা : স্যরি স্যার।
জেকে : আমি প্যারিসে আইফেল টাওয়ার দেখতে যাচ্ছি না যে, ইচ্ছে হলো গেলাম কিংবা ইচ্ছে হলো না তো বিয়ে বাড়িতে বোরহানী খাবার লোভে ট্যুর ক্যানসেল করলাম।
লিয়ানা : স্যার আমি দুঃখিত, আমার ভুল হয়ে গেছে। দুঃখিত এবং লজ্জিত।
জেকে : ওকে ওকে। ইট্‌স অলরাইট। শুনুন, শুক্রবার ঠিক সন্ধ্যায় জাহিদ সাহেবের বাড়িতে আমার গাড়ি পৌঁছুবে। সেই গাড়িতে আমার ফ্যামিলির সাথে আপনিও থাকবেন। আপনার দায়িত্ব, প্রেজেন্টেশনের সাথে আমার হাতে লেখা একটা চিঠি জাহিদ চৌধুরীর হাতে পৌঁছে দেয়া।
লিয়ানা : ওকে স্যার, আমি মনে করে আপনার কাছ থেকে চিঠি লিখিয়ে নেবো।
জেকে : গুড। নাও ইউ টক লাইক মাই সেক্রেটারী। [উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে] মতিউর সাহেব রেডি?
লিয়ানা : ইয়েস স্যার।
জেকে : আমি বোর্ডরুম থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে চাই। নো ফোন কল, নো পার্সোনাল মিটিং, নাথিং ইমার্জেন্সি।

[জেকে বেরিয়ে যাবেন, এইখান খেকে টাইটেল শুরু হবে]

দৃশ্য: তিন
জেকে’র বাসা

[জেকে'র স্ত্রী আসমা খুব মনযোগ দিয়ে কোন বই বা ম্যাগাজিন পড়ছেন। তার মেয়ে অরিত্রি কিছুক্ষণ আশপাশে

ঘুরঘুর করে মনযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে শেষে সরাসরি কথা বলে উঠবে]

অরিত্রি : মা, বাবা তো এখনো আসলো না।
মা : হু
অরিত্রি : চারটায় আসার কথা ছিলো
মা : ও
অরিত্রি : এখন বাজছে পাঁচটা পঁচিশ।
মা : আচ্ছা।
অরিত্রি : আচ্ছা মানে? ওহ্‌ মা, তুমি মুখ থেকে বইটা সরাবে?
মা : বই সরাতে হবে কেন? আমি তো তোর কথা শুনছি। প্রতিটা কথায় সাড়া দিচ্ছি...
অরিত্রি : ডিসগাস্টিং! মা, বাবার ফেরার কথা ছিলো চারটায়, এখন বাজছে পাঁচটা পঁচিশ। আমি অলরেডি একঘন্টা পঁচিশ মিনিট লেট।
মা : তো?
অরিত্রি : তো মানে? বাবার আজকে আমার সাথে আমার কলেজে যাবার কথা! বাবা কথা দিয়েছেন। আমার টিচাররা ওয়েট করছেন, গর্ভনিং বডির মেম্বাররা ওয়েট করছেন। তাদের সাথে বাবার মিটিং!
মা : সেখানে কি সব স্টুডেন্টেরই বাবাদের যাবার কথা?
অরিত্রি : মা, তুমি ভালো করেই জানো, সব স্টুডেন্টদের জেকে'র মতো বাবা নেই।
মা : বাহ্‌, সুন্দর বলেছিস তো! জেকে'র মতো বাবা... আচ্ছা, তোর কী মনে হয়, সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে কালে-ভদ্রে যে মানুষটাকে দেখতে পাওয়া যায়, যাকে সবাই জেকে বলে চেনে, জানে, মানে; সে কি আসলেই

তোর বাবা?
অরিত্রি : মা! কী বলছো এসব...?
মা : ভুল বলছি না রে মা, খুব একটা ভুল বলছি না। লোকটা আগে মানুষ ছিলো। এখন আর মানুষই নেই, বাবা হবে কীভাবে! সে একটা যন্ত্র... একটা টাকা বানানোর মেশিন। মেশিনের মতো টাকা বানানোর একঘেয়ে নেশার ঘোরে লোকটা কখন জামশেদ থেকে জেকে হয়ে গেল, আমিই এমনকি টের পেলাম না। নাও জেকে ইজ আ ব্র্যান্ড নেইম!
অরিত্রি : মা, আমি মানে... আই’ম স্যরি, মা।
মা : নো নো, বেবি, ডোন্ট ফিল স্যরি। ইটস অল রাইট। অ্যান্ড ইটস অল ইন দ্য গেম। এতদিন আমি অভিযোগ করে করে ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছি, এবার তুমি শুরু করেছো। তাও ভালো। তোর তো তবু অভিযোগ শোনার আমি আছি, আমার কে আছে, বল?

[অরিত্রি কিছুক্ষণ নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকবে, তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে। খানিক পরে নিচে থেকে গাড়ি স্টার্ট নেয়া এবং ছেড়ে চলে যাওয়ার আওয়াজ পাওয়া যাবে। তিনি পর্দা উঠিয়ে বাইরে তাকাবেন, তারপর চিন্তিত হয়ে মোবাইলে জেকে’র নাম্বার ডায়াল করবেন। ফোন বন্ধ পাওয়া যাবে। তিনি একটু বিরক্ত হবেন]



দৃশ্য: চার / রাত
জেকে’র অফিস

[অফিস ফ্লোর প্রায় ফাঁকা, লিয়ানা কেবল ফ্রন্ট ডেস্কে বসে আছে। অরিত্রি অতি দ্রুত পায়ে হেঁটে ভেতরে ঢুকবে এবং জেকের চেম্বারের দিকে যেতে থাকবে, লিয়ানা উঠে দাঁড়িয়ে তার সাথে কথা বলবে]

লিয়ানা : স্লামালেকুম ম্যাডাম। স্যার তো চেম্বারে নেই।
অরিত্রি : চেম্বারে নেই তো কোথায় আছে?
লিয়ানা : স্যার বোর্ডরুমে। খুব জরুরী মিটিং চলছে।
অরিত্রি : ডাকুন। আমার কথা বলুন। ইট’স মাচ মোর ইম্পর্টেন্ট দ্যান হিজ সো কল্ড মিটিং।
লিয়ানা : স্যরি ম্যাডাম, তাঁকে এখন ডাকা যাবে না। স্যার বলে দিয়েছেন, কোন অবস্থাতেই যেন তাকে ডাকা না হয়। নো ফোন কল, নো পার্সোনাল মিটিং, নট ইভেন ইমার্জেন্সি।

[অরিত্রি গ্রাহ্য না করে ভেতরে যেতে উদ্যত হতেই লিয়ানা তার সামনে এসে পথ রোধ করে দাঁড়াবে]

লিয়ানা : আমাকে আমার ডিউটি করতে দিন, প্লিজ। স্যারের অর্ডার...
অরিত্রি : টু হেল উইথ ইওর অর্ডার অ্যান্ড টু হেল উইথ ইওর ডিউটি!

[অরিত্রি লিয়ানাকে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে যাবে]



দৃশ্য: পাঁচ/ রাত
বোর্ডরুম


[জেকে বসে মিটিং করছেন, তার চারপাশে নানান রকম ফাইল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অরিত্রি বেশ শব্দ করে ভেতরে ঢুকতেই সবাই চমকে তাকাবে, অরিত্রিকে দেখে তারা উঠে দাঁড়াবে নাকি বসেই থাকবে সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে মাঝামাঝি একটা অবস্থায় আঁটকে থাকবে, সবার চেহারায় অস্বস্তি, জেকের চেহারায় চূড়ান্ত রকমের বিরক্তি]

জেকে : সে কি! তুমি এখানে কী করছো? ...লিয়ানা-
অরিত্রি : লিয়ানা মানে তোমার পিএস তো? শি ইজ ফাইন। ওয়েল ম্যানার্ড অ্যান্ড হাইলি কনশাস অ্যাবাউট হার জব। ওবিডিয়েন্ট অ্যান্ড ডিউটিফুল। ...অ্যান্ড ইউ গাইজ অলসো।
জেকে : হোয়াট ননসেন্স! সংযত হও। বেটার ইউ গো টু মাই চেম্বার, অ্যান্ড ওয়েট দেয়ার। আমি তোমার সাথে পরে কথা বলছি।
অরিত্রি : না। পরে নয়, এখনই। তোমার সাথে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিলো ঠিক চারটায়। এখন বাজছে নিয়ার অ্যাবাউট সেভেন। দেন অফকোর্স আই’ম দ্য ফার্স্ট প্রায়োরিটি। আর আপনাদের ব্যাপারটা কী? সাতটা বাজতে চললো, আপনারা বাসায় যাবেন না? বাবার নাহয় স্ত্রী-সন্তান-ঘর-সংসার নেই, আপনাদেরও কি নেই?
জেকে : অরিত্রি! বিহেভ ইওরসেলফ। ইউ আর নো লংগার আ কিড। অ্যান্ড ইউ আর টকিং ইনসাইড মাই অফিস। আমার স্টাফদের সাথে বেয়াদবী করবার কোন অধিকার তোমার নেই। এটুকু বিবেচনার মতো বয়স তোমার নিশ্চয়ই হয়েছে।

[স্টাফরা জেকের অনুমতির অপেক্ষা না করেই ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে, অরিত্রি কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থেকে এক পর্যায়ে বসে পড়বে। তাকে দেখে মনে হবে সে কিছুটা হতবুদ্ধি, কিছুটা অনুতপ্ত]

অরিত্রি : আই অ্যাম স্যরি বাবা, আমার ভুল হয়ে গেছে।
জেকে : [কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে, যেন অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিলেন এভাবে বলবেন] ওকে, ইট’স অলরাইট।
অরিত্রি : নো, ইট’স নট অলরাইট। আমার এরকম উদ্ভট আচরণ করা উচিৎ হয়নি। আমি খুবই জঘন্য আচরণ করেছি। ...তুমি আংকলদের ডাকো, আমি তাদের স্যরি বলবো...
জেকে : আচ্ছা ঠিক আছে, লাগবে না সেসব। ওনারা তোমাকে চেনেন, জানেন, বোঝেন। কিচ্ছু মনে করবেন না। ...তাছাড়া দোষ আমারও ছিলো। আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম তোমার সাথে কলেজে যাবো। আই’ভ্‌ ব্রোকেন মাই কমিটমেন্ট, যেটা আমি কখনো করি না! সো, আই অ্যাম অলসো স্যরি, বাবাই!
অরিত্রি : ঠিক তো? ...তাহলে অত জোরে ধমক দিলে কেন? আমি যদি কেঁদে ফেলতাম? তাহলে কি তোমারও কান্না পেতো না?

[বলতে বলতে সে সত্যিই কেঁদে ফেলবে, জেকে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উঠে দাঁড়াবেন]

জেকে : আরে আরে কী মুশকিল! এসব কী শুরু করলি...। আচ্ছা বাবা, বলছি তো আমি স্যরি... এবার কান্না থামা...
অরিত্রি : না, থামাবো না। তোমার কিচ্ছু মনে থাকে না। তোমার বাবাই সোনার কান্না থামাতে গেলে আইসক্রিম লাগে!
জেকে : ওহ্‌ ড্যাম ইট..! লিয়ানা- লিয়ানা...

[লিয়ানা এসে ঢুকবে]

: আইসক্রিম। আমার মেয়ে আইসক্রিম খাবে।

লিয়ানা : নিশ্চয়ই স্যার। আমি এক্ষুণি ব্যবস্থা করছি। কোনটা আনবো ম্যাডাম, মানে আপনার কোন চয়েস...?
জেকে : তাই তো, তোর জানি কোনটা বেশি পছন্দ...
অরিত্রি : থাক, তোমাকে আর মনে করতে হবে না...
লিয়ানা : ওকে ম্যাডাম, আমি দেখছি।
জেকে : আচ্ছা লিয়ানা, আমরা তো ফুড প্রোডাক্ট-এরও ব্যবসা করি, তাহলে আমাদের ব্র্যান্ডের কোনো আইসক্রিম নেই কেন?
অরিত্রি : ওহ্‌ গড, বাবা তুমি ব্যবসা ছাড়া একটা কিছুও ভাবতে পারো না, তাই না? আমি একটা আইসক্রিম খেতে চেয়েছি, তাতেও তোমার ব্যবসা বাড়ানোর চিন্তা মাথায় এলো?

[লিয়ানা নিঃশব্দে বেরিয়ে চলে যাবে, জেকে জোরে হেসে উঠবেন, প্রাণখোলা হাসি]

জেকে : বাবাই শোন্‌, আমার ব্যবসার এখন যে কারেন্ট সিচুয়েশন, তাতে করে আমি যদি এই মুহূর্তে সব স্টপ করে দিয়ে শুধু তাকিয়ে থাকি, তাতেই এটা বছর খানেকের মধ্যে দ্বিগুণ হয়ে যাবে। কিন্তু আমি যদি শুধু ঐ তাকিয়ে থাকাটা ছেড়ে দিই, দেখবি এক মাসের মধ্যেই সব হাপিস হয়ে যাবে।
অরিত্রি : তুমি ব্যবসাটা খুব ভালো বোঝো, তাই না বাবা?
জেকে : ইয়েস মাই বেবি! অ্যান্ড আই’ম প্রাউড টু বি আ রিয়েল বিজনেসম্যান।
অরিত্রি : ব্যবসার মতো আর কিছুই কি তোমাকে টানে না?
জেকে : কেন টানবে না, এই যেমন ধর... মানে...
অরিত্রি : বাবা, তুমি আমার সম্পর্কে কতটুকু জানো?
জেকে : তোর সম্পর্কে জানবো মানে? তোর সম্পর্কে আবার জানা না জানার কী আছে?
অরিত্রি : এই যেমন, আমার কী ভালো লাগে, মন্দ লাগে, আমার বন্ধু কারা, আমি কোন ক্লাসে, কোন কলেজে পড়ি... আমার বয়স এখন কত চলছে...?

[জেকে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে যাবেন, তাকে দেখে মনে হবে তিনি গভীর চিন্তায় পড়ে গেছেন। বোঝা যাবে মেয়ে যেসব অনুযোগ করছে তার কোনটাই তিনি খণ্ডাতে পারছেন না। তাঁকে বেশ অসহায় দেখাবে]

অরিত্রি : বাবা, আমার জন্মদিনটা কি তোমার মনে আছে?

[জেকে নিরুত্তর]

অরিত্রি : আজ কত তারিখ তা কি তোমার মনে আছে, বাবা?
জেকে : আজ মঙ্গলবার, ১৪ জুলাই। ঠিক বললাম?
অরিত্রি : হ্যাঁ ঠিক বলেছো। কিন্তু এই প্রশ্নটা কেন করলাম, সেটা তোমার এখনো মনে পড়লো না। ... কাল পনেরোই জুলাই, মা’র জন্মদিন। বহুদিন তুমি মধ্যরাতে মাকে উইশ করে চমকে দাওনি।

[জেকে করুণ চোখে তাকিয়ে থাকবেন, কিছু একটা বলতে যাবেন, পারবেন না। তাঁর গলা ধরে আসবে, চেহারায় অপরাধবোধ জেগে উঠবে। তিনি অসহায় বোধ করবেন, অস্থির-অস্বস্তি বোধ করতে থাকবেন। অরিত্রি কথা বলতেই থাকবে]

অরিত্রি : তুমি ঘড়ি না দেখে পৃথিবীর যেকোন প্রান্তের সময় বলে দিতে পারো, প্রায় সবগুলো শহরের শেয়ার বাজারে তোমার টাকা খাটে, ডলার-পাউন্ড-ইয়েনের বাজার-দর কষতে তোমার ভুল হয় না, অথচ তোমার মেয়ের বয়স কত, তুমি জানো না। তোমার স্ত্রীর জন্ম-তারিখ তোমার মনে থাকে না। ...কবে তুমি আমাদের কাছ থেকে এতটা দূরে চলে গেলে, বাবা? তুমি কি জানো, মার এখন সন্দেহ হয়, তুমি বুঝি আর মানুষ নেই। একটা যন্ত্রে পরিণত হয়েছো। টাকা বানানোর যন্ত্র। তোমার ব্র্যান্ড নেম নাকি "জেকে", পারহ্যাপস্‌ দ্য বেস্ট ব্র্যান্ড অব দ্য কান্ট্রি! ... তুমি যন্ত্র-জীবন মেনে নিতে পারো বাবা, আমরা পারছিনা। প্লিজ ফিরে এসো বাবা, উই নিড ইউ। ফর গডস সেক, বিলিভ আস, উই লাভ ইউ। অ্যান্ড উই রিয়েলি ডু কেয়ার!

[জেকে মাথায় হাত দিয়ে চুপচাপ বসে আছেন, তার মাথা নিচু, চোখ বন্ধ। অরিত্রি নিঃশব্দে বের হয়ে চলে যাবে, জেকে খেয়াল করবেন না। লিয়ানা প্রবেশ করবেন, হাতে আইসক্রিম]

লিয়ানা : সেকি, ম্যাডাম কোথায়, স্যার?
জেকে : [মাথা নিচু অবস্থাতেই] বোধ হয় চলে গেছে।
লিয়ানা : কিন্তু স্যার আইসক্রিম... মানে আমি কি খুব বেশি দেরি করে ফেলেছি?
জেকে : ইটস অলরাইট লিয়ানা। দেরি আপনার নয়, দেরি হয়েছে আসলে আমার।... আপনি এক কাজ করুন, বাসায় চলে যান। আর হ্যাঁ, বাসায় যাবার আগে একটা মেইল পাঠিয়ে দিয়ে যান। আমি প্যারিস যাচ্ছিনা।
লিয়ানা : স্যার...?

[জেকে লিয়ানার অবাক চেহারার সামনে দিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে চলে যাবেন]




দৃশ্য: ছয় / দিন
জেকে’র বাসা থেকে রাস্তা (গাড়ির ভেতর)

[জেকে'র বাড়ির গাড়ি বারান্দায় একটা জিপ দাঁড়িয়ে, সেই গাড়িতে হালকা কয়েকটা লাগেজ, যেমন ফ্রুট বাস্কেট, বড় ফ্লাস্ক, হট-পট এরকম কিছু সরঞ্জাম তোলা হচ্ছে। গাড়িতে এসে উঠবেন জেকে, আসমা, অরিত্রি এবং লিয়ানা। সবার পোষাক-আষাক এবং অভিব্যক্তিতে বেড়াতে যাবার মুড বোঝা যাবে। গাড়ি বেরিয়ে আসবে, তারপর হাইওয়ে ধরে চলতে থাকবে। কার-স্টিরিওতে গান বাজতে থাকবে- "হঠাৎ যদি আমি থেমে যেতাম"। গানটা কার, শিল্পী কে, কার কম্পোজিশন এইসব নিয়ে জেকে, অরিত্রি আর লিয়ানা আলোচনা করতে থাকবে। গাড়ি একসময় একটা ট্যুরিস্ট স্পটে এসে থামবে। সবাই গাড়ি থেকে নেমে আসবে]


দৃশ্য: সাত/ দিন
পার্ক

[জেকে মেয়েকে নিয়ে জায়গাটা ঘুরে ফিরে দেখতে বেরিয়েছেন, আসমা আর লিয়ানা বসে গল্প করছে]

আসমা : আচ্ছা লিয়ানা, তুমি আমাকে ম্যাডাম ম্যাডাম করছো কেন? তুমি জেকে’র স্টাফ, তাকে স্যার বলবে, ঠিক আছে। আমার তো আর স্টাফ নও।
লিয়ানা : তাহলে কী বলে ডাকবো?
আসমা : তোমার যা ইচ্ছা। ভাবী ডাকতে পারো।
লিয়ানা : ভাবী না ডেকে বরং আপা ডাকি?
আসমা : ডাকতে পারো। চাইলে আন্টিও ডাকতে পারো, আমার কোন আপত্তি নেই। আর তাছাড়া আমার মেয়েই প্রায় তোমার বয়েসী...চুল সাদা হতে ধরেছে, বুড়ো তো হয়েই গেলাম, আর কত?
লিয়ানা : জন্মদিনে এসব ভাবতে নেই, ম্যাডাম....ওহ্‌ না আপা!
আসমা : একটা ব্যাপার কি খেয়াল করেছো লিয়ানা, জন্মদিনেই সাধারণত এই ধরণের ভাবনাগুলো বেশি বেশি মাথায় আসে...
লিয়ানা : এই জন্যে আমি জন্মদিন কখনো সেলিব্রেটই করি না।
আসমা : সেকি! আমার কথা আলাদা, আমার বয়স হয়েছে.... কিন্তু তুমি কেন এই বয়সে... নো নো ইয়াং লেডি, বৈরাগ্য-ভাবনার বয়স তো এটা নয়। কাম অন চিয়ার আপ! লিভ দ্য লাইফ উইথ অল ইটস কালার।
লিয়ানা : আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন। আপনার সাথে আমার আরো আগে আলাপ হওয়া উচিত ছিলো।
আসমা : কেন নয়? আমি কথা বলার মানুষই পাইনা! তোমার স্যার তো সারাদিন তোমাদের সাথেই থাকেন। আর অরিত্রি? একান্ত বাধ্য না হলে সে আমার কাছেও ঘেঁষে না। ...আমি তাই সারাদিন পড়ি। পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে এক সময় নিজের সাথেই কথা বলতে শুরু করি। আশপাশে কেউ থাকলে ভাববে এ কি পাগল হয়ে গেল নাকি?... কিন্তু জানো, আশপাশে কেউ থাকেই না!
লিয়ানা : আমি বলি কি, স্যারকে নিয়ে আপনি ক’দিন ঘুরে আসেন। স্যার তো দিন কয়েক পরে প্যারিস যাচ্ছেন, আপনি আর অরিত্রিও সাথে চলে যান...
আসমা : কী লাভ? সে থাকবে সারাদিন তার বিজনেস মিটিং নিয়ে, আমরা হোটেলের রুমে বসে প্যারিসের ভিউকার্ড দেখবো, রোডম্যাপ মুখস্থ করবো!

[লিয়ানা মাথা নিচু করে বসে থাকবে]

আসমা : আমার বাবাকে তুমি দ্যাখোনি। তিনি এখন কানাডায়, আমার বড়ভাইয়ের ওখানে থাকেন। বাবা সবসময় একটা কথা বলতেন, বি সামবডি। কিছু একটা হও। বাবার সাথে জামশেদের প্রথম যেদিন দেখা হলো, বাবা প্রশ্ন করলেন- তোমার পরিচয়?’ জামশেদ বললো- আমি জামশেদ খান, এম. কম. পাশ করেছি। বাবা যে কী খুশি হলেন, বললেন- অনেকদিন পর একজন মানুষ পেলাম, যে "আমার" নয়, "আমি" বলে নিজের পরিচয় দেয়
লিয়ানা : সত্যিই তো, আমার একশ' বিঘা জমি আছে- এই পরিচয়ের চেয়ে আমি এমএ পাশ করেছি কিংবা আমি এই কাজটা শিখেছি বা এটা করতে জানি -এই পরিচয়টা কি অনেক বেশি গৌরবজনক নয়?
আসমা : অথচ সেই জামশেদ খান কীভাবে যেন জেকে হয়ে গেল! এখন তার পরিচয়- জেকে ইজ ওয়ান অব দ্য বিগেস্ট ক্যাপিটালিস্ট ইন দিস কান্ট্রি!

[অরিত্রিকে দেখা যাবে এদিকে আসছে, তার হাতে নানা বর্ণের বেশ কিছু ফুল। বোঝা যাবে, পার্কেরই কোনখান থেকে সংগ্রহ করা, তাজা ফুল। সে ফুলগুলো মা'র দিকে ছুড়ে দিবে]

অরিত্রি : এই নাও মা, তোমার জন্মদিনের উপহার। খুশি তো? এটা কিন্তু বাবার দেয়া।
মা : তোর বাবা কখনো বাজারের কেনা ফুল আমার হাতে দেয়নি। সব সময় এখান ওখান থেকে ফুল ছিঁড়ে নিয়ে এসে দিতো।
অরিত্রি : তুমি সেটা সাপোর্ট করতে? আমার তো ফুল ছিঁড়তে ভীষণ মায়া লাগে, কষ্ট হয়।
লিয়ানা : আমারও তাই। আমার কাছে মনে হয়, আমি যত সুন্দর করেই সাজাই না কেন, ফুলগুলো গাছে যত সুন্দর ছিলো, ততটা সুন্দর দেখাবে না।
আসমা : একবার কী হয়েছে জানিস, আমার একটা গোলাপ দেখে এত ভালো লাগলো, জেদ ধরে বসলাম সেটা আমার চাই'ই চাই। জামশেদ বেচারা আর কী করে, অন্য লোকের বাগান, মালি দারোয়ান কেউ নাই দেখে বীরের মতোন ঢুকে পড়লো ভেতরে। তা ঢুকেছিস ভালো কথা, গেট দিয়ে ঢোক। না তিনি ঢুকলেন দেয়াল টপকে।
অরিত্রি : ওয়াও! হাও রোমান্টিক! তারপর?
আসমা : তারপর আবার কী? বাগানের ভিতর ছেড়ে রাখা কুকুর ছিলো। এমন তাড়া করলো, বেচারা হাঁচড়ে পাছড়ে দেয়াল টপকে... ট্রাউজার ছিঁড়ে হাত পা ছিলে সে এক বেকায়দা অবস্থা!

[তিনজনেই গলা ছেড়ে হেসে উঠবে]


দৃশ্য: আট / দিন
পার্ক

[জেকে বসে আছেন একটা বেঞ্চের ওপর। তার পাশের জায়গাটা খালি। তিনি এদিক ওদিক তাকিয়ে বেঞ্চের ওপর শুয়ে পড়বার ভঙ্গি করতেই চমকে উঠবেন, একটা ফুটফুটে সুন্দর বাচ্চা মেয়ে বসে আছে। এই একটু আগেই সেখানে কেউ ছিলো না, ফলে জেকের বিষ্ময়ভাব সহজে কাটতে চাইবেনা। তিনি স্বাভাবিক হতে চাইবেন, মেয়েটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্রয়ের হাসি হাসবেন। মেয়েটাও তার দিকে তাকিয়ে হাসবে, তার ফোকলা মাড়ি বেরিয়ে পড়বে। তা দেখে জেকে প্রাণখুলে হেসে উঠবেন]

জেকে : কী নাম তোমার?
মেয়ে : উর্মী।
জেকে : বাহ্‌! ভারী সুন্দর নাম।
মেয়ে : [একই ভঙ্গিতে] কী নাম তোমার?
জেকে : [বিস্মিত] জামশেদ। আমার নাম জামশেদ।
মেয়ে : [একই ভঙ্গিতে] ভারী পচা নাম।
জেকে : আরে এ মেয়ে বলে কি! ভেরি স্ট্রেঞ্জ!
মেয়ে : ভেরি স্ট্রেঞ্জ!

[জেকে বেশে জোরে হেসে উঠবেন। হাসতে হাসতেই লক্ষ্য করবেন, মেয়েটার হাতে একটা বল। বলটা একটু আগেদেখেছেন বলে মনে করতে পারবেন না। তিনি একটু চিন্তিত হবেন। মেয়েটা বলটা নিয়ে খেলতে থাকবে, তিনি বলটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সম্মোহিতের মতো হয়ে যাবেন। আস্তে আস্তে তার মুখ থেকে হাসি মুছে যাবে, তিনি কিছুটা চিন্তিত ও ভীত বোধ করতে থাকবেন। তার বুকে হঠাৎ চিনচিনে ব্যথা করতে থাকবে। মেয়েটা একইভাবে বল নিয়ে খেলছে, তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। তিনি সে দৃষ্টি সহ্য করতে পারছেন না, আবার চোখ ফিরিয়ে নিতেও পারছেন না। তার কানে বিভিন্ন রকমের কোলাহল অস্পষ্ট থেকে ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে, যেন এক ধরণের হ্যালুসিনেশন। তিনি বুকের কাছটা খামচে ধরে একপাশে কাত হয়ে পড়বেন। তার কানে সারাদিনের ব্যস্ততা, গাড়ির হর্ণ, অনেক মানুষের চিৎকার, গ্রামের একদল ছেলেমেয়ের দাড়িয়া-বান্ধা বা ফুটবল খেলার সময়কার চিৎকার-কোলাহল, পরক্ষণেই আবার টাইপ-রাইটারের বা কম্পিউটারের কী বোর্ডের খটাখট শব্দ... ইত্যাদি নানা ধরণের স্পষ্ট-অস্পষ্ট আওয়াজ ধ্বণি-প্রতিধ্বণি সৃষ্টি করবে। তিনি হাঁ করে দম নিতে নিতে হাসফাস করতে থাকবেন। ধীরে ধীরে বেঞ্চে শরীর এলিয়ে দিতেই বাচ্চাটা ম্যাজিকের মতো মিলিয়ে যাবে। ফ্রেম ডিজলভ্‌ড হয়ে পরের দৃশ্যে চলে যাবে]


দৃশ্য: নয় / দিন
বাসের ভেতর

[জেকে বসে আছেন একটা চলন্ত বাসের সিটে। জানালার কাঁচে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে গেছিলেন, গাইড তার ঘুম ভাঙ্গাচ্ছে। তিনি চোখ মেলে নিজেকে বাসের ভেতর দেখে ভীষণ অবাক হবেন। গাইডের প্রশ্ন তার কাছে আস্তে আস্তে স্পষ্ট হবে]

গাইড : স্যার কোথায় নামবেন বললেন না?
জেকে : আমি কোথায়?
গাইড : লে বাবা, ঘুমের চোটে দুনিয়া আন্ধার! ... আমরা স্যার নবীনগরের কাছে। আপনি কোথায় নামবেন?
জেকে : তোমার বাস থামবে কোথায়?
গাইড : টেকনিক্যাল মোড়ে। তারপরে টাউন সার্ভিস যাবে মতিঝিল পর্যন্ত। আপনি কতদূর যাবেন?
জেকে : অ্যাঁ? হ্যাঁ হ্যাঁ মতিঝিল পর্যন্ত যাবো।
গাইড : তাহলে বাস থেকে নেমে কাউন্টারে বসবেন, ওইখান থেকে টাউন সার্ভিসের বাস...
জেকে : না ঠিক আছে, আমাকে নিতে গাড়ি আসবে।
গাইড : তাইলে তো ভালই।

দৃশ্য: দশ / দিন
বাসস্ট্যান্ড

[জেকে বাস থেকে নেমে তার মোবাইল বের করে ডায়াল করবেন। কানে ধরে থাকবেন, কিন্তু কোনও ডায়াল টোন শোনা যাবে না। বারবার তিনি চেষ্টা করতে থাকবেন, নেটওয়ার্ক প্রবলেম-এর যান্ত্রিক শব্দ শোনা যাবে। তিনি বিরক্ত হয়ে একটা ট্যাক্সি ডেকে তাতে উঠে বসবেন, ট্যাক্সি চলতে শুরু করবে]

দৃশ্য: এগারো / দিন
মতিঝিল

[জেকে একটা বহুতল ভবনের সামনে ট্যাক্সি থেকে নামবেন, তার চোখে মুখে অবসাদ। তিনি নিজের অফিস বিল্ডিংটা নিচে থেকে ওপর পর্যন্ত একবার তাকিয়ে দেখবেন, তারপর লিফটের দিকে এগিয়ে যাবেন]

দৃশ্য: বারো / দিন
লিফটের সামনে

[জেকে লিফট থেকে নেমে তার অফিসের দিকে চলে যাবেন]


দৃশ্য: তেরো / দিন
অফিসের হলরুম

[প্রথম দৃশের অফিসে তিনি প্রবেশ করেছেন, স্বভাবসুলভ হেঁটে চলেছেন নিজের চেম্বারের দিকে। কেউ তাকে লক্ষ্য করছে না বা সালাম দিচ্ছে না, তার উপসি'তি যেন কেউ টেরই পায়নি। তিনি থমকে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা লক্ষ্য করবেন, তারপর সোজা চেম্বারের কাছে চলে যেতেই লিয়ানা তার সামনে এসে দাঁড়াবেন]

লিয়ানা : এক্সকিউজ মি স্যার, আপনি কি কাউকে খুঁজছেন?
জেকে : হোয়াট ননসেন্স! আমি কাউকে খুঁজবো কেন?
লিয়ানা : মানে আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি কাউকে খুঁজছেন। হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ স্যার?
জেকে : হোয়াট ক্যান ইউ ডু ফর মি? নাইস জোক! হোয়াট হ্যাপেন্ড টু ইউ অল? আপনারা কি আমাকে চিনতে পারছেন না?
লিয়ানা : কী আশ্চর্য! আপনাকে আগে দেখেছি বলে তো মনে হচ্ছে না। স্যার ডোন্ট টেক ইট বদারেশন, আপনাকে কি আমাদের চেনার কথা?
জেকে : হাউ ডেয়ার ইউ স্পিক সো! আমার সঙ্গে এই রসিকতার মানে কী?
লিয়ানা : স্যার কোথাও নিশ্চয়ই একটা ভুল হচ্ছে। আমি মোটেই আপনার সাথে রসিকতা করছি না। আপনি কি স্যারের সাথে দেখা করতে এসেছেন? স্যার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া কারো সাথে দেখা করেন না।
জেকে : ওহ্‌ স্টপ ইট! জাস্ট শাট আপ!!

[অন্যান্য টেবিল থেকে সবাই এদিকে এসে গোল হয়ে দাঁড়াবে, জেকে অসহায় বোধ করবেন]

জেকে : সমস্যাটা কী? আপনারা এরকম আচরণ করছেন কেন? আপনারা কি আমাকে চিনতে পারছেন না?
জনৈক : সমস্যাটা কী, লিয়ানা? কে এই লোক?
জেকে : কে এই লোক মানে? সাদেক সাহেব, আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি জেকে, জামশেদ খান, আপনাদের এমডি।
সাদেক : আপনি জেকে, জামশেদ খান; বেশ ভালো। তা বুঝলাম আপনি জামশেদ খান ওরফে জেকে সাহেব। আপনি আমাদের এমডি- এটাতো বুঝলাম না।

[জেকে প্রচন্ড আক্রোশে সাদেক সাহেবের কলার চেপে ধরবেন। সবাই হতভম্ব হয়ে যাবে। সাদেক অগ্নিদৃষ্টিতে জেকের দিকে তাকিয়ে থাকবে, তারপর আস্তে আস্তে হাত উঠিয়ে জেকের হাতদুটো চেপে ধরবে, তারপর কলার থেকে ঝটকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিবেন]

সাদেক : হাতদুটো পকেটে রাখুন মিস্টার! আপনার মুখ যা দাবী করছে, হাত বলছে তার উল্টো কথা। নিজেকে ইসলাম গ্রুপের এমডি দাবী করছেন, অথচ আচরণ করছেন গুণ্ডা-মাস্তানদের মতো!

[জেকে নার্ভাস বোধ করবেন, ধপ করে বসে পড়বেন পাশের একটা চেয়ারে। কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াবেন]

জেকে : ওকে, ওকে... আই অ্যাম স্যরি! বাট লেট মি থিংক এগেইন। আজ ফার্স্ট এপ্রিল নাকি? আপনারা আমার সাথে রসিকতা করছেন নাতো?
লিয়ানা : দেখুন, আপনি যদি আমাদের এমডি হন, তো আজ ফার্স্ট এপ্রিল হতেও পারে; আর আমরা সবাই আমাদের স্বঘোষিত এমডি’র সাথে রসিকতা করছি এটাও সত্যি হতে পারে!

[জেকে ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে যাবেন, তখন হঠাৎ এমডি’র চেম্বারের দরজায় তার দৃষ্টি যাবে। সেখানে লেখা- Noor-Ul Islam, Chairman, Islam Group। জেকে লেখাটা বিড়বিড় করে পড়বেন, তারপর স্বগতোক্তির মতো বলতে থাকবেন]

জেকে : নুরুল ইসলাম তো আমার শ্বশুরের নাম! তিনি তো...
লিয়ানা : ইয়েস মিস্টার, কী যেন?.. ও হ্যাঁ, জেকে। তো মিস্টার জেকে, নুরুল ইসলাম সাহেব আমাদের, মানে ইসলাম গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং আমাদের জানা মতে জামশেদ খান বা জেকে নামে তাঁর কোন জামাই নাই। তাঁর একটাই মেয়ে, যিনি তাঁর স্বামীর সাথে কানাডায় থাকেন। সেই ভদ্রলোক জন্মসূত্রে কানাডিয়ান।
জেকে : তার মানে?
সাদেক : মানে সোজা। ইউ হ্যাভ নো বিজনেস হিয়ার এনিমোর। দরজা কোন দিকে আশা করি সেটাও ভুলে বসেন নি?
জেকে : [কিছুক্ষণ নিরব অর্থহীন দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকিয়ে] আমি ইসলাম সাহেব, আই মিন মি. চেয়ারম্যান-এর সাথে একবার দেখা করতে পারি?
লিয়ানা : জ্বি না, পারেন না। তিনি অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া কারো সাথে দেখা করেন না। তাছাড়া তিনি এখন অফিসে নেইও। আপনি কি তাহলে এবার...

[জেকে মাথা নিচু করে অসহায় ভঙ্গিতে বেরিয়ে যাবেন, যেতে যেতে নিজের মনেই গজগজ করতে থাকবেন- সব ষড়যন্ত্র! আমি দেখে নেবো সবাইকে। এত বড় অপমান? পেছন থেকে সবাই বিভিন্ন আপত্তিকর মন্তব্য করতে থাকবে, নিজেদের রসিকতায় নিজেরাই হেসে উঠবে হো হো করে]


দৃশ্য: চৌদ্দ / দিন
বাড়ির গেট

[পূর্বে দেখানো জেকে’র বাড়ির গেট-এ ট্যাক্সি দাঁড়াবে, তিনি ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে গেট দিয়ে ঢুকতে যাবেন, দারোয়ান এসে বাধা দিবে]

দারোয়ান : স্যার কই যাইবেন?
জেকে : [অবাক হয়ে দেখবেন, চিনতে পারবেন না] তুমি কে? হু আর ইউ এন্ড হোয়াট্‌স ইয়োর বিজনেস হিয়ার?
দারোয়ান : আমি স্যার ফিরোজ। এই বাড়িতে চাকরি করি স্যার, এই বাড়ির দারোয়ান। কোনও বিজনেস করি না। গেরামে থাকতে অবশ্য বিজনেস করতাম, পান-বিড়ির বিজনেস...
জেকে : তোমাকে আগে দেখেছি বলে তো মনে হচ্ছে না। কতদিন আছো এই বাড়িতে?
দারোয়ান : তা ধরেন স্যার চাইর-পাঁচ বছর তো হইবোই। আমিও আপনেরে কোনদিন দেখি নাই স্যার। আপনি কি স্যারের কেউ হন?
জেকে : হোয়াট ননসেন্স!
দারোয়ান : স্যারে তো বিশ্রাম করতেছেন। এখন তিনি নিচে আসবেন না, তারে ডাকাও যাবে না। আপনের দরকারটা কী, আমারে বলেন, আমি ইন্টারকমে স্যারের সাথে কথা বলায়ে দিতাছি।
জেকে : কী তখন থেকে স্যার স্যার করছো। স্যারটা আবার কে? তোমার স্যার তো আমি।
দারোয়ান : [হেসে ফেলবে] এইটা তো স্যার ঠিকই। কোট টাই পরা যে কোন মানুষই হইল আমরার কাছে স্যার। তয় তেনার কথা আলাদা। তিনি হইলেন আমার অন্নদাতা। এই বাড়ির মালিক, আমারও মালিক।
জেকে : কী! ওহ্‌ শীট। এখানেও সেই একই ব্যাপার! হচ্ছেটা কী আমার সাথে!

[জেকে ভেতরে ঢুকতে যাবেন, দারোয়ান তাকে বাধা দিতে থাকবে, তিনি বাধা অস্বীকার করে ভেতরে ঢুকে যাবেন। দারোয়ান তার পেছনে পেছনে ঢুকবে]

দৃশ্য: পনেরো/ বাড়ির সামনে
দিন

[জেকে ভেতরে যেতে চাচ্ছেন, দারোয়ান কিছুতেই তা দিবে না। এই নিয়ে হৈচৈ শুরু হবে, কোলাহল শুনে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবেন এক ভদ্রলোক]

ভদ্রলোক : কী ব্যাপার, সমস্যা কী, ফিরোজ?
দারোয়ান : স্যার এই লোকে কইতেছে এইটা বলে তার নিজের বাড়ি। আমার মনে কয় মাথায় সমস্যা।
ভদ্রলোক : চুপ করো! তুমি তোমার কাজে যাও, আমি দেখছি।
জেকে : না না, এখানে দেখাদেখির তো কিছু নেই। আমি গত আট বছর ধরে এই বাড়িতে বাস করছি। আজ সকালেও এই বাড়ি থেকে আমি বেরিয়েছি।
ভদ্রলোক : আমি ঠিক বুঝলাম না আপনার কথা। আপনি আট বছর এ বাড়িতে বাস করছেন কীভাবে? আজ সকালে এ বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন মানে? আমি তখন কোথায় ছিলাম? ...এটা আমার বাড়ি। আমার নিজের তৈরি বাড়ি। চৌদ্দ বছর আমি এ বাড়িতে বাস করছি। আমি নিজে চৌদ্দ বছর আগে প্লট কিনে বাড়ি বানিয়েছি। আপনি কী বলছেন এসব?
জেকে : হতে পারে, আপনি যে নিজে এ বাড়ি বানিয়েছেন, আমি অবিশ্বাস করছিনা। তারপর বিক্রি করেছেন... ইনফ্যাক্ট এমনটাই হয়েছে... আমি তো আট বছর আগে বাড়িটা কিনেছি... আমার ঠিকঠাক মনে পড়ছেনা এখন, পারহ্যাপস আপনার কাছ থেকেই কিনেছি...
ভদ্রলোক : আই অ্যাম স্যরি, মিস্টার...
জেকে : জেকে, জামশেদ খান।
ভদ্রলোক : ওকে মিস্টার জামশেদ খান। আই অ্যাম স্যরি টু সে, এ রকম কিছু আদৌ ঘটেনি। তা যদি ঘটতোই, আমার এখানে থাকার তবে যৌক্তিকতা কী?
জেকে : প্লিজ, আপনি বুঝতে চেষ্টা করুন। এটা আমার বাড়ি, নো ডাউট এটা আমার বাড়ি। আমি এ বাড়ির প্রতিটি ঘর দরজা জানালা বারান্দা বেলকনি, অল এভরিথিং চিনি, সবকিছু... আট বছর ধরে চিনি।
ভদ্রলোক : আর এই এলাকার প্রতিটি মানুষ আমাকে চেনে, চৌদ্দ বছর ধরে চেনে। ... যা হোক, আমার লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে। উড ইউ লাইক টু জয়েন মি অর ডিপার্ট? ...ফিরোজ, এভাবে আর কখনো গেট খোলা রাখবে না

[ভদ্রলোক জেকে’র উপস্থিতি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ঘুরে চলে যাবেন। জেকে কিছুক্ষণ ঘৃণার চোখে তাকিয়ে থেকে বেরিয়ে যাবেন]


দৃশ্য: ষোল/ দিন
পার্ক বা নির্জন কোন রাস্তা

[জেকে বসে আছেন, তার বসে থাকার ভঙ্গিটা ভীষণ অসহায় ধরণের। হঠাৎ দেখা যাবে জেকের মেয়ে অরিত্রি অন্য এক ভদ্রলোকের হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে। জেকে চিৎকার করে ডাকতে থাকবেন, কিন্তু অরিত্রি গ্রাহ্য করবে না। বোঝা যাবে, এই নামের সাথে সে পরিচিত নয়। জেকে মোটামুটি দৌড়ে মেয়ের কাছাকাছি হবার চেষ্টা করবেন, ততোক্ষণে তারা গাড়িতে উঠে গেছে। গাড়ি চলা শুরু হতেই জেকে গাড়ির কাছে চলে আসবেন, হাত নেড়ে অরিত্রির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করবেন। ড্রাইভিং সিটে বসা ভদ্রলোক সেটা লক্ষ্য করে অরিত্রিকে দেখাবেন। অরিত্রি জানলার কাঁচ নামিয়ে জেকের দিকে তাকিয়ে বলবে- "আপনি কি আমাকে কিছু বলছেন?" জেকে ভীষণ শক্‌ড হবেন, কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে মাথা নেড়ে না বলবেন। তার সামনে দিয়ে গাড়ি চলে যাবে, তিনি হাত নেড়ে বিদায় জানাবেন। তারপর ফিরে যাবেন আগের জায়গায়]


দৃশ্য: সতের / দিন
পার্ক বা নির্জন কোন রাস্তা

[আগের দৃশ্যের কন্টিনিউয়েশন। জেকে মাথা নিচু করে বসে আছেন। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর আবার মাথা তুলে পাশে তাকাতেই দেখবেন তার ঠিক পাশে তারই একজন ডুপ্লিকেট বসে আছে। সে জেকে’র দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসবে। আমরা এই দ্বিতীয় জেকে'র নাম দিতে পারি জেকে২]

জেকে২ : হাই ফ্রেন্ড, কী অবস্থা? একদম ল্যাজেগোবরে তো? হা হা হা
জেকে : তুমি কে?
জেকে২ : আমি কে- সেটা তোমার না জানলেও চলবে। হোয়াট ইজ ইম্পর্টেন্ট নাও, ইজ টু নো দাইসেল্ফ। তুমি বরং নিজেকে প্রশ্ন করো, তুমি কে?
জেকে : ঠিকই বলেছো। আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না, আমি কে! আমার অফিস, আমার বাড়ি, আমার পরিচিত সকল কনসার্ন আমাকে চিনতে অস্বীকার করছে।
জেকে২ : কী সর্বনাশ! এত বড় ব্যবসায়ী, এত কোটি কোটি টাকার মালিক, মহা পরাক্রমশালী জামশেদ খান ওরফে জেকে আজ পথের ফকির?
জেকে : ফকির তবু আমার চেয়ে ভালো অবস্থায় থাকে। তাদের অন্তত আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে পড়তে হয় না!
জেকে২ : বাহ্‌ ভালো বলেছো তো! আ বেগার মে সিং বিফোর আ পিক-পকেট! হা হা হা
জেকে : কে তুমি? হাউ ডেয়ার ইউ পিঞ্চ মি! কী চাও তুমি আমার কাছে?
জেকে২ : হায়রে কপাল! বড়লোকদের এই এক সমস্যা। হাতি যখন গর্তে পড়ে, তখনও সেখান থেকে বাদশাহী চালেই উঠে আসতে চায়। এবং এই জন্যেই পারেনা। ...তোমার কাছে কী চাইবো আমি? কী আছে দেবার মতো তোমার?
জেকে : ইউ আর রাইট! আই’ভ নট আ সিঙ্গেল পেনি বাট আ বিগ অ্যামাউন্ট টু পে!
জেকে২ : এইজন্যেই জ্ঞানী লোকেরা সব সময় বলেন, ইট ইজ বেটার টু বি সামবডি র‌্যাদার দ্যান টু হ্যাভ মেনি থিংস!
জেকে : ইউ আর স্ক্র্যাচিং মি এগেইন! প্লিজ লেট মি থিংক, আমাকে একটু ভাবতে দাও!
জেকে২ : দ্যাটস ফাইন! ভাবো... ভাবো। সঠিকভাবে ভাবলে নিশ্চয়ই একটা সমাধানে আসতে পারবে। ভাবতে থাকো। এই ফাঁকে আমি বরং একটু ঝিমিয়ে নিই...
জেকে : এক্স মিনিস্টার জাহিদ সাহেব আমার বিশেষ বন্ধু। আগামীকাল তাঁর ছেলের বিয়ে। আমি সেখানে ভিভিআইপি গেস্ট।
জেকে২ : ধ্যাত্তেরি! এই তোমার ভাবনার নমুনা? এই বুদ্ধি দিয়ে তুমি এত টাকা বানালে কী করে? এক্স মিনিস্টারের তোমাকে চেনার গরজটা কোথায়? যাও না, যাও, দারোয়ান দিয়ে বের করে দিবেন, বুঝলে? যেমন দিয়েছে তোমার অফিস এবং বাড়ি। ...ট্রাই টু রিয়ালাইজ, ইউ আর নো মোর দ্য এমডি অব ইসলাম গ্রুপ। তোমার এই পরিচয়টা সম্পূর্ণরূপে ভুলতে না পারলে এই গাড্ডা থেকে বেরুতে পারবেনা বলে রাখলাম।
জেকে : কোথাও একটা ষড়যন্ত্র চলছে। গভীর কোন চক্রান্ত।
জেকে২ : রিয়েলি? আচ্ছা মেনে নিলাম এটা একটা ষড়যন্ত্র, তোমার ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব কেড়ে নিয়ে অনেকেই হয়তো লাভবান হবে; কিন্তু তোমার মেয়ে? তোমার আপন সন্তান?
জেকে : সেটাই তো ভাবছি।
জেকে২ : এমন কি হতে পারে না, সে আসলে তোমার মেয়েই নয়!
জেকে : হতে পারে...
জেকে২ : সুতরাং এই জেকে সাহেবের কোটটা গা থেকে খুলে ফ্যালো। নয়তো সারাজীবন এই গাছতলাতে বসেই কেটে যাবে। পেছনে তাকাও পেছনে...!
জেকে : ইউ আর রাইট। পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, আমার কাছেই মনে হচ্ছে জেকে একটা কাল্পনিক চরিত্র! কিন্তু আমার অস্তিত্ব তো মিথ্যে নয়। লোকে তো আমাকে দেখতে পাচ্ছে, কথা বলছে! এমনকি আমার ক্ষিদেও পাচ্ছে! তারমানে আমি জলজ্যান্ত একটা মানুষ- তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
জেকে২ : রাইট। তুমি জলজ্যান্ত একটা মানুষ...
জেকে : অর্থাৎ কোনও এককালে আমার জন্ম হয়েছিলো মানুষ রূপেই...
জেকে২ : জন্ম যদি হয়ে থাকে, তবে সেই জন্ম পরিচয়ও থাকবে নিশ্চয়ই...?
জেকে : ঠিক বলেছো। আমাকে এমন কোথাও যেতে হবে... এমন কেউ নিশ্চয়ই আছে, যার পক্ষে আমাকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়।
জেকে২ : দ্যাটস ফাইন। ইউ’র বিকামিং র‌্যাশনাল। তোমার উৎসের দিকে যাও। আগে তো নিজের আইডেন্টিটি স্টাবলিশ করো, তারপর অন্য কিছু।
জেকে : সেটা করতে গেলে আমার বাবার কাছে যেতে হবে। একমাত্র বাবাই পারবেন আমাকে চিনতে...। হ্যাঁ, ঠিক তাই করতে হবে...
জেকে২ : ব্যস! এই না হলে জেকে? এই তো মাথা খুলছে! গো অ্যাহেড অ্যান্ড শুট! কাম অন হারি হারি...!
জেকে : কিন্তু বাবার সঙ্গে যোগাযোগটা ঠিক স্বাভাবিক নেই। ভাইদের সাথে সম্পত্তিগত বিরোধ, আট-নয় বছর ধরে কোন যোগাযোগই তো রাখা হয়নি... এতদিন পর...
জেকে২ : কুসন্তান যদ্দপি হয়, কুপিতা কখনো নয়!

[জেকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবেন, প্রতিবিম্ব মিলিয়ে যাবে। জেকে কিছুটা অবাক হবেন, তবে দ্রুত সামলে নিয়ে দৃঢ়প্রত্যয়ী ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াবেন]

দৃশ্য: আঠারো / দিন
বাসের ভিতর

[জেকে বসে আছেন বাসের ভিতর, জানলা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে, সবুজ গাছ-গাছালি ঘেরা গ্রামীণ দৃশ্য। স্ক্রিনে জেকের ছবি ঝাপসা হয়ে আসবে, তার ওপর দিয়ে ফার্স্ট-কাট শটে কিছু ফ্লাশব্যাক দেখা যাবে। একদল গ্রামীণ ছেলেমেয়ে দল বেঁধে নানান রকম খেলাধুলায় ব্যস্ত, গ্রামের কিছু সাধারণ দৃশ্য এসবের ওপর দিয়ে জেকের বাস্তব ছবিটা আবার স্বাভাবিক হয়ে আসবে]

দৃশ্য: ঊনিশ / দিন
গ্রামের বাড়ি

[দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ, জেকে দরজার কড়া নাড়ছেন। বেশ কয়েকবার কড়া নাড়ার পর দরজা খুলে একজন শীর্ণকায় বৃদ্ধ বেরিয়ে আসবেন]

জেকে : স্লামালিকুম।
বৃদ্ধ : ওয়ালাইকুম সালাম। আপনি কারে চান?
জেকে : [অবাক] বাবা, আপনি কী বলছেন? আপনি কি আমাকে চিনতে পারেন নি? আমার নাম জামশেদ।
বৃদ্ধ : আপনি কার কাছে এসছেন?
জেকে : বাবা, আমি জামশেদ, আপনার বড় ছেলে। আপনি আমাকে...
বৃদ্ধ : [নিরব, ভাষাহীণ চোখে তাকিয়ে থাকবেন]
জেকে : আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না বাবা? আমি জামশেদ খান, আপনার বড় ছেলে জামশেদ খান।
বৃদ্ধ : কী বলতেছেন! জামশেদ তো মইরা গেছে, নয় বচ্ছর বয়সে।
জেকে : [হতভম্ব] কী! কী বলছেন আপনি?
বৃদ্ধ : সাপের কামড়ে মরছে। সে তো ধরেন তিরিশ-চল্লিশ বচ্ছর আগেকার কথা

[জেকে কিছুক্ষণ ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে থাকবেন, তার সামনে দাঁড়ানো বৃদ্ধের চেহারা অস্পষ্ট হয়ে যাবে, পৃথিবী কেঁপে উঠবে। তিনি টলতে টলতে পড়ে যাবেন এবং জ্ঞান হারাবেন]

দৃশ্য: বিশ / দিন
ট্যুরিস্ট পার্ক

[দৃশ্য পাঁচ-এর শেষ থেকে শুরু হবে। জেকে পার্কের বেঞ্চিতে বেকায়দা ভঙ্গিতে শুয়ে আছেন। মেয়ে এবং স্ত্রী তাকে ধাক্কা দিয়ে ওঠানোর চেষ্টা করছেন, পাশে দাঁড়িয়ে আছে লিয়ানা। তিনি ঘোর লাগা চোখে সবার দিকে তাকাবেন, অজান্তেই তার হাত চলে যাবে পায়ের কাছে। প্যান্ট গুটিয়ে মোজা সরিয়ে তিনি একটা কালো দাগ বের করবেন]

আসমা : কী ব্যাপার তুমি এরকম মড়ার মতো ঘুমাচ্ছো যে? বেড়াতে এসে যদি ঘুমিয়েই কাটাবে, তো আসার দরকার কী ছিলো?
জেকে : আমার পায়ের এই দাগটা তুমি খেয়াল করেছো কখনো, আসমা? ন’ বছর বয়সে একবার গোখরো সাপ কামড়েছিলো আমাকে। তিন দিন অচেতন থাকার পর কোন রকমে বেঁচে যাই। যদি না বাঁচতাম?
আসমা : কী সব অলক্ষুণে কথা বলো!
অরিত্রি : বাবা মনে হয় বুড়ো হয়ে যাচ্ছে, তাই না মা?
আসমা : তুই থাম। ওঠো তো, ওঠো। চলো খাবে।
জেকে : আসমা তোমার মনে আছে, তোমার বাবা আমাকে সেই প্রথম পরিচয়েই বলেছিলেন- ইট ইজ বেটার টু বি সামবডি, র‌্যাদার দ্যান টু হ্যাভ মেনি থিংস! কথাটা আজ আমি নতুন করে উপলব্ধি করলাম।
আসমা : ব্যাপারটা কী, বুঝিয়ে বলবে তো? এরকম হেঁয়ালী করছো কেন?
জেকে : কী অদ্ভুত একটা ব্যাপার আসমা, আমি তোমাকে ঠিক বোঝাতে পারবো না। ... এই যে লিয়ানা, ধরো এই মুহূর্ত হতে আমি জেকে তোমার এমডি না, আমি হয়তো তোমার চেনা-জানা রক্ত-মাংসের কোন চরিত্রই না। আই’ম নেভার বি সিন, নেভার বি নোন অ্যান্ড নেভার বি লিভড্‌ ইন! কেমন হবে ব্যাপারটা?
লিয়ানা : আই’ম স্যরি স্যার, ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। আপনি যদি আর একটু হিন্টস দিতেন...
অরিত্রি : ফর গডস্‌ সেক, তোমরা এখানে নতুন করে অফিস খুলে বসো না। বাবা ইউ আর চিটিং! তুমি আমাদের পুরো ডে-আউটটাই বোর করে দিচ্ছো...
জেকে : না না, তুই বুঝতে পারছিস না ব্যাপারটা, ইটস্‌ আ ভেরি ইন্টারেস্টিং এক্সপেরিয়েন্স... মানে আমি আছি, আমি নিজে নিজেকে ফিল করতে পারছি, বাট আমার চেনা পৃথিবীর কোন মানুষ আমাকে চিনতে পারছেনা। মানে বুঝলে আসমা, ব্যাপারটা অনেকটা... ধরো আমার কোন ফ্যামেলি ফটোগ্রাফ, তুমি আছো, আমি আছি, অরিত্রি আছে, তোমার বা আমার বাবা মা আছেন, আরো ধরো অনেকে... এর মধ্য থেকে কোন ভাবে আমার ছবিটা মুছে ফেলা হলো, তোমাদের সবাইকে বোঝানো হলো, এই মানুষটা কেউ না, একে তোমরা কেউ চিনো না। কেমন হবে?
অরিত্রি : কেমন আবার হবে?
জেকে : কেমন হবে মানে? ধর আমি তো তোদের সবাইকে চিনি, কিন্তু তোরা কেউ আমাকে চিনিস না। ওই যে গানটার মতো, নেভার বি সিন, নেভার বি নোন অ্যান্ড নেভার বি লিভড্‌ ইন!
আসমা : জাস্ট স্টপ ইট। খাবার রেডি, চলো খাবে।
জেকে : না না আসমা তুমি বুঝতে পারছো না... লেট মি এক্সপ্লেইন...
আসমা : নো, আর কোন কথা নয়, এক্ষুনি খেতে চলো সবাই। ইটস অ্যান অর্ডার।

[সবাই একসাথে উঠে পড়বে, জেকে হতাশ হয়ে তাদের অনুসরণ করবেন]


দৃশ্য: একুশ / দিন
গাড়ির ভেতর

[পার্কের গেটের কাছে ছোটখাটো একটা জ্যাম, যে জন্যে গাড়ি বের হতে পারছে না। হঠাৎ জেকে লক্ষ্য করবেন, সেই ছোট্ট মেয়েটি গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে, তার হাতে ধরা আছে সেই বলটা। আগের মতোই জেকে’র দিকে তাকিয়ে হাসছে মেয়েটা। জেকে প্রথমে চমকে গেলেও পরে সামলে নেবেন। ততোক্ষণে গাড়ি চলতে শুরু করেছে। জেকে জানলার বাইরে হাত নেড়ে বাচ্চাটাকে বিদায় জানাবেন, মুখে বলবেন- থ্যাঙ্ক ইউ! আসমা এবং অন্যরা অবাক হয়ে তাকাবেন জেকে’র দিকে, কারণ তারা বাইরে কাউকে দেখতে পাবেন না। জেকে তাদের বিষ্মিত দৃষ্টি উপেক্ষা করে ড্রাইভারকে গান বাজাতে বলবেন। ড্রাইভার গান বাজালে গাড়িটা বেরিয়ে যাবে]



দৃশ্য: বাইশ / দিন
পার্ক

[সেই ছোট্ট মেয়েটি অর্থাৎ উর্মীর পিভি থেকে গাড়িটার চলে যাওয়া দেখা যাবে, উর্মী সেদিকে তাকিয়ে থাকবে। তারপর সে মুখ ফিরিয়ে তাকালে দেখা যাবে, তার মুখে মৃদু হাসি লেগে আছে। তার হাসিটা পরিণত মানুষের মতো, যেন সে সবজান্তা- এরকম একটা ভাব। কাট শটে এক ভদ্রলোককে পেছন থেকে দেখা যাবে, তিনি মোবাইলে কথা বলছেন। হঠাৎ পায়ের কাছে কাপড় ধরে একটা ছোট বাচ্চা টান দিতেই তিনি ফিরে তাকাবেন, তাঁর পিভি থেকে উর্মীকে দেখা যাবে। তিনি মৃদু হেসে তার সাথে কথা বলবেন]

লোক : কী নাম তোমার?
উর্মী : উর্মী
লোক : বাহ্‌, সুন্দর নাম তো!
উর্মী : কী নাম তোমার?
লোক : আমার নাম? আমার নাম...

সমাপ্ত

1 টি মন্তব্য: