রবিবার, ৫ জুলাই, ২০০৯

আমরা কারা! (শিশু নাটকের পাণ্ডুলিপি)

কোরাস: এক

ভোর হলে দোর খুলে খুকুমনি উঠবে
শিশিরেতে ভেজা ঘাস পায়ে দ'লে ছুটবে
খুলে হাল তুলে পাল তরীগুলো চলবে
নড়ে-চড়ে হাই তুলে শিশু চোখ খুলবে...
শিশুর সকাল মানে সূর্যের হাসিমুখ
নজরুল ভাবতেন শিশুদের কত সুখ!
কিন্তু এখন এ কী!
সকালবেলা ঘুম ভেঙে কী দেখি!!

কোরাস: দুই

আম্মু ডাকেন ধাক্বা দিয়ে ভোর হয়েছে ওঠো
নানান কাজের যাচ্ছে বেলা নওতো তুমি ছোট
আব্বু বলেন ব্যায়াম করো
বড়পা বলেন গলা সাধো
লড়তে হবে সারাটা দিন
কোমর কষে বাঁধো ।।
মুখ ভেঙচায় স্কুলের ব্যাগটা এই মোটা তার পেট
ইশকুলে নয়, পয়লা ছুটো কোচিং হোমের গেট
কোচিং ফিরেই পড়তে বসো, পড়ার শেষে স্কুল
কে জানে ভাই কোথায় ফোটে শিউলি-বকুল ফুল
স্কুলের দেয়াল জেলের মতো, নেইতো সেথায় মাঠ
মাঠ খুঁজলেই টিচার বলেন: পাঠের সময় পাঠ!
পাঠের সময় পাঠ যদি হয়, পাঠের পরে খেলা
খেলার বেলা? পরে। এখন হোমটাস্কের পালা
সাঁতার গীটার কম্পিউটার
নাটক ডিবেট আর্ট-কালচার
শিখতে শিখতে প্রাণ জেরবার
শেষ কি আছে শেখার?
কম্পিউটার ভর্তি আমার স্পোর্টস আপডেট ম্যালা
স্পোর্টসটা এখন শুধুই খেলা, নয়তো খেলাধূলা
অনলাইনেই শিখছি ক্রিকেট, শিখছি টেনিস, জুডো
এখন তো আর কেউ খেলেনা দাঁড়িয়াবান্ধা, লুডো...

কোরাস: তিন

এইভাবে দিনরাত শিখছি শিখছি
ঘাড় গুঁজে মুখ বুঁজে পড়ছি লিখছি
শিক্ষার শিকেটাকে ছিঁড়তে
একঘেয়ে ঘ্যান ঘ্যান অধ্যয়নের ধ্যান
করতেই হবে জয় বিশ্বের বিষ্ময়
অজানাকে দেবো নাকো ভিঁড়তে... ।।

কোরাস: চার

আমরা এখন অনেক কিছু জানি
কোন সাগরে কত লিটার পানি
কোন আকাশে কয়টা তারা উঠে
কোন গাড়িটা কত জোরে ছোটে

কোন পাহাড়ের উচ্চতা কয় ফিট
কোন শিল্পীর কয়টা ক্যাসেট হিট
টেন্ডুলকার করলো কত রান
কয়টা ছবি করলো শাহরুখ খান

টুইন টাওয়ার ধ্বংস হলো কবে
বিন লাদেনকে কোথায় পাওয়া যাবে
দুনিয়া জুড়ে যুদ্ধ করে কারা
কাদের স্বভাব কেবল মানুষ মারা

আমরা জানি তিমীর বয়স কত
বেড়াল কেন দেখতে বাঘের মতো
আর্কিমিডিস প্লেটো কি নিউটন
এসব জানা খুবই সাধারণ
ত্রিকোণমিতি জ্যামিতি রাজনীতি
নিত্যদিনের নৈমিত্যিক ভীতি
দরকারী-অদরকারী হয়রানী
এই বয়সেই অনেক কিছু জানি...।।

কোরাস: পাঁচ

জানতে কি চাও আমরা এসব কেমন করে জানি?
একটা কথা ছোটবড় সবাই নেবে মানি
ছোটরা যা শেখে সে তো বড়দেরই কাছে
বড়রা যা বলে, তাতে শেখার অনেক আছে...

খণ্ডচিত্র: এক

১ম ভদ্রমহিলা: ভাবী, আপনার মেয়ে সিলভীকে দেখছি না যে, সে কি বাসায় নেই?
২য় ভদ্রমহিলা: বাসায় থাকবে কি, ও তো নিউজার্সিতে! ওর মামার কাছে। এখন থেকে ওখানেই থাকবে, পড়বে।
১ম: ওইটুকু মেয়ে একা একা অতদূরে থাকছে! বলেন কি!
২য়: কী করবো ভাই, দেশে কি আর পড়াশোনার অবস্থা আছে? স্কুল কলেজের পড়াশোনার যে হাল! সেশন জট, ভর্তির ঝামেলা... তার ওপর লোডশেডিং, বাজারদর, ধূলো-ধোঁয়া, মশার কামড়, পানির কষ্ট, ট্রাফিক জ্যাম, হরতাল... এদেশে বেঁচে থাকাই তো কঠিন, পড়াশোনা অনেক দূরের ব্যাপার...

সূত্রধার> এক: আমরা এখানে কী শিখলাম?
সূত্রধার> দুই: আমাদের দেশে পড়াশোনার কোনো পরিবেশ নেই। তাই আমাদের সবাইকে উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশ গমন করতে হবে
সূত্রধার> এক: নয়তো সবাইকে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হবে
সূত্রধার>দুই: সম্ভব হলে দেশও ছেড়ে দিতে হবে, কারণ এই দেশে বেঁচে থাকাই কঠিন!

খণ্ডচিত্র: দুই

ছেলে: মা, আমার হোমটাস্ক শেষ। এবার খেলতে যাই?
মা: কোথায় যাবে খেলতে?
ছেলে: মাঠে। রনি, সুজন, মন্টু... ওদের সাথে খেলবো
মা: ওদের সাথে মানে? ওরা তো টোকাই! টোকাইদের সাথে খেলে খেলে টোকাই সাজবি?
ছেলে: ওরা টোকাই হতে যাবে কেন? ওরা তো আমাদের পাড়াতেই থাকে। ওরাও লেখাপড়া করে, স্কুলে যায়...
মা: স্কুলে যায় মানে কী? ওরা তোমার মতো ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে? ওরা কি তোমার মতো গাড়িতে চড়ে স্কুলে যায়? তোমার মতো ওদের ঘরে কম্পিউটার আছে? তোমার মামাদের মতো ওদের মামারা কানাডায়, সুইডেনে থাকে?
ছেলে: কিন্তু ওরা ছাড়া তো আমার আর কোনো বন্ধু নাই...
মা: না থাকলে নাই। দুষ্ট গরুর চেয়ে শূণ্য গোয়াল ভালো। ঘরে বসে কম্পিউটারে গেম খেলো।
ছেলে: কিন্তু কম্পিউটারে গেম খেলতে আমার ভালো লাগে না। জিতলে কেউ হাততালি দেয়না, হারলে লজ্জাও পাইনা...
মা: ভালো লাগে না মানে কী? তোমার ইচ্ছামতো সব চলবে নাকি?
ছেলে: মা, খেলবো তো আমি, তাহলে আমার ইচ্ছামতো খেলবো না? তাহলে খেলে লাভ কী?
মা: আবার মুখে মুখে কথা! এসব কি ওই টোকাইগুলোর কাছে শিখেছিস নাকি?
ছেলে: ওদের কাছে শিখবো কেন? তুমিই তো বলেছো, সত্যিকথা স্পষ্ট গলায় বলতে যেন ভয় না পাই...
মা: সত্যি কথা, না? দাঁড়াও, তোমার সত্যিকথা বলা বের করছি...(চুল টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে যাবে)

সূত্রধার> এক: আমরা এখান থেকে কী শিখলাম?
সূত্রধার> দুই: যারা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়েনা, গাড়িতে চড়ে স্কুলে যায়না, যাদের ঘরে কম্পিউটার নাই...
সূত্রধার> এক: যাদের মামারা কানাডায় বা সুইডেনে থাকে না...
সূত্রধার> দুই: তারা সবাই টোকাই!
‍সূত্রধার> এক: কম্পিউটার হলো সবচেয়ে ভালো বন্ধু, তাই খেলতে হবে কম্পিউটারের সাথে
সূত্রধার> দুই: কিন্তু কম্পিউটার কি হেরে গেলে লজ্জা পায়?
সূত্রধার> এক: তুমি জিতলে হাততালি দেয়?
সূত্রধার> দুই: দেয়না? তাহলে খেলে লাভ কী!
সূত্রধার> এক: লাভ-লোকশান বড় কথা নয়, দুষ্ট গরুর চেয়ে শূণ্য গোয়াল ভালো
সূত্রধার> দুই: এবং সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো-
সূত্রধার> এক: শিশুদের সবসময় সত্যিকথা না বলাই ভালো
সূত্রধার> দুই: কারণ, কখনও কখনও সত্যিকথা বললে, চুলটানা খেতে হয়!

খণ্ডচিত্র: তিন

দাদী: (হাত থেকে ফেলে একটা কাঁচের প্লেট ভেঙে ফেলবেন)
মা: কী হলো, আবার কী ভাঙলো...
দাদী: (ভয়ে ভয়ে) হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেল মা...!
মা: তা ভাঙবে না? আপনার ছেলের তো জমিদারী আছে, যখন ইচ্ছা যা ইচ্ছা আছাড় দিয়ে ভাঙুন....
দাদী: আছাড় দিয়ে ভাঙিনি মা, হাত ফসকে পড়ে গেল। ভাবলাম তোমার কাজে সাহায্য করি...
মা: বলি আর কত সাহায্য করবেন আপনি? আপনার সাহায্যের অত্যাচারে আমার তো মরণ দশা! বুড়ো বয়সে এত যন্ত্রণা করতে লজ্জা করে না?
দাদী: আমি তো তোমার উপকারই করতে গেছিলাম...
মা: আমার উপকার আপনার করতে হবে না। আর আজ থেকে কাঁচের থালায় খাওয়াও আপনার বন্ধ। মনি-ই, এই মনি...
(মনির প্রবেশ)
মা: এই যা, তোর দাদীর জন্য বাজার থেকে মাটির সানকি কিনে আন। এখন থেকে বুড়ি মাটির সানকিতে ভাত খাবে।
মনি: সানকিতে?
মা: হ্যাঁ, সানকিতে। যেমন কর্ম, তেমন ফল। যা জলদি।
(মা চলে যাবে, মনি কিছুক্ষণ দাদীর দিকে তাকিয়ে থাকবে, দাদী কেঁদে ফেলে ভেতরে চলে যাবে, মনি উল্টোদিক দিয়ে বেরিয়ে যাবে। সূত্রধার প্রবেশ করবে)

সুত্রধার>এক: আমরা এখানে কী শিখলাম?
সূত্রধার>দুই: বুড়োদের সাহায্য হলো অত্যাচার। তাই বুড়ো মানুষদের সাহায্য নেয়ার দরকার নাই।
সূত্রধার>এক: আরও শিখলাম, যেমন কর্ম, তেমন ফল।
সূত্রধার>দুই: কেমন কর্ম? কেমন ফল?
সূত্রধার>এক: এক্ষুণি বোঝা যাবে। ওই দ্যাখ, মনি সানকি নিয়ে আসছে।
(সূত্রধার দুজন চলে যাবে, মনি আসবে সানকি নিয়ে। তার হাতে দুটো সানকি।)

মনি: মা, ও মা...
মা: কী রে, তোকে বললাম একটা সানকি আনতে, তুই দুটা আনলি কী মনে করে? টাকা কি বেশি হয়ে গেছে?
মনি: বুদ্ধি করেই দুটো আনলাম। তুমিও তো বুড়ো হবে, তোমার জন্য একটা লাগবে না? (চলবে)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন